গত ২২/০৫/২০১৩ ইং তারিখে কাজিনের বিয়ে উপলক্ষ্যে আমরা গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম।আমাদের সাথে ছিল আমার এক ফুফু (আব্বুর মামাতো বোন)।উনি আব্বুর বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন।ওই ফুফু ফরিদপুর তার ভাইয়ের বাসায় যাবেন বলে আমাদের সাথে যাবেন।আমরা মাওয়া-কাওড়াকান্দি রুট দিয়ে ভাঙ্গা থেকে বামে মোড় নিয়ে মাদারীপুরের টেকেরহাট হয়ে গোপালগঞ্জের জলিলপাড় হয়ে বাড়ি যাব বলে স্থির করেছি।কারন মুকসুদপুর শহরের ভিতরে একটা নদী আছে যার সেতু যানবাহন চলাচলের অযোগ্য।তাই আমাদের এতো হাঙ্গামা করে বাড়ি যেতে হবে।তো ফুফু বললেন তাকে ভাঙ্গা চৌরাস্তায় নামিয়ে দিলে উনি ওখান থেকে বাসে করে ফরিদপুর যেতে পারবেন।তো সেভাবে প্লান করে আমরা ২২ তারিখ সকালে ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের এক মমতাময়ী গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।আধুনিকতার পুরো ছোয়া না লাগলেও এই গ্রামের প্রতিটি ধুলিকণা,গাছপালা,পুকুর-দীঘিতে বিছানো রয়েছে এক অদৃশ্য মায়া।যার টানে আমি বারবার ছুটে যায় আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় আমার মমতাময়ী গ্রামে।
এবার মুল কথায় আসি,আমরা যখন ভাঙ্গা চৌরাস্তায় পৌছায় তখন বেলা ২টা বাজে।ফুফুকে নামিয়ে দেওয়ার জন্য আমার ভাই ড্রাইভারকে গাড়ি সাইড করতে বললে ড্রাইভার চৌ্রাস্তা থেকে বামে মোড় নিয়ে গাড়িটা পার্ক করলেন।গাড়ির দরজা খোলার পরে আমি দেখলাম পাশেই কয়েকটি খাবার হোটেল (রেষ্টুরেন্ট) যা দেখে আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল।মনে পড়ে গেল ১৫ বছর আগের এক করুন সময়ের কথা।যেদিন প্রথম নিজের অজান্তেই কেঁদে উঠেছিল আমার কিশোরী মন।যেদিন জীবনে প্রথমবার আমার মনে হয়েছিল আমি পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ।
তখন ১৯৯৮ সাল,আমি ক্লাশ এইটে পড়ি।আব্বুর পোস্টিং তখন মাদারীপুরের টেকেরহাট খাদ্য গুদামে।আমরা আব্বুর সাথেই থাকি।ডিসেম্বর মাসের দিকে আমার হঠাৎ করে জ্বর হয়।দশ দিন হয়ে গেলেও যখন আমার জ্বর কমছিলো না তখন আব্বু আমাকে ভাল চিকিৎ্সার জন্য
ফরিদপুর এক ডাক্তারের কাছে পাঠালেন।আমার সাথে ছিল আমার আম্মু আর ছোটো কাকা।সন্ধ্যার পরে ডাক্তার দেখিয়ে আমরা যখন টেকেরহাটের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম তখন রাত প্রায় ৮ঃ৩০ মিনিট।হঠাৎ করে আমার খুব পানির পিপাসা পায়।তাই আমার কাকা আমাকে নিয়ে ভাঙ্গা এক হোটেলে যায় পানি খাওয়ানোর জন্য।আমরা হোটেলে গিয়ে মিষ্টি আর দধির অর্ডার দেই।৮/৯ বছরের এক পিচ্চি ছেলে আমাদের টেবিলে মিষ্টি দধি আর পানি দিয়ে যায়।কিছুক্ষণ পর দেখি সেই ছেলেটি আমার ঠিক পাশের টেবিলে এক প্লেট ডাল ভাত নিয়ে রাতের খাবার খেতে বসল।কেন জানিনা আমি ওই ছেলেটির খাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।হঠাৎ দেখি ছেলেটি তার প্যান্টের ভাঁজে গুজে রাখা অর্ধেক মাছের টুকরা বের করে তার প্লেটের পাশে রাখলো।এই দৃশ্য দেখার সাথে সাথে আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম সকালে দু'টো রুটি আর ডাল,দুপুরে এক প্লেট ভাত,এক টুকরো মাছ আর ডাল এবং রাতে ডাল আর ভাত খাওয়ার বিনিময়ে সে ওই হোটেলে কাজ করে।তো হোটেল মালিক দুপুরে যে এক টুকরো মাছ দেয় সেই মাছের অর্ধেক সে দুপুরে খায় আর অর্ধেক রাতের জন্য রেখে দেয় প্যান্টের ভাঁজে।যে দৃশ্য আজও আমার চোখে ভাসে।যা আমাকে আজও কষ্ট দেয়।সেদিন ছেলেটির কাছ থেকে তার নাম জেনেছিলাম।কিন্তু এখন ভুলে গিয়েছি।খুব কষ্ট হয়েছে ওর নাম মনে করতে পারিনি বলে।
আমাকে ক্ষমা করো হে বালক আমি তোমার নাম মনে রাখতে পারিনি বলে।আমাকে ক্ষমা করো আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনি বলে।তবে বুকের ভিতরে এখনো একটা কষ্ট জমা রয়েছে শুধুই তোমার জন্য।