ক্রিং....ক্রিং... ক্রি.....। উফ! ফোনটা ধরেনা। আবার, ক্রিং....ক্রিং... ক্রি.....। হ্যালো.... কোথায় তুমি? ঘুমের ঘোর কেটে মুখে একটা হাফ ছেড়ে- আ-আ... এইতো রুমে। ও..ও এখনও ঘুমিয়ে! নিচে এসো, আমি তোমার গেটে। শুনে মনটা যেন চমকে গেল আমার! তড়াক করে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি ও গেটের সামনে দাড়িয়ে। গেট খুলে দেই। রুমে এসেই যেন মুখটা গোমরা করে বসে রইল। বিছানাটা গুছিয়ে নিলাম। তারপর ফ্রেশ হয়ে যখন একটা নিজের হাতে আর একটা কফি ওর হাতে তুলে দিলাম তখন আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল। অনেকটা জেদের মতো করে কাপটা হাতে নিলো। আমি সোফায় বসে একবার কাপে চুমুক দিয়ে ওকে জিঙ্গেস করলাম, কি ব্যাপার! আজ এতো সকালে? অমনি ও ফিক করে হেসে ফেললো! তোরা অত্যন্ত রাগী ও জেদি মানুষ। কিন্তু আমার সাথে রাগ করে বেশিক্ষন থাকতে পারেনা। বললো আজ আমার জন্মদিন। তাই তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে এতো সকালে। বললাম হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। মুখে একটা স্মাইল হাসি দিয়ে বললো... ওয়েলকাম।
তোরার সাথে সম্পর্ক মাস ছয়েকের। সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। সমুদ্র পৃষ্ট থেকে একহাজার ফুট উপরে চন্দ্রনাথ পাহাড়। এরপর সহস্য ঝর্না দেখতে আবার নিচে নামতে হয় সিড়ি বেয়ে। চারশত তিরাশিটা সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে হয় আবার উঠতে হয়। এক হাজার ফুট বেয়ে যখন পাহাড়ের শীর্ষে পৌছি তখন আর শরীর চলেনা। তারপর যখন আবার নিচে ৪৮৩ টা সিড়ি বেয়ে নেমে সহস্র ঝর্ণাধারার কাছে গেলে আর উপরে ওঠার আগ্রহ থাকেনা। ঝর্ণা দেখে যখন উপরে উঠবো তখন পেছন থেকে তোরার ডাক শুনি- প্লিজ, আমাকে একটু হেল্প করেন। ওই নিচ থেকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিলো। ওকে হাত ধরে উপরে উঠাই। ওখান থেকেই পরিচয়। জিঙ্গেস করি- আপনি একা এখানে এলেন কেন? রাগ করে। একবছর হয় বিয়ে হয়েছে তোরার। স্বামী আফ্রিকাতে থাকে। তিন মাসের ছুটি নিয়ে দেশে এসে বিয়ে করে চলে গেছে। বিয়ের সময়টা ভালোই কেটেছে তোরার। স্বামী বিদেশে চলে যাওয়ার পর শুরু হয় অশান্তি। শশুর বাড়ী গ্রামে। শহরে একটা নতুন বিশাল বাড়ী করেছে তার স্বামী। বিয়ের পর এ বাড়ীতে সময় কেটেছে তোরার। স্বামী চলে যাওয়ার পর এ বিশাল বাড়ীতেই থাকে সে। তার সাথে থাকে কাজের একটা মেয়ে। তোরা খুব চঞ্চল ও হাসিখুশি থাকা মানুষ। সে চলে যাওয়ার পর একা একা লাগে বলে বার বার সময়ে অসময়ে ফোন করে বিদেশে।কিন্তু বিনিময়ে তাকে শুনতে হয় বুঢ় আচারণ আর গালি। এসব তোরা সহ্য করতে পারেনা। রাগে ফোন ছুড়ে ফেলে দেয়। এ পর্যন্ত চার-পাচটা ফোন ভেঙ্গে ফেলেছে সে। সময় যতো যায় বিদেশ থেকে ফোন করাও কমতে থাকে। এসব তোরা মানতে পারেনা। মাঝে মাঝে ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমায়। বিয়ের আগে নিজেদের সব স্বরনীয় দিনগুলো ঘটা করে পালন করেছে তোরা। এখন আর কিছুই হয়না। আজ তার জন্মদিন বলে কাল দিনে রাতে অন্তত: অর্ধশত বার বিদেশে ফোন দিয়েছে তোরা। কিন্তু কোন রিপ্লে পায়নি। মানুষ স্বভাবতই সঙ্গপ্রিয়। প্রতিদিন মানুষ তার ভালোলাগার সময়টাকেই খুজে ফেরে। সেখানেই পায় তার জীবন প্রবাহের শান্তি। নিজের ব্যর্থতাকে ভুলতে মানুষ ভালোলাগাকে অনুসন্ধান করে। এভাবেই হয়তো পৌছে যায় কোন অনাকাংখিত সম্পর্কে আর সুখের সীমানায়।
মহামায়ার ইকোতে হাত ধরে পাহাড় ঘেষে নদীর সরু পথে স্প্রিডবোটে দুজনে। ওর মুখে উচ্ছসিত হাসি। খোলা চুলগুলো উড়ছে। কপালে লালটিপ। হলুদ আভার গোল মুখটাতে যেন আলোর দ্যুতি ছড়াচ্ছে। পাহাড়ের ভাজে ভাজে জলের পথে আমরা স্প্রিডবোটে ঘুরতে থাকলাম। আধাঘন্টা পরে নামলাম। তারপর হাটছি দুজনে পাহাড় কাটা রাস্তা দিয়ে। দেখছি পাহাড়ের সবুজ প্রকৃতিকে। কিছু দুর গিয়ে রাস্তা শেষ। এবার ফিরতে হবে। কিছু উপরে একটা পাহাড়ী ফুল ফুটে আছে। তোরা জেদ করলো- ঐ ফুলটা নিয়ে এসো। এতদুর! আমি জানিনা....। কি আর করা! অনেক কষ্টে এনেদিলাম। হাতে না খোপায় পড়ে দাও। দিলাম পড়ে। খুব খুশী হলো। আমার হাতটা আরো শক্ত করে ধরলো। এমনি নানান বায়না আর খুনসুটি করে দুপুর অবধি ফিরি শহরে। এরপর ফুড ক্যাফেতে। রঙিন আলো। একটা টেবিলে মুখোমুখি দুজন। সামনে কেক। কেকের পাশে চারটি মোমবাতি। একে একে জ্বালিয়ে দিলাম সব। ও ফু দিয়ে নিভে দিলো একে একে। আর তখনি আমার মুখোধ্বনি- হ্যাপি বার্থড ডে টু ইউ..। কেক কাটা শেষে বিরিয়ানি তারপর কোল্ড ড্রিংস। একেবারে ভরপেট। ও বিল মিটিয়ে দিলো। এরপর ফুড ক্যাফে থেকে বের হলাম দুজন। পরন্ত বিকেল। একটা ট্যাক্সি ক্যাব ডাকলাম। ফিরছি দুজন ট্যাক্সি ক্যাবে। পাশাপাশি দুজন শুধু আর চোখে তাকানো। ওকে বললাম- আজকের সময়টা তোমার খুব ভালো লেগেছে? মুখে একটা আলতো হাসি দিয়ে- খু....ব। রাস্তা বেশ ফাকা। ট্যাক্সি জোড়ে চলছে। বললাম, আমি কিন্তু কিছুদুর গেলে নেমে যাবো। না আজ আমাকে বাসা অবধি পৌছে দিতে হবে। কিছু বললাম না, তোরা অভিমান করতে পারে। পৌছে নেমে ট্যাক্সি বিদায় দিলাম। বললাম, তাহলে আসি? না, ভেতরে এসো। না....। এসো একটু পরে যাবে। চললাম ওর পেছনে পেছনে। তোরাকে গেটের তালা খোলা দেখে বললাম, মেয়েটা নেই? ও বাড়ীতে বেড়াতে গেছে। ভেতরে ঢুকলাম। খুব ক্লান্ত লাগছে তাই একটু ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকলাম। মুখে পানির ঝাপটা দিলাম। তোয়ালে দিয়ে মুছে বাথরুম থেকে বের হতে বাথরুমের দরজা খুলতেই দেখি, রুমটা অন্ধকার! বিদ্যুত চলে গেল নাকি! দেখি ডিমলাইট জ্বলছে। ডাক দিলাম- তোরা...? দেখি ও আমার সামনে। ওর মুখে ছড়ানো চুলগুলো। তোরার ঠোট দুটো কাপছে। ওর অধির দৃষ্টি আমার দিকে। এরপর কি হলো জানিনা, আমি শুধু আধো আলোতে এটুকু দেখলাম দেয়ালে টাঙ্গানো ওয়ালমেট। দুটি টিয়াপাখি মুখোমুখি ঠোটে ঠোটে।
এই পৃথিবীতে বিত্ত বৈভব মানুষের ভালো থাকার অন্যতম মাধ্যম। বৈভব আহরণে অনেক মানুষ নিজের মানুষের কাছ থেকে থাকে অনেক দুরত্বে। তবুও হৃদয়ের সুখ-দু:খ, ভাল-মন্দ, হাসি-খুশী, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, আশা-আকাঙ্খা সহ নানা প্রবাহ নিত্য বয়ে চলে মানুষের জীবনে। এজন্যই প্রয়োজন হয় সহমর্মিতার। দুরত্বে থাকলেও সহমর্মিতার অনুভূতি প্রকাশে প্রয়োজন তাই নিয়মিত যোগাযোগ। আর এতেই গড়ে উঠতে পারে মন ও জীবনের বোঝাপড়া। তৈরী হতে পারে অপেক্ষার হাজারও প্রহর। সব যৌবনই গায় সঙ্গতার গান। নিজের মানুষের কাছেই করে তার অনুভূতি প্রকাশ। একটু সময়ে একটু বাক্য হৃদয়ের পূঞ্জিভূত সব যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিতে পারে যদি সেখানে থাকে নির্মলতা ও আবেগের স্বাদ। পূঞ্জিভূত কষ্ট আর যন্ত্রণার মাঝে ঝাঝালো সুর চিরাচরিত সম্পর্কেও নিয়ে যায় দুর বহুদুর। কারো স্বপ্ন সারথী হয়েও উদাসীন আর অবিবেচক যারা, তাদের জন্যই এমন জীবন চালায় হাজারও তোরা।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:১৪