আলু বাংলাদেশের অন্যতম একটি অর্থকরী ফসল। দিনদিন এর আবাদও বেড়ে চলেছে। কিন্তু সঠিকভাবে সংরক্ষণের অভাবে কৃষকের উৎপাদিত এ ফসল নষ্ট হচ্ছে। সম্প্রতি এ অবস্থা থেকে কৃষকদের মুক্তি দিতে একটি বিকল্প পথ তৈরি করছেন দিনাজপুরের প্রকৌশলী দিলীপ কুমার। দিলীপের বিদ্যুৎবিহীন হিমাগার যুগিয়েছে নতুন আশা
হিমালয়ের পাদদেশ দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার সুজালপুর ইউনিয়নে উন্নত পদ্ধতিতে প্রাকৃতিকভাবে আলু ও সবজিসহ কৃষি পণ্য সংরক্ষণের জন্য নতুন এক হিমাগার নির্মাণ করেছেন প্রকৌশলী দিলীপ কুমার।
বিদ্যুৎবিহীনভাবে প্রায় ৬ মাস এই হিমাগারে আলু ও সবজি সংরক্ষণ করা সম্ভব। আর এ পদ্ধতিতে সতেজ থাকে আলু আর সবজি।
কৃষি পণ্য ও বিভিন্ন কাঁচামাল সংরক্ষণের জন্য বাঁশ, খড় ও মাটি ব্যবহার করে তৈরী করা হিমাগারটি এখন সবার দৃষ্টি কেড়েছে। ১১০ মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন দিলীপ কুমারের হিমাগারটি নির্মাণ করতে প্রায় ১০ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। ক্যাটালিষ্ট ও জিমার্ক সংস্থার আর্থিক সহযোগিতায় নির্মিত এ হিমাগারটি সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃৃষকদের মাঝে কৃষি পণ্য সংরক্ষণে আশার আলো সৃষ্টি করেছে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে আলু একটি অর্থকারী ফসল। বিশ্বের মধ্যে আলু উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম হলেও এশিয়ার মধ্যে এর অবস্থান ৪র্থ। বাংলাদেশে চাষাবাদকৃত অঞ্চল বিবেচনায় ধান এবং গমের পরেই আলুর অবস্থান। আর উৎপাদন বিবেচনা করলে ধানের পরেই ২য় স্থানে রয়েছে আলু।
কথা হয় বিদ্যুৎবিহীন হিমাগার তৈরির স্বপ্নদ্রষ্টা দিলীপ কুমারের সঙ্গে।
প্রকৌশলী দিলীপ কুমার জানান, প্রাকৃতিকভাবে সবজি সংরক্ষনাগার তৈরীর প্রযুক্তি বাংলাদেশ তথা এশিয়ার কোথাও এখনও ব্যবহার করা হয়নি। এই হিমাগারের প্রযুক্তি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্মিত হিমাগারটিতে পর্যাপ্ত বাতাস যাতায়াতের জন্য ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটি ৩০ ফুট প্রশস্থ, ৬০ ফুট দীর্ঘ এবং এর উচ্চতা ৯ ফুট। এই হিমাগারের ধারণ ক্ষমতা ১১০ টন।
মিম সিডস্ এর ব্যবস্থাপক তৌহিদুল ইসলাম বকুল এই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠায় প্রকৌশলী দিলীপ কুমার সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা করেন। বিদ্যুৎবিহীন এই হিমাগারটি ব্যবসায়ী ও সাধারণ কৃষকদের উপকারী হিসেবে ও সময়োপযোগী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় বিজ্ঞানীরা। বীরগঞ্জের সুজালপুরে নির্মিত হিমাগারের মত পদ্ধতি অনুসরণ করে ১০ থেকে ২০০ টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন হিমাগার নির্মাণ করা সম্ভব বলে যুগান্তরকে জানান দিলীপ।
তিনি বলেন, হিমাগারের বিকল্প হিসেবে এটি অত্যন্ত কার্যকরী এবং নির্মাণ ব্যয়ও অনেক কম। এখানে আলু সংরক্ষণ খরচ কেজি প্রতি প্রায় ১ টাকা। বিদ্যুৎ দ্বারা চালিত কোল্ডস্টোরেজে ১ কেজি আলু সংরক্ষণ করতে ব্যয় হয় ৫ থেকে ৬ টাকা।
একটি ১ হাজার মেট্রিক টন কোল্ডস্টোরেজ নির্মাণ করতে নূন্যতম ২০ কোটি টাকা খরচা পড়ে। এর জন্য প্রতিমাসে প্রতিষ্ঠানটিকে বিল পরিশোধ করতে হয় প্রায় ১ লাখ টাকা। বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে গিয়ে আলু ও অন্যান্য সবজি এবং কৃষি পণ্য সংরক্ষণের জন্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে মাটির ঘরে নির্মিত হিমাগারে আলু ও সবজি সংরক্ষণ করতে কোন বিদ্যুৎ খরচ নেই। দেশে এখন প্রায় দু থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি রয়েছে। বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবেলা করাও সম্ভব বলে আশা প্রকাশ করেন অনেকেই।
সংরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রকৌশলী দিলীপ কুমার বলেন, বাংলাদেশে হিমাগারের সল্পতার কারণে কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত সমস্ত আলু সংরক্ষণ করতে পারেন না। মোটামুটি ৩০-৩৫ শতাংশ (উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে) আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়। সাধারণভাবে প্রাকৃতিক তাপমাত্রায় বাড়িতে সংরক্ষিত আলু পচনের হার অনেক বেশি। গরীব কৃষকদের বেশীরভাগই তাদের শস্য সাধারণত ঘরের মেঁঝেতে বা খাটের নিচে বা ছোট কোন ঘরে রেখে দেন। এভাবে সংরক্ষণ করলে ২-৩ মাসের বেশি রাখা সম্ভব হয় না এবং এখান থেকে উল্লেখযোগ্য অংশে পচন ধরে যায়। এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অন্যদিকে যারা আলু রপ্তানী করে তারা আলু তোলার দুমাসের বেশী সময় পর আর রপ্তানী করতে পারে না। কারণ ওই আলুর গুণগত মান আর রপ্তানী উপযোগী থাকে না। আবার হিমাগারে সংরক্ষিত আলু রপ্তানীর জন্য অর্থ সাশ্রয়ী হয় না। উদ্ভুত পরিস্থিতে সঠিকভাবে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে আলু সংরক্ষণ প্রক্রিয়া হতে পারে একটি ভালো সমাধান যা আলুর গুণগত মান ঠিক রাখবে, আলুকে রোগবালায় ও পচনশীলতার হাত থেকে রক্ষা করবে। উচ্চ মূল্যের সময়ে কৃষকের আলু বিক্রির সুযোগ তৈরী করবে এবং রপ্তানীকারকদের আলুর রপ্তানী সময় বৃদ্ধি করবে। এর ফলে গরীব আলুচাষীর আয় বাড়বে।
ভারতের পশ্চিম বঙ্গের ঈড়সঢ়ধঃরনষব ঞবপযহড়ষড়মু ওহঃবৎহধঃরড়হধষ (ঈঞও) উদ্ভাবিত উন্নত প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে আলু সংরক্ষণ পদ্ধতিও আলু রপ্তানিকারক, প্রক্রিয়াজাতকারক ও কৃষকদের মাঝে প্রচলিত করার জন্য প্রইভেট সেক্টরকে উদ্বুদ্ধ করার স্বার্থে গেধৎশ মীম সীডের সঙ্গে আলোচনা করে চুক্তিভিত্তিতে গেধৎশ একটি ইন্টারভেনশন ওসঢ়ৎড়ারহম ধহফ ঢ়ৎড়সড়ঃরহম রসঢ়ৎড়াবফ হধঃঁৎধষ ংঃড়ৎধমব ংুংঃবস অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিনিয়োগ করতে সম্মত হয়। ক্যাটালিষ্ট ও জিমার্কের সহযোগিতায় মিম সীডস্-এর তৌহিদুল ইসলাম বকুল এই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। এই কাজে প্রকৌশলগত সহযোগিতা দেন কাহারোল উপজেলা প্রকৌশলী দিলীপ কুমার।
মীম সিডস্ ১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে। বাংলাদেশ থেকে আলু রপ্তানীকারকদের মধ্যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম যারা আলু রপ্তানীর পাশাপাশি আলুর বীজ উৎপাদন ও চুক্তিভিত্তিক সরবরাহও করে থাকে।
যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে আলু রপ্তানী করে আসছে সেহেতু এই নতুন প্রযুক্তির পরিক্ষামূলক ব্যবহার ও সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে এলাকাবাসী আশা করছে।
২০১১’র নভেম্বরে প্রাকৃতিক সংরক্ষণ অবকাঠামো / ঘর তৈরীর পর তৌহিদুল ইসলাম বকুল কিছু সবজি ও আলু ২০১২ সালের ফেব্র“য়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে সেখানে রাখেন এবং পরে রপ্তানির উদ্দেশ্যে উন্নত পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাকৃতিক ভাবে আলু সংরক্ষণ করেন।
বিদ্যুৎবিহীন হিমাগার নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন দৈনিক যুগান্তরের দিনাজপুর প্রতিনিধি আহসানুল আলম সাথী
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০১২ রাত ১০:১৪