'আই মম্মদপুর, মম্মদপুর... জিগাতলা, শ্যামুলি, মম্মদপুর...'
বৃষ্টি হচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদ এই বৃষ্টিকে বলতেন ঝুম বৃষ্টি। ছেলেটা টেম্পুর হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে 'ঝুম বৃষ্টি'তে ভিজছে। বছর আটেক বয়স। হাঁফ প্যান্ট পড়নে, খালি গা। আমি কোনমতে লাফিয়ে টেম্পুতে উঠলাম। ছেলেটা গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে,'আই মম্মদপুর, মম্মদপুর... জিগাতলা, শ্যামুলি, মম্মদপুর...'
টেম্পুতে যাত্রী আমরা দু'জন। আমি আর এক বৃদ্ধ চাচা। তার গলায় পেঁচানো লম্বা রুমাল। বৃদ্ধ চাচা আয়েশ করে পকেট থেকে পান বের করলেন। আঙুলের ডগায় চুন নিয়ে জিহ্বার লাগাতে লাগাতে বললেন, 'বুঝলা চাচা মিয়া, দ্যাশের কুনু ভবিষ্যৎ নাই, ভবিষ্যৎ থাকবে কেমনে? এই দ্যাশের মানুষ হইছে সব ভোন্দা। ভোন্দাদের দিয়া কিছু হয় না। মাইনসের মইধ্যে টাইম সেন্স নাই, যাগো টাইম সেন্স নাই, তাগো দিয়া কিছু হবে না'।
আমি বললাম, 'জ্বী আংকেল, কথা সত্য'।
আংকেল বসা থেকে যেন লাফ দিয়ে উঠলেন, দ্বিগুণ উৎসাহে বলা শুরু করলেন, 'আধা ঘণ্টা হইলো এই দোজখে বইস্যা আছি, ডেরাইভারের ভাব দেখছ? হুমুন্দির পুতেরে মনে লয় পাছার মইধ্যে কসাইয়া এক লাত্থি লাগাই। গাড়ী ছাড়নের কোন নাম গন্ধ আছে? নাই। এই যদি হয় দ্যাশের অবস্থা! দ্যাশের ভবিষ্যৎ কি, কও? টাইম সেন্সতো থাকতে হবে, তাই না?'
আমি বললাম, 'একজন যাত্রী নিয়া গেলে ওদের তো চলবে না আংকেল, সিট ভরতে হবে, বৃষ্টির মধ্যে লোকজন বাইর হইতে পারতেছে না, তাই টেম্পু খালি, লেট হচ্ছে'।
উনি পিচিক করে মুখভরতি পানের পিক ফেললেন টেম্পুর মেঝেতে। তারপর বললেন, 'আরে রাখো মিয়া, এরা হচ্ছে একেকটা খা***র ছাওয়াল, এদের রাখা উচিত ডলার মইধ্যে, ডলা দিলে সব ঠিক, এই পিচ্চিরে দেখো, ক্যামনে গলার রগ ফুলাইয়া লোক ডাকতেছে, এই বয়সেই শরিলে এই ত্যাজ, আরেকটু বড় অইলে কি অইব, কও? এইহানে সেইহানে মাইনসেরে চাক্কু ঠেকাইব, হিরুইঞ্চি অইব, হিরুইঞ্চি'।
পেছন থেকে বিশাল আকারের এক বাস ক্রমাগত হর্ন দিয়ে যাচ্ছে। উনি সাথে সাথে চেঁচিয়ে বললেন, 'দ্যাখছ শুয়োরের বাচ্চাদের কাণ্ড, দেখছ? এই মাদার*** গুলানের পেছন দিক দিয়া আস্তা টেরাক ঢুকাই দেওনের কাম!'
উনার ভাষার দখলে আমি মোটামুটি চমৎকৃত! ঘাড় ঘুড়িয়ে প্ল্যাস্টিকের পর্দা খানিক ফাঁক করে ঠাণ্ডা বাতাসে নাক ডুবানোর চেষ্টা করছি। এই মুহূর্তে উনি আবারও পিচিক করে পানের পিক ফেললেন মেঝেতে। আমার শরীর গুলিয়ে এলো।
বৃষ্টি খানিক কমেছে। এক দুই করে যাত্রীও উঠছে।
ছেলেটা একনাগাড়ে চেঁচিয়েই যাচ্ছে, ''আই মম্মদপুর, মম্মদপুর... জিগাতলা, শ্যামুলি, মম্মদপুর...' টেম্পু ভরে উঠছে প্রায়। ভেতরে অন্ধকার, কিছুই দেখা যায় না। কেউ একজন কাদা মাখা পায়ে আংকেলের পা মারিয়ে দিয়েছে, আংকেল চিৎকারে আসমান জমিন এক করে ফেললেন, 'চউক্ষে কি ঠাডা পড়ছে না কি আফনের? ঠুলি পড়ছে চউক্ষে?'
লোকটা বিব্রত ভঙ্গিতে চুপচাপ বসে পড়লো সিটে। এখনও একটা সিট ফাঁকা। ড্রাইভার টেম্পু ছাড়ছে না। আয়েশ করে মোবাইল ফোনে সানি লিওনের বেবি ডল দেখছে, টেম্পুর মাঝখানের কাঁচের গ্লাসের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে। আংকেল আবারও চেঁচালেন, 'হুমুন্দির পুতের কাম দেখছেন? ***'
ছেলেটা বৃষ্টিতে ভিজে ঠকঠক করে কাঁপছে। কিন্তু একনাগাড়ে বলেই যাচ্ছে, ''আই মম্মদপুর, মম্মদপুর... জিগাতলা, শ্যামুলি, মম্মদপুর...' যাত্রীদের মধ্যে একজন বলল, 'ওই ছেমড়া, বিস্টিতে ভিজ্যা কি জ্বর লাগাবি নি? আইজ একটা সিট ফাঁকাই যা।'
ছেলেটা দাঁতে দাঁত লাগিয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, 'উস্তাদে মারব, ছয় সিডের ভাড়া না অইলে উস্তাদে পিডাইব...কাইল আর কামে নিবু না!' সে কথা শেষ না করেই আবার গলা ফাটিয়ে চেঁচায়, ''আই মম্মদপুর, মম্মদপুর... জিগাতলা, শ্যামুলি, মম্মদপুর...'
আমরা যাত্রীরা টেম্পুর অন্ধকারে চুপচাপ বসে আছি, বাইরে বৃষ্টি আবার বাড়ছে। ছেলেটা কাঁপছে। মাঝে মাঝে খানিকটা মাথা গলিয়ে দিচ্ছে টেম্পুর ভেতরে। বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচার চেষ্টা। আমরা চরম বিরক্তি নিয়ে বসে আছি! শালার আসলেই এই দেশের কিচ্ছু হবে না, কিচ্ছু হবে না...
বৃদ্ধ চাচা মিয়া আবার খেঁকালেন, খেঁকিয়ে উঠে বললেন, 'হারাম জাদা ডেরাইভারের কাণ্ড দেখছেন! কুড়িডা টেকার লাইগ্যা এই কচি পুলাডারে বিস্টিতে ভিজাইয়া মারতেছে, দ্যাখছেন কাণ্ড?'
আমরাও কাণ্ড দেখছি, চরম বিরক্তি নিয়েই দেখছি, এই ছোটলোকগুলোর কমনসেন্স যে কবে হবে? বুকের মধ্যে মায়া দয়া যে কবে হবে!! খালি টাকা টাকা টাকা! মাত্র কুড়িটা টাকার জন্য এই পিচ্চি ছেলেটার...'
বৃদ্ধ চাচা মিয়া আবারও খেঁকালেন, এবার খেঁকালেন পিচ্চিটাকে লক্ষ্য করে, 'ওই ভোন্দার বাচ্চা, ভোন্দা, এইখানে আয়।'
ছেলেটা অবাক চোখে তাকাল। বৃদ্ধ চাচা বললেন, 'এই মুড়ায় আয়, বিস্টিতে আর ভেজন লাগতো না, এইহানে আইয়া বয়...'
ছেলেটা বলল, 'আরেকজন অহনও অয় নাই'
চাচা বললেন, 'তোর আরেকজনের গুল্লি মারি, আয় এমনে'।
ছেলেটা ভীত চোখে বলল, 'টেকা কম অইলে উস্তাদে পিটাইব, কাইলতন আরে কামে নিবু না'।
বৃদ্ধ চাচা বললেন, 'আরে হারামজাদা আইতে কইছি, আয়, তোর কুড়ি টেকার মায়রে বাপ, উই কুড়ি টেকা আমি দিমু, তুই এমনে আয়'।
ছেলেটা চোখভর্তি অবিশ্বাস নিয়ে চাচার পাশে গিয়ে বসলো, সে ঠকঠক করে কাঁপছে। চাচা তার গলার রুমাল খুলে ছেলেটার মাথা মোছাতে মোছাতে বললেন, ' তোর গায়েরতন তো ভোম্বলের মতন গন্ধ বাইর অইতাছে, গোসল মোসল করস না কয় বছর?'
ছেলেটা এই প্রশ্নের জবাব দিল না। সে বড় বড় চোখ করে তার মাথা মুছিয়ে দেয়া লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে, তাকিয়ে আছি আমরাও। ওই মানুষটা কেবল তাকিয়ে নেই। তিনি তার কাজ করছেন। ছেলেটার মাথা মুছিয়ে এখন ঘাড়ে নেমে এসেছেন। দ্রুত হাতে ঘাড় মুছছেন।
আমরা তাকিয়ে আছি।
আসলে, আমরা তাকিয়েই থাকি...
---------------------------------------------------------
নো ম্যান'স ল্যান্ড/সাদাত হোসাইন
২৭/০৫/২০১৪