গভীর রাতে রেজাল্ট নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
এইচসসি'র রেজাল্ট। সেকালে কলেজে গিয়ে রেজাল্ট নিয়ে আসতে হয়। ফেরার পথে বাস নষ্ট, ফিরতে ফিরতে গভীর রাত। বন্ধুরা উল্লসিত। আমরা খেয়া নৌকায় নদী পেরুলাম। নদীর ওপারে গাড় অন্ধকারে উৎকণ্ঠিত মা-বাবাদের ভিড়। পাশ করারা সোল্লাসে চেঁচাচ্ছে। মা বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
সেই গাড় অন্ধকার থেকে নামাজের সাদা কাপড় পড়া আশিতিপর বৃদ্ধাটি এগিয়ে এলেন। আমার দাদী। বু। তার হাতে তখনও তজবীহ। তিনি আমার কাছে এসে দুহাতে আমার কোমর জড়িয়ে ধরলেন। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, 'বু, আমি পাশ করছি'। বু সে কথা শুনলেন কি না বোঝা গেল না। তিনি কাঁদছেন। আমি বললাম, 'কন্দেন ক্যান? আমিতো পাশ করছি। ফাস্ট ডিভিশন, তিনখান লেটার'।
বু বললেন, 'তোর আর পড়া লেহা করনের দরকার নাই, দুইখান হালি গরু কিন্যা দিমু, হাল চাষ কইর্যা খাবি'।
আমি বিস্মিত গলায় বললাম, 'এইগুলান কি কন?'
বু বললেন, 'ঠিক কথা কই? হেই বেয়ান বেলা গেছস। আর এহন রাইত বেয়ান হইতে আছে, চিন্তায় চিন্তায় বুক হুগাই গেছে। বুক ধরফর করতে আছে। আল্লারে ডাকতে ডাকতে গলা হুগাই গেছে...'
বু কথা শেষ করতে পারেন না। কান্নার দমকে থেমে যান। আমি বলি, 'পথে গাড়ি নষ্ট হইছিল, আর ঢাকারতন কলেজে রেজাল্ট আইতেও দেরী হইছিল'।
বু বললেন, 'অত কিছু বুঝি না, তোর আর পড়ালেহা করনের দরকার নাই। অত দূরে যাওনেরও কাম নাই। তুই বাড়িতেই থাকবি। গিরিস্তি কাম কাইজ করবি। আমার জমানো টাকা আছে, গরু কিন্যা দিমু। পড়া লেহা কইর্যা জজ ব্যারিস্টার হওনের দরকার নাই। আমার বোগোলে (কাছে) থাকবি, চউক্ষের সামনে সামনে থাকবি... যখন মন চাইব দেখমু... তুই দূরে যাবি না।'
আমি যাই নি, অথচ বু-ই চলে গেছেন। দূরে। না ছোঁয়া দূরত্বের দূরে।