হযরত আলী (রাঃ) হচ্ছেন পাক পাঞ্জাতানের একজন। তাঁর জন্ম পবিত্র কাবা ঘরে, প্রথম দর্শন রাসূল (সাঃ) এর মুখ । প্রথম খাদ্য রাসূল (সাঃ) এর রসনা (থুথু)। তিনি সর্বদা রাসূল (সাঃ) এর সাথে ছিলেন। ১০ বৎসর বয়সেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং বিশ্বের প্রথম ইসলাম গ্রহণকারীর মর্যাদা লাভ করেন। রাসূলের (সাঃ) সহযোগী সার্বক্ষনিক দেহ-রক্ষক হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তিনি রাসূলের (সাঃ) পরিবারে লালিত-পালিত হন এবং রাসূলের (সাঃ) পরিবারের সদস্য ছিলেন। তার মর্যাদা সম্পর্কে বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) বলেছেনঃ-
• আমি জ্ঞানের শহর, আলী তাহার দরজা।
• আমি হেকমত বিদ্যার ঘর আলী তার দ্বার।
• কোন মোনাফেক আলীকে ভালবাসে না, কোন মুমিন আলীকে ঘৃনা করেন না।
• যে ব্যক্তি আলীকে গালী দেয়, সে আমাকে গালী দেয়; যে আমাকে গালী দেয়, সে আল্লাহকে গালী দেয়।
আল্লাহ হযরত আলীকে একজন মহাবীর “শের-এ-খোদা” এবং আদর্শ মানুষ হিসেব সৃষ্টি করেছেন। কারো কারো মতে কুরআনে হযরত আলী(রাঃ) সম্পর্কিত ৩০০ আয়াত নাজেল হয়েছে। যেমন-
“হে ইমানদারগণ! আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে উলিল আমর (যারা কর্তৃত্বশীল) তাদের।” ৪:৫৯।
“হে নবী পরিবার, আল্লাহ তো কেবল তোমাদের নিকট থেকে অপবিত্রতা দূর করতে চান এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে চান” ৩৩:৩৩।
“ওহে রাসূল! আনপার প্রতিপালকে পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা পরিপূর্ণরূপে মানুষের কাছে পেৌছে দিন। যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তার দেয়া নবুওয়াতির দায়িত্বের কিছুই পালন করলেন না।” ৫:৬৭ ।
হযরত আলী (রাঃ)কে প্রশংসা করতে গিয়ে তাঁর সকল মানব কল্যাণকর গুনাবলী, আল্লাহ এবং রাসূলের প্রতি প্রেম মূল্যায়ন করে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁকে প্রথম হিসেব ধরা হয়েছে:
1. তিনিই প্রথম এবং একমাত্র ব্যক্তি যিনি কাবা ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন।
2. তিনিই প্রথম (রাসূলের (সাঃ) পর) নামায প্রতিষ্ঠা করেছেন।
3. তিনিই প্রথম রাসূলের (সাঃ) অনুগত্য স্বীকার করছেন।
4. তিনিই প্রথম নিজেকে জিহাদের জন্য সমর্পণ করেছেন।
5. তিনিই প্রথম রাসূল (সাঃ) প্রতিষ্ঠিত ধর্মের বানী লাভ করেছেন।
6. তিনিই প্রথম মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআন সংকলন করেছেন।
7. তিনিই প্রথম হিজরতের রাতে রাসূলের (সাঃ) বিছানায় মৃত্যুর ঝুকি নিয়ে ঘুমায়েছেন।
8. তিনিই প্রথম, রাসূলের (সাঃ) অনুপস্থিতিতে সকল যুদ্ধের কমান্ডার নিযুক্ত হয়েছিলেন।
9. তিনিই প্রথম যাকে রাসূল (সাঃ) “দ্বিতীয় হারুন” উপাধি দিয়েছিলেন।
10. তিনিই প্রথম রাসূল (সাঃ) এর উত্তরাধিকারী মনোনয়ন পেয়েয়েন।
11. তিনিই প্রথম যাকে রাসূল (সাঃ) ‘মাওলা’ হিসেবে অভিষিক্ত করেছেন।
হযরত উমর হযরত আলী (রাঃ) সম্পর্কে বলেছিলেনঃ আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ফয়সালাকারী আলী (রাঃ)।
এমনকি রাসুল (সা) বলেছেনঃ ‘আকদাহুম আলী’ তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিচারক আলী। তাঁর সঠিক সিদ্ধান্ত
লক্ষ্য করে হযরত উমর একাধিকবার বলেছেনঃ ‘লাওলা আলী লাহালাকা উমার’ অর্থাৎ আলী না হলে উমর ধংব্ব হয়ে যেত।
সর্বপরি আল্লাহ তায়ালা আলী (রাঃ) এত বিবেক বুদ্ধি দিয়েছিলেন যে, তা যদি বিশ্বের সকল মানুষের মধ্যে বিতরন করা যেতো তাহলে সকল নির্বোধ এবং বোকারা বুদ্ধিমান হয়ে যেত। তাঁর বুদ্ধির অসংখ্য প্রসংশা আরো আছে। চক্রান্তকারীগণ তাঁর প্রশংসা ছাপিয়ে রেখেছে ঈর্ষায়। তারপরো তাঁর যতটুকু আমরা জানতে পেরেছি। ততটুকু বর্তমান নামধারী মুফতী-মাওলানারা প্রচার করছেন কী না তা ভাবার বিষয়। প্রায়ই লক্ষ্য করলে দেখা যায়- বাংলাদেশের বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে অন্যান্য সাহাবীদের যেভাবে প্রসংশা করা হয় তার কিঞ্চিৎ পরিমানও আলী (রাঃ) প্রশংসা করা হয় কি?
" হযরত আলী (রা)-র জীবন মূল্যবোধ ও শিক্ষা "
আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (রা)’র শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের স্বর্গীয় আলোকোজ্জ্বল প্রভাব যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের পরতে পরতে আদর্শ মুমিনের কর্মতৎপরতার গভীরে অতুলনীয় ও ক্রমবর্ধমান প্রভাব সৃষ্টি করে চলেছে। তাঁর জীবন যেন অসংখ্য শ্রেষ্ঠ-গুণে সমৃদ্ধ এক মহাকাব্য। এই মহাপুরুষের পবিত্র জন্মদিনে বিশ্বের সব মুসলমানকে জানাচ্ছি হৃদয়-নিংড়ানো মুবারকবাদ।তিনি জন্ম নিয়েছিলেন পবিত্র কাবা ঘরে হিজরতের তেইশ বছর আগে (১৩ ই রজব) এবং শাহাদত বরণ করেছিলেন কুফার পবিত্র মসজিদের মেহরাবে হিজরি ৪০ সনের একুশে রমজানে।
আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (রা)’র মহৎ ও সুন্দর ব্যক্তিত্ব এত বিশাল বিস্তৃত ও এত বৈচিত্র্যময় যে একজন মানুষের পক্ষে তাঁর সব বৈশিষ্ট্য ও পরিধি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করাও সম্ভব নয়। মানুষ কল্পনার ফানুস উড়াতে পারবে কিন্তু এর কিনারার নাগালও পাবে না।
মানুষের মনে উত্তেজনা ও প্রভাব সৃষ্টিতে আমিরুল মু’ মিনিন আলী (রা)’র সুবিশাল ব্যক্তিত্ব ও মহত্ত্ব ইতিহাসে দখল করে আছে অনন্য ও শীর্ষস্থানীয় অবস্থান। বিশ্বনবী (সা.)’র পর এ ব্যাপারে তিনি সত্যিই অপ্রতিদ্বন্দ্বী। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে তথা হিজরী সপ্তম শতকে মুহাম্মাদ ইবনে শাহরাসুব আল-মাজান্দারানি নামের একজন মুসলিম পণ্ডিত ছিলেন। তার লাইব্রেরিতে ” মানাকিব” বা “মহত গুণাবলী’ শীর্ষক এক হাজার বই ছিল। আর এসবগুলোই ছিল হযরত আলী (আ)’র মহত গুণাবলী সম্পর্কে লিখা। এ থেকেই বোঝা যায় আলী (রা)’র ব্যক্তিত্ব ইতিহাসের কাল পরিক্রমায় কত অগণিত অসংখ্য মানুষকে আকৃষ্ট করতে পেরেছে।
মহান আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এ জন্য যে তিনি মানব জাতিকে হযরত আলী (রা)’র মত একজন মহামানব উপহার দিয়েছেন।
ভারত উপমহাদেশের বিশিষ্ট সূফী সাধক ও চিশতিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা খাজা মুঈনউদ্দিন চিশতি (র.) বলেছেন,সমুদ্রকে যেমন ঘটিতে ধারণ করা অসম্ভব তেমনি বর্ণনার মাধ্যমে আলী (রা)’র গুণাবলী তুলে ধরাও অসম্ভব।
হযরত আলী (রা) ও সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত যাদের জীবন তাঁরা মানুষের মনকে আকৃষ্ট ও তাদের চিন্তা-চেতনাকে আবিষ্ট করা ছাড়াও মানুষের মন আর অন্তরকে দিয়েছেন উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা, উষ্ণতা, ভালবাসা, আনন্দ, ঈমান ও দৃঢ়তা।
ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই হযরত আলী (রা)’র অনুসারীদের মধ্যেও যে মহত্ত্ব, দয়াশীলতা, বিশ্বস্ততা ও করুণার সঙ্গে ব্যগ্রতা ও উষ্ণতার সুসমাবেশ রয়েছে অন্য কারো অনুসারীদের মধ্যে তা নেই। তাই দেখা যায় সাফাভিদ রাজারা যখন দরবেশদের মধ্য থেকে সুদক্ষ যোদ্ধাদের নিয়ে একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন করেন, তখন সেই বাহিনীর নাম নিজেদের নামে না দিয়ে আলী (রা)’র নামেই তা করেছেন।
দার্শনিকরা ছাত্র তৈরি করেন অনুসারী নয়, সামাজিক নেতারা অনুসারী গড়ে তোলেন কিন্তু পূর্ণাঙ্গ মানুষ নয়, আর কুতুব ও সূফীবাদের শায়খরা অনুপম আনুগত্যের আদর্শবান মানুষ বানান ইসলামের সক্রিয় যোদ্ধা নয়।
হযরত আলী (রা)’র চরিত্রে আমরা দেখতে পাই একজন দার্শনিকের বৈশিষ্ট্য, একজন বিপ্লবী নেতার বৈশিষ্ট্য, একজন সূফী শায়খের বৈশিষ্ট্য এবং নবী-রাসূলদের মধ্যে যেসব বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ থাকে তারও অনেক বৈশিষ্ট্য। হযরত আলী (রা)’র দর্শন হচ্ছে জ্ঞান ও চিন্তার দর্শন, বিপ্লবের দর্শন, আত্মসমর্পণ ও শৃঙ্খলার দর্শন এবং মহত্ত্ব, সৌন্দর্য, পরমানন্দ ও গতিময়তার দর্শন।
ইমাম বা খলিফা হওয়ার আগেও হযরত আলী (রা) সবার সঙ্গে ন্যায়পরায়ণ আচরণ করতেন। হযরত আলী (রা) নিজে একজন সুশৃঙ্খল ও সুসামঞ্জজস্যপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। মনুষ্যত্বের প্রতিটি সদগুণের সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। তাঁর মন ছিল গভীর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং তা ছিল করুণায় ভরপুর ও স্নেহরাশিতে টইটম্বুর। দৈহিক, আধ্যাত্মিক ও মানসিক সব দিক থেকেই তিনি ছিলেন পূর্ণত্বের অধিকারী। রাতে যখন তিনি আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হতেন তখন আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক থাকত না। আবার দিনে ছিলেন জনগণের মাঝে কর্মমুখর। দিনের বেলায় জনগণ তাঁর দয়া ও সততায় মুগ্ধ হতেন আর তাঁর উপদেশ, পরামর্শ ও জ্ঞানপূর্ণ কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। অন্যদিকে রাতে আকাশের তারকারাজি দেখত হযরত আলী (রা) কিভাবে আল্লাহর ইবাদতে অশ্রু বিসর্জন করছেন আর আকাশ তাঁর প্রেমপূর্ণ মোনাজাত শুনত।
হযরত আলী (রা) একাধারে একজন জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ, রহস্যবাদী ব্যক্তি, সমাজের নেতা, আত্মসত্তা বিসর্জনকারী ব্যক্তি, মুজাহিদ, বিচারক, শ্রমিক, একজন বাগ্মী ও লেখক। তাঁর সব আকর্ষণীয় গুণ নিয়ে তিনি ছিলেন পূর্ণতার সব অর্থেই একজন পূর্ণাঙ্গ মানব।
বিশ্বনবী (সা.)’র একটি হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী আলী(রা)-কে পুরোপুরি বা পরিপূর্ণভাবে চেনেন কেবল আল্লাহ ও তাঁর সর্বশেষ রাসূল (সা.) এবং আল্লাহ ও তাঁর সর্বশেষ রাসূল (সা.)-কে ভালভাবে চেনেন কেবল আলী (রা)।
হযরত আলী (আঃ) ছিলেন সেই ব্যক্তিত্ব যার সম্পর্কে রাসূলে পাক (সা বলেছেন, মুসার সাথে হারুনের যে সম্পর্ক তোমার সাথে আমার সেই সম্পর্ক, শুধু পার্থক্য হল হারুন (আঃ) নবী ছিলেন, তুমি নবী নও।
আলী (রা) এমন এক নাম যাঁর নাম উচ্চারণ ও যাঁর বরকতময় জীবনের আলোচনা মানুষের ঈমানকে তাজা করে দেয়। রাসূল (সা.) বলতেন, আলীর দিকে তাকানোও ইবাদত।
হযরত আলী (রা)’র আকাশ-ছোঁয়া বীরত্ব ও মহত্ত্ব কেবল মুসলিম কবি, সাহিত্যিক বা মনীষীদেরই প্রভাবিত করেনি, অমুসলিম পণ্ডিতরাও তার সুবিশাল ব্যক্তিত্বের ব্যাপকতায় অভিভূত ও হতবাক হয়েছেন। তাঁর মহত্ত্ব ও উদারতার প্রশংসা করে আর ডি ওসবোর্ন বলেছেন, আলী (রা) ছিলেন মুসলমানদের ইতিহাসের সর্বোত্তম আত্মার অধিকারী সর্বোত্তম ব্যক্তি।
ওয়াশিংটন আরভিং বলেছেন, “সব ধরনের নীচতা ও কৃত্রিমতা বা মিথ্যার বিরুদ্ধে আলী (রা)’র ছিল মহত সমালোচনা এবং আত্মস্বার্থ-কেন্দ্রিক সব ধরনের কূটচাল থেকে তিনি নিজেকে দূরে রেখেছিলেন।”
ঐতিহাসিক মাসুদির মতে, রাসূল (সা.)’র চরিত্রের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মিল যার ছিল তিনি হলেন আলী (রা)।
আমীরুল মুমিনীন আলী সম্পর্কে মাওলানা রুমী লিখেছেন,
“সাহসিকতায় তুমি ছিলে খোদার সিংহ তা জানি
পৌরুষত্বে আর বদান্যতায় কি তুমি তা জানেন শুধুই অন্তর্যামী।”
আলী (রা) সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (সা বলেছেন-তোমরা যদি আদমের জ্ঞান, নূহের ধার্মিকতা, ইব্রাহিমের অনুরক্তি, মূসার সম্ভ্রম, এবং ঈসার সেবা ও মিতাচার দেখতে চাও, তাহলে আলীর উজ্জ্বল মুখের দিকে তাকাও।
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (রা) ছিলেন ইসলামের ইতিহাসের অতুলনীয় ও শ্রেষ্ঠ বীরযোদ্ধা। আল্লাহর সিংহ বা আসাদুল্লাহ ছিল তাঁর উপাধি। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা’র জীবদ্দশায় প্রায় প্রতিটি যুদ্ধে বিজয়ের তিনিই ছিলেন প্রধান স্থপতি। তাই বলা হয়, হযরত আলী (রা)’র তরবারি জুলফিক্বার ছাড়া ইসলামের কোনো বিজয়ই অর্জিত হতো না। বিশ্বনবী-সা: নিজেই তাঁকে এই দ্বিধারী তরবারী উপহার দিয়েছিলেন। বদর, ওহোদ, খন্দক, খায়বারসহ অনেক যুদ্ধের কিংবদন্তীতুল্য বীর আলী (রা) অনেকবার নিজ জীবন বাজি রেখে রাসূল (সা’র জীবন রক্ষা করেছিলেন। জিহাদের ময়দানে তাঁর উপস্থিতিই শত্রু-সেনার মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতো।
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)ছিলেন মজলুমের বন্ধু, অত্যাচারীর ত্রাস, মহানবী (সা’র জ্ঞান-নগরীর তোরণ, এতীম ও অনাথের সেবক, শ্রেষ্ঠ আবেদ, সাধকদের আদর্শ এবং একইসাথে সৎ-নেতৃত্ব, ন্যায়বিচার ও সুশাসনের প্রতীক। তিনি ছিলেন সর্বযুগের সেরা নারী খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা (সা’র স্বামী।
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)’র মাধ্যমেই রক্ষিত হয়েছে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা’র পবিত্র বংশধারা বা তাঁর পবিত্র আহলে বাইত যাঁদের অনুসরণ ছাড়া মুসলমানদের মুক্তি ও হেদায়েত সম্ভব নয় বলে বিশ্বনবী (সা.) জোর তাগিদ দিয়ে গেছেন। ইমাম আলী (আঃ)ই বেহেশতী যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)’র পিতা। মুসলিম উম্মাহর সর্বশেষ ইমাম তথা উম্মতের ত্রাণকর্তা হযরত ইমাম মাহদী আঃ’ও (মহান আল্লাহ তাঁর পুনরাবির্ভাব ত্বরান্বিত করুন) তাঁরই বংশধর। পবিত্র ইমামগণ ছাড়াও ওলি-আউলিয়ায়ে কেরামের উল্লেখযোগ্য অংশ হযরত আলী (আঃ)’রই বংশধর। অধিকাংশ সূফী তরিকার আধ্যাত্মিক মুর্শিদগণের সিলসিলার শীর্ষে রয়েছেন আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)।
কথিত আছে রাসূলে পাক (সা’র সহধর্মিণী বিবি আয়েশা হযরত আলী (আঃ)’র শাহাদতের খবর শুনে অত্যন্ত শোকার্ত হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, হে রাসূল! তোমার সবচেয়ে প্রিয়পাত্র শাহাদত বরণ করেছেন। ইসলামের ইতিহাসের দ্বিতীয় খলিফা আলী (রা)’র পরামর্শ ও জ্ঞানগত সহযোগিতার কাছে নিজের ঋণ স্বীকার করে বলেছেন,”আলী ইবনে আবি তালিবের মত আরেকজনকে গর্ভে ধারণ ও প্রসব করার ক্ষমতা নারীকুলের কারো নেই। আলী না থাকলে উমর ধ্বংস হয়ে যেত।”
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা বলেছেন, আমি জ্ঞানের নগরী, আর আলী তার দরজা। হযরত আলী (আঃ) নিজেও বলেছেন, পবিত্র কোরআনের এমন কোনো আয়াত নেই যার শানে নজুল, ব্যাখ্যা বা তাৎপর্য সম্পর্কে আমি রাসূল (সা’র সাথে আলোচনা করি নি। পবিত্র কোরআনের তাফসীর, ফেক্বাহ, হাদিস ও কালাম শাস্ত্রসহ ইসলামের এমন কোনো শাস্ত্র নেই যে বিষয়ে তিনি শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন না।
সূক্ষ্ম বুদ্ধি ও কৌশলপূর্ণ নিখুঁত বিচারের জন্য হযরত আলী (আঃ)কে রাসূল (সা’র পর ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক বলা যেতে পারে। হযরত আলী (আঃ)কে আরবী ব্যাকরণের জনকও বলা হয়। কবিতা ও ভাষণসহ তাঁর চিঠিগুলো আরবী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ এবং কালোত্তীর্ণ সম্পদ।
নাহজুল বালাগায় বৈচিত্র্যময় বিষয় দেখা যায়। যখন কেউ নাহজুল বালাগাহ্ পড়ে তখন কখনো মনে করেন সম্ভবত আবু আলী সিনা কথা বলছেন। অন্যস্থানে দৃষ্টিপাত করে মনে করেন মাওলানা রুমী অথবা মহিউদ্দীন আরাবী কথা বলছেন। কোথাও দেখে যে, কবি ফেরদৌসির মতো কথা অথবা কোন স্বাধীনতাকামী যার মাথায় স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কিছুই আসে না এরকম কেউ যেন কথা বলছেন, কখনো লক্ষ্য করে, ঘরের কোণে অথবা মসজিদে বসা কোন আবেদ বা যাহেদ তথা দুনিয়াবিমুখ সাধক ও এবাদতকারী অথবা কোন ধর্মীয় নেতা বক্তব্য রাখছেন। অর্থাৎ বিচিত্রময় বিষয়ে এসব বক্তব্যের কারণে মানুষ সব মূল্যবোধই আলী (রা)-এর মধ্যে দেখতে পায়, কারণ, বক্তব্য ব্যক্তির আত্মার প্রতিফলন।
সাইয়্যেদ রাজী নাহজুল বালাগার ভূমিকায় বলছেন,‘যে বিষয়টি সব সময় বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করি এবং যাতে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হই তা হলো আলী (রা)-এর বক্তব্যগুলোর যে কোন একটিতে প্রবেশ করলে মনে হয় যেন এক বিশ্বে প্রবেশ করেছি। কখনো কোন আবেদের জগতে, কখনো বা যাহেদের জগতে, কখনো দর্শনের জগতে, কখনো আধ্যাত্মিকতার জগতে, কখনো সৈনিক বা সামরিক কর্মকর্তার জগতে, কখনো ন্যায়পরায়ণ বিচারক বা শাসকের বা ধর্মীয় নেতার জগতে। পুরো বিশ্বেই আলী উপস্থিত। মানব বিশ্বের কোন স্থানেই আলী(রা) অনুপস্থিত নন।”
ইবনে আব্বাস রাসূল (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন: আলী আমার উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী এবং বিচারকার্যে সর্বোত্তম।
ইবনে মাসউদও বলেছেন, মহানবী (সা.) আলীকে ডাকলেন ও একান্তে বসলেন। যখন আলী (রা) ফিরে আসলেন,তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম কী আলোচনা করছিলেন? তিনি বললেন: মহানবী (সা.) জ্ঞানের হাজারটি দরজা আমার জন্য উন্মুক্ত করলেন, আর প্রত্যেকটি দরজা থেকে আরো সহস্রটি দরজা খুলে যায়।
একদিন আলী (রা) মিম্বরে বললেন: হে লোকসকল! আমাকে হারানোর আগেই আমার কাছে জিজ্ঞাসা কর। আমার কাছে জেনে নাও কারণ, পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের জ্ঞান আমার কাছে রয়েছে। আল্লাহর শপথ যদি বিচারের দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয় তাহলে ইহুদিদের জন্য তাদের কিতাব থেকে, ইঞ্জিলের অনুসারীদের জন্য তাদের কিতাব থেকে, যাবুরের অনুসারীদের জন্যও তাদের কিতাব থেকে, আর কুরআনের অনুসারীদের জন্য কুরআন থেকে বিচার করব… আল্লাহর শপথ, আমি কুরআন ও তার ব্যাখ্যায় সবার চেয়ে জ্ঞানী।
হযরত আলী (রা) ছিলেন এমন একজন পূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ মানুষ যার মধ্যে সবগুলো মানবিক মূল্যবোধ সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করেছে।যখন রাত্রি নেমে আসে, রাত্রির নিস্তব্ধতা চারিদিক আচ্ছন্ন করে ফেলে তখন কোন সাধক বা আরেফই আলী (রা)-এর পদমর্যাদায় পৌঁছতে পারে না। এমন প্রাণবন্ত ইবাদত যেন স্রষ্টার সাধনায় নিমগ্ন ও পরমাকৃষ্ট, তাঁর দিকে ধাবমান প্রবলভাবে। আবার যখন তিনি অন্য কোন বিষয়ে মশগুল, উদাহরণস্বরূপ যখন তিনি যুদ্ধ ও সংগ্রামে লিপ্ত (যুদ্ধক্ষেত্রে) তরবারির আঘাতে তাঁর দেহ ক্ষত-বিক্ষত, শরীর থেকে মাংস বিচ্ছিন্ন হয়ে এক দিকে পড়ে গেছে, কিন্তু এতটা নিমগ্ন যে,অনুভব করেন নি এক টুকরা মাংস তাঁর দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গভীর মনঃসংযোগের কারণে সে দিকে লক্ষ্যই নেই। আলী(রা) ইবাদতের সময় এতটা উত্তপ্ত ও উদ্বেলিত হয়ে উঠেন যে, আল্লাহর প্রেম ও ভালোবাসায় তাঁর অস্তিত্ব যেন এক প্রজ্বলিত শিখা যার অবস্থান এ পৃথিবীতে নয়। নিজেই এক দল ব্যক্তিকে এভাবে বর্ণনা করেছেন,
‘জ্ঞান তাদের দিকে তার দিব্যতাসহ প্রকৃতরূপে ধাবিত হয়েছে, ইয়াকীনের প্রাণকে তারা কর্মে নিয়োজিত করেছে, যা দুনিয়াদারদের জন্য কঠিন ও অসহ্য তা তাদের কাছে সহজ হয়ে গেছে, জাহেলরা যা থেকে ভীত তারা তার প্রতি আকৃষ্ট, যদিও তারা মানুষের মাঝে শারীরিকভাবে অবস্থান করছেন তা সত্ত্বেও তাদের আত্মা উচ্চতর এক স্থানে সংযুক্ত।’ (নাহজুল বালাগাহ্, হেকমত ১৪৭)
ইবাদতরত অবস্থায় তাঁর শরীর থেকে তীর খুলে ফেলা হয়েছে, অথচ তিনি এমনভাবে আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট ও ইবাদতে নিমগ্ন যে অনুভবও করেননি। ইবাদতের মেহরাবে তিনি এতটা ক্রন্দনশীল যার নজীর কেউ দেখেনি। আবার দিনের বেলায় আলী (রা) যেন ভিন্ন কোন মানুষ। সঙ্গীদের সাথে যখন বসেন তখন হাসি মুখ, খোলা-মেলা তাঁর আচরণ। তাঁর চেহারা সব সময় হাস্যোজ্জ্বল। আলী (রা) এত বেশি মুক্ত মনের ছিলেন যে, আমর ইবনে আস তাঁর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাত যে, আলী খেলাফতের উপযুক্ত নয়। কারণ হাসিমুখ ও মনখোলা মানুষ খেলাফতের জন্য অনুপযোগী।
‘তিনি ইবাদতের মেহরাবে যেমন অত্যন্ত ক্রন্দনশীল তেমনি যুদ্ধের ময়দানে হাস্যোজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত।’
‘নিশ্চয় (ইবাদতের উদ্দেশ্যে) রাত্রিকালের উত্থান আত্মশুদ্ধির জন্য সর্বাধিক কঠিন পন্থা এবং বাক্যালাপে সর্বাধিক দৃঢ়তা দানকারী। নিশ্চয় দিবসে তুমি দীর্ঘ কর্ম ব্যস্ততায় নিমগ্ন থাক।” (সুরা মুজাম্মেল) অর্থাৎ রাতকে ইবাদতের জন্য রাখ আর দিনকে সামাজিক কাজকর্মের জন্য। আলী যেন রাতে এক ব্যক্তিত্ব, আর দিনে অন্য এক ব্যক্তিত্ব।
সহনশীলতা ও ধৈর্যের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন যেমন সর্বোচ্চ পর্যায়ের তেমনি সাহসিকতার ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ পর্যায়ে। রক্তপাতের ক্ষেত্রে যেখানে কোন নিকৃষ্ট ব্যক্তির রক্ত ঝরাতে হবে সেখানে তিনি শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা,আবার ইবাদতের ক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতকারী।
আলী (রা)’র সাহসিকতা, শৌর্য আর সংগ্রামী আত্মার মোকাবিলায় পাথর, শীলা বা ধাতুও গলে যায়। আবার তাঁরই চারিত্রিক কোমলতা মৃদুমন্দ বাতাসকেও লজ্জা দেয়। একই ব্যক্তির মধ্যে ছিল কোমলতা ও কঠোরতার এক অপূর্ব সমন্বয়।
আলী (রা) ছিলেন নিঃস্ব ও সম্পদহীন, অথচ সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। দানশীল ছিলেন বলেই সম্পদ তাঁর হাতে গচ্ছিত থাকত না।
আলী (রা)-ভালবাসতেন খোদাপ্রেমের বেদনা বা আধ্যাত্ম বেদনা। তাঁর প্রার্থনা সম্পর্কীয় বেদনা এবং মোনাজাত এক দিব্য ও আলোকময় সত্য বিষয়। মহান প্রভুর উপাসনায় তিনি যখন মত্ত হতেন যেন নিজেকে ভুলে যেতেন, হারিয়ে যেতেন মহান প্রভুর প্রেমে, ভুলে যেতেন পারিপার্শ্বিকতাকে, এমনকি বিদ্ধ তীর যখন তাঁর দেহ থেকে মুক্ত করা হতো অনুভব করতেন না সামান্য পরিমাণ ব্যথাও।
আর এটাই হলো মানুষের প্রকৃত বেদনা অর্থাৎ মহাসত্যের বিরহ বেদনা; মহান প্রভুর সান্নিধ্য লাভের অভিপ্রায় এবং তাঁর দিকে ধাবিত হওয়া ও তাঁর নৈকট্য লাভ। যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষ তার প্রভুর সত্তায় লীন হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার এ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় বিরতি নেই এবং সব সময়ই এ অবস্থা তার মধ্যে বিরাজ করছে। বেহেশত বা পুরস্কারের লোভে নয়, নরকের ভয়েও নয় বরং আল্লাহর প্রেমে আকুল হয়েই কৃতজ্ঞতম বান্দার মত ইবাদত করতেন তিনি।
আলী (রা)’র ব্যথিত আত্মা প্রশান্ত হত কেবল আল্লাহর স্মরণেই। ‘জেনে রাখ, একমাত্র মহান প্রভুর স্মরণের মাধ্যমেই অন্তরগুলো (উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা থেকে) প্রশান্ত হয়।’ (সূরা রাদ: ২৮) মানুষের এ বেদনা (প্রভুর সান্নিধ্য লাভ) একমাত্র একটি জিনিসের মাধ্যমে বিদূরিত হয়। আর তা হলো মহান প্রভুর স্মরণ ও তাঁর প্রেম। আধ্যাত্মিক সাধকরা এ বেদনার উপরই নির্ভর করেন, অন্যান্য ব্যথাকে তাঁরা খুব একটা গুরুত্ব দেন না।
রাসূলুল্লাহ (সা.) যেমন মানুষের মুক্তির জন্য লালায়িত ছিলেন ও চাইতেন মানুষের সব দুঃখ-কষ্ট দূর করে তাকে মুক্তি দিতে তেমনি আলী (রা)ও ছিলেন প্রকৃত মানব-প্রেমিক ।
বসরায় উসমান বিন হুনাইফ সার্বিকভাবে অভিজাতদের জন্য একটা অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন অর্থাৎ দরিদ্র শ্রেণীর কেউ ঐ অনুষ্ঠানে ছিল না। হজরত আলী (রা)’র কাছে সংবাদ পৌঁছল যে, আপনার প্রতিনিধি ও প্রশাসক এমন এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন যেখানে শুধু ধনিক, বনিক ও পুঁজিপতিরা উপস্থিতি ছিল, অথচ দরিদ্রদের মধ্যে কেউই সেখানে ছিল না। আলী (রা) বললেন,
‘‘আমি বিশ্বাস করতে পরিনি যে, তুমি এমন এক দস্তরখানার দাওয়াত গ্রহণ করেছ যেখানে পুঁজিপতিরা নিমন্ত্রিত হয়েছিল, অথচ দরিদ্ররা নিমন্ত্রিত না হয়ে ঘরের দরজার পেছনে অবস্থান করছিল।’’ এরপর আলী আপন হৃদয়ের ব্যাকুলতাকে প্রকাশ করতে শুরু করলেন এবং এক পর্যায়ে নিজ সম্পর্কে বলেন,
‘‘যদি আমি চাই তবে আমার জন্য ভোগ ও বিলাস সামগ্রীর রয়েছে প্রাচুর্য, সর্বোৎকৃষ্ট খাবার, পানীয়, সর্বোত্তম পরিচ্ছদ; যা চাইব তা-ই আমার জন্য উপস্থিত। কিন্তু দূর হোক আমা হতে এ অবস্থা যে, আমি এমনটি করব। অসম্ভব, আমি আমার লাগামকে কখনই নাফসের চাহিদা ও লোভের কাছে সমর্পণ করব না। যদি এখানে আমি আপন উদর পূর্ণ করি, তবে ইরাক, কুফা,ইয়ামামাহ্ এবং পারস্য উপসাগরের উপকূলে এমন কেউ হয়তো থাকবে যে এক টুকরা রুটির আশাও করতে পারে না। আমি কি আপন উদর পূর্ণ করে ঘুমাব। আর আমার চারিদিকে অসংখ্য ক্ষুধার্ত পেট ও তৃষ্ণার্ত বক্ষ অবস্থান করবে?’’
এই যে সমবেদনা, এটাই হলো সৃষ্টির প্রতি অনুরাগ। একেই বলে মানবতার মানদণ্ড। এরপর আলী (রা) বলেন,
‘‘আমি কি নাম-পদবিতেই পরিতৃপ্ত হব? আমাকে যে সম্বোধন করা হয় : হে আমীরুল মুমিনীন! আমাকে যে খলিফা বলে আখ্যায়িত করা হয় অথবা পৃথিবীর অধিকাংশ এলাকা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাজ্যের অধিপতি বলা হয়, এতেই কি আত্মতুষ্ট হব এবং নিজেকে আমীরে মুমিনীন বলে জানব, অথচ মুমিনগণের কষ্টে অংশীদার হব না?’’ (নাহজুল বালাগাহ্,পত্র নং ৪৫)
আলী (রা)-এর এই কথাগুলো থেকে যে বিষয়টি স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে তা হল- সমবেদনা, অপরের কষ্টকে অনুভব করা। আত্মা যখন বিকাশ লাভ করে তখন তা সব দেহের আত্মা হয়ে যায় এবং অনুভব করে সব দেহের বেদনাকে। এ জন্যই আলী (রা) রাতের আঁধারে নিজেই খাদ্যের বোঝা নিয়ে এবং নিজের পরিচয় গোপন রেখে পৌঁছে দিতেন ইয়াতিম ও অসহায় বিধবাদের ঘরে। যে দেহকে কষ্ট সহ্য করতে হয় তার অবস্থা এমনই হয়। যে দেহের আত্মা সবার, সব মানুষের- তার অবস্থা এমনই হয়ে থাকে।
আসলে আলী (রা) ছিলেন সব ধরণের মানবিক মূল্যবোধের ময়দানে বিজয়ী বীর। মানবতার সবগুলো ময়দানেই তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ তথা আদর্শ ও পরিপূর্ণ মহামানব।
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)’র জীবনীর জ্যোতির্ময় পবিত্র আলোকচ্ছটার একটু ছোঁয়া বর্তমান যুগের বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত মানবতার জন্য হতে পারে মুক্তির দিশা। জালিমের সঙ্গে কঠোর শত্রুতা ও মজলুমের সহায়তা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম প্রধান ভূষণ। ইরাক, ফিলিস্তিন ও আফগানিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মজলুম মানবতা যেন বারে বারে স্মরণ করছে সেই খায়বার জয়ী শেরে খোদা এবং শত্রু বিনাশী তাঁর সেই দ্বিধারী জুলফিক্বারকে, যে জুলফিক্বার ছাড়া ইসলামের বিজয় ছিল অসম্ভব, যাঁর নাম ও স্মরণ আজো শিহরণ জাগায় মুমিন ও মুজাহিদের হৃদয়ে।
আজ এই মহামানবের জন্মদিনে আসুন আমরা সবাই মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা জানাই কায়মনোবাক্যে–
“হে আল্লাহ! আমাদের অন্তরে ইসলামের অনুরাগ সৃষ্টি কর। আমাদের সবাইকে শুভ পরিণতির অধিকারী কর। তোমার (খোদার) প্রেম, পরিচিতি, আনুগত্য ও উপাসনার অনুরাগ আমাদের অন্তরে দান কর। তোমার সৃষ্টির প্রতি সমবেদনা আমাদের মধ্যে সৃষ্টি কর। আলী (রা)’র বেলায়েতের আলোতে আমাদের আলোকিত কর। আমাদেরকে ঐ মহান ব্যক্তির সত্যিকারের অনুসারী কর। আলোকিত কর আমাদের অন্তরগুলোকে ঈমানের আলোয়। পরিচিত কর আমাদেরকে ইসলামের স্বরূপের সাথে।”
সবশেষে হযরত আলী (আঃ)’র কিছু অমর ও অমূল্য বাণী তুলে ধরছিঃ
‘নিশ্চয় আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে অনন্তর বলতে শুনেছি যে, কোন উম্মতই সম্মান ও মর্যাদার পবিত্র স্থানে পৌঁছতে পারবে না যতক্ষণ না তাদের ক্ষমতাশীলদের হাত থেকে দুর্বলদের অধিকার আদায় করবে কোন দ্বিধা ও শঙ্কা ছাড়াই (অর্থাৎ উম্মতের দুর্বলরা ক্ষমতাশীলদের বিরুদ্ধে তাদের অধিকারের জন্য রুখে দাঁড়াবে) ।’ (নাহজুল বালাগাহ্, পত্র নং ৫৩)
‘‘আমি ঐ লোকের ব্যাপারে অবাক হই যে কোন সম্পদ হারিয়ে ফেললে তা পাওয়ার জন্য সর্বক্ষণ ব্যতিব্যস্ত থাকে, অথচ নিজ সত্তাকে হারিয়ে ফেললেও তার সন্ধান করে না।”
“(প্রকৃত) জীবন হচ্ছে মৃত্যুবরণের মাধ্যমে জয়ী হওয়া। আর (প্রকৃত মৃত্যু) হলো বেঁচে থেকেও নিকৃষ্ট ব্যক্তির অধীনে থাকা।”
- জেনে রাখ, নিশ্চয়ই দারিদ্র্য একটি বড় বিপদ এবং দারিদ্র্য হতে মন্দ শারীরিক অসুস্থতা আর শারীরিক অসুস্থতা হতে খারাপ ও কঠিন হলো অন্তরের অসুস্থতা।”
- যে লোভে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে সে নিজেকে অবমূল্যায়ন করে, যে নিজের অভাব অনটনের কথা প্রকাশ করে, সে নিজেকে অপমানিত করে; আর যার জিহ্বা আত্মাকে পরাজিত করে তার আত্মা দূষিত হয়ে পড়ে।
- ঈমান চারটি খুঁটির ওপর স্থাপিতঃ ধৈর্য, দৃঢ় বিশ্বাস, ন্যায়বিচার ও জিহাদ। ধৈর্যের রয়েছে চারটি দিকঃ একাগ্রতা, দোযখের ভয়, দুনিয়া বর্জন ও বাসনা পরিত্যাগ। দৃঢ় বিশ্বাস বা প্রত্যয়ের রয়েছে চারটি দিকঃ বিচক্ষণ উপলব্ধি, বুদ্ধিমত্তা, বোধগম্যতা ও আদর্শ এবং অতীত থেকে শিক্ষা নেয়া।
- মিশরের গভর্নর মালিক আশতারের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি বলেছেন, প্রজা বা দেশের নাগরিকদের নিজের ভাই বলে মনে করবে। যারা অমুসলমান তারা আদম (আঃ)’র বংশধর হিসেবে তোমার ভাই এবং যারা মুসলমান তারা তোমার দীনী ভাই।
- হযরত আলী (আঃ) তাঁরই রাষ্ট্রের ভেতরে একদল কথিত মুসলমানের হাতে লুটপাট ও একজন বিধর্মী মহিলার লাঞ্ছিত হবার খবর শুনে বলেছিলেন: একজন মুসলমান যদি এই ঘটনার দুঃখে মারাও যায়, তা হবে তার জন্য কম তিরস্কার।
- বাহ্যিক অলংকার ও পোশাক-পরিচ্ছদ সৌন্দর্য নয়, সৌন্দর্য হল-জ্ঞান ও সভ্যতা। যার পিতা-মাতা মারা গেছে সে এতীম নয়, প্রকৃত এতীম সে, যার মধ্যে জ্ঞান ও বিবেক নেই।
- “আমি জানি না” বলা যে পরিত্যাগ করে, সে ধ্বংসের মুখোমুখি হয়।
- সত্যকে আঁকড়ে ধর, যদি তাতে তোমার ক্ষতিও হয় এবং মিথ্যাকে বর্জন কর যদি মিথ্যা দিয়ে তোমার লাভও হয়। আর এটাই হল ঈমান।
- তোমার কথা যেন কাজের চেয়ে বেশী না হয় এবং অন্যদের সম্পর্কে কথা বলতে আল্লাহকে ভয় কর।
- কথা দিয়ে মানুষকে চেনা যায়।
- সবচেয়ে নিকৃষ্ট সহচর সে, যার জন্য আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়।
- হে আদম সন্তানগণ, যেদিন এখনও আসে নি সেদিনের জন্য আজকের দিনে উদ্বিগ্ন হয়ো না। কারণ, সে দিনটি যদি তোমার জীবনে আসে, তবে আল্লাহ সে দিনের জীবিকাও তোমার জন্য দান করবেন।
- হিংসা না থাকলে শারীরিক সুস্থতা অর্জিত হয়।
- যে গাছের গুড়ি বা কাণ্ড নরম তার শাখা ঘন হয়। অর্থাৎ উদ্ধত ও বদমেজাজি লোক তার চারপাশের কাউকে খুশী করতে পারে না। অন্যদিকে সুভাষী ও নরম মেজাজের লোকের সান্নিধ্যে এসে অনেকেই তার বন্ধু হয়ে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৬ সকাল ১০:১০