somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

সাদাত হোসাইন
লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবি

মৃত্যুর সহজ উপায়

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৯:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মৃত্যুর সবচেয়ে সহজ উপায় কি?

সুমনের সামনে সম্ভাব্য উপায় আছে ৩ টি। এক, ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়া। দুই, ছাদে উঠে লাফিয়ে নিচে পড়া। তিন, তার রুমে একটা চাকু আছে, সেটা দিয়ে নিজের কণ্ঠনালী কেটে ফেলা।
সমস্যা হচ্ছে, এই তিনটি উপায়ের সবগুলোই যথেষ্ট কষ্টসাপেক্ষ এবং এই মুহূর্তে অসম্ভব!

প্রথমটি সম্ভব না, কারণ রুমে এই মুহূর্তে এমন সরু লম্বা কিছু নেই যেটি ফ্যানের সাথে ফাঁস এর মতো করে ঝুলানো যায়, তারওপর এই বিল্ডিঙের সিলিং অনেক উঁচুতে, ফলে ফ্যানও। সেই ফ্যানের সাথে কিছু ঝুলিয়ে তার নাগাল পাওয়া, কিংবা টুল বা টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে ফাঁস এ মাথা গলানো অসম্ভব!

দ্বিতীয় উপায়টিও এই মুহূর্তে সম্ভব না। এখন বাজে রাত তিনটা। এতো রাতে সে চাইলেই ছাদে যেতে পারবে না। ছাদের চাবি থাকে বাড়িওয়ালার কাছে। সেই চাবি নিতে হলে বিশেষ অনুমতি দরকার, বলাবাহল্য, এই মুহূর্তে সেই অনুমতি সে পাবে না।

তিন নম্বর বিষয়টা নিয়ে সুমন আর ভাবলই না। অত সাহস তার নেই। সে ভীরু। সুইসাইড করতে হলে সাহস লাগে। তার ধারণা সেই সাহস তার নেই বলেই সে বাকী উপায়গুলোর বিপক্ষেও নানান অজুহাত খুঁজছে! আসলে তার সাহস নেই, সে মৃত্যুকে ভয় পায়, মৃত্যু যন্ত্রনাকেও!

এই পর্যায়ের এসে সুমন শক্ত হয়ে গেলো! নাহ, সে আর কোন যন্ত্রণাকে ভয় পায় না। কোন যন্ত্রণাকে না। সে যেই কষ্টের ভেতর আছে, পৃথিবীতে এর চেয়ে বেশি কষ্ট আর থাকতে পারে না। কখনও না। সে শেষ বারের মত তিথি'র ফোনে ফোন দিল, ফোনের ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠ ভেসে এলো, 'দিস মোবাইল ক্যান নট বি রিচ অ্যাট দিস মোমেন্ট, প্লিজ ট্রাই এগেইন লেটার'।

সুমন ডায়াল লিস্টের পরের নাম্বারটিতে বাটন চাপল। এই নাম্বারটি সে কেবল গতকাল পেয়েছে। এই নাম্বারটিও তিথির। সুমন শুনে প্রথম বিশ্বাস করেনি যে এই নাম্বারটি তিথি গত চার মাস ধরে ইউজ করে। সেদিন রাতুল যখন বলল, সুমন প্রায় তেড়ে গিয়েছিলো রাতুলকে, 'ইম্পসিবল রাতুল, ইম্পসিবল, এনিবডি ক্যান বি রঙ, ক্যান বিট্রে, ক্যান প্রিটেনড উইথ এনিথিং, ক্যান মেক এভ্রিথিং রঙ ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড, এনিবডি। বাট তিথি? সিমপ্লি ইম্পসিবল।' পৃথিবীটা উল্টে যেতে পারে, সূর্য কাল সকালে পশ্চিম দিক থেকে উঠতে পারে, কিন্তু তিথি? অসম্ভব!

সে তিথিকে গত ৭ বছর থেকে চেনে। তারচেয়ে বেশি আর কে চেনে তিথিকে? মেয়েটা নিজের স্কুলের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে তাকে ফোন দিত, সেই ক্লাস নাইন, টেন। তারপর কলেজ, তারপর ইউনিভার্সিটি। হাতের নখ বড় দেখলে চুপচাপ ব্যাগের ভেতর নেইল কাটার গুঁজে দিয়ে এসএমএস করে দিত ফোনে, 'দেয়ার ইজ অনলি টু ইউজেজ অফ এ নেইল কাটার, ওয়ান ইজ ফর কাটিং ফিঙ্গারস, অ্যান্ড এনাদার ইজ ফর কাটিং নেইলস। হুইচ ওয়ান উইল ইউ চুজ?'

সুমন মেসেজ দেখে হাসত, তারপর লিখত, 'ইফ দেয়ার ইজ এনি ফিঙ্গারস, দেন দেয়ার উইল মাস্ট বি সাম নেইলস, সো লং লিভ ফিঙ্গারস'।

তিথি কিন্তু পরদিন ঠিক ঠিক তার নখ দেখত। দেখে গম্ভীর মুখে বলতো, 'আমার চকচকে ফর্সা নখ পছন্দ, তুমি নখের উপরিভাগগুলো ঠিক মতো ঘষো নাই কেন?'

তিথিকে তখন লাগতো কিন্ডারগার্টেন স্কুলের রাশভারী রাগী মিসে'র মত। সুমনের হাসি পেত, কিন্তু সে জানে হাসির কি বিপদ। সে এক চোখ টিপে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিত, 'ওকে, ডান, আজ গিয়ে করে ফেলব। কিন্তু সব কথা যে শুনব, তার একটা চার্জ আছে না? চার্জটা হয়ে যাক এক্ষুনি?'

তিথি রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে খটাশ করে চুমু খেয়ে দিয়েছিল সুমনের ঠোঁটে। তারপর পাল্টা চোখে চোখ টিপে বলেছিল, 'এডভান্স পেইড, ওকে ডান'।

সেই তিথি হঠাৎ বদলে যাচ্ছিল। গত মাস ছয়েক ধরেই। সুমন বুঝতে পারছিল, কোথাও কিছু একটা আগের মতো নেই। কিন্তু তিথি নানান বাহানায় এড়িয়ে যেত। শরীর খারাপ, বাবা অসুস্থ, বাসায় নানান ঝামেলা, পরীক্ষার প্রেসার। সুমনের কষ্ট হত। আগের মতো দেখা হয় না, ফোনে কথা হয় না। কিন্তু সে মেনে নিত। সে জানত, সব ঠিক হয়ে যাবে। তিথি কোন কারণে হয়তো আপসেট। কিন্তু এটা ঠিক হয়ে যাবে। সুমন বিশ্বাস করতো, তিথির কেবল খানিক সময় দরকার।

সুমনের বিশ্বাস এবং জানাটা যে ভুল, সেটা সুমনের আজ সন্ধ্যা অবধি বিশ্বাস হয় নি। মোটেই না। মানুষ বলে অবিশ্বাস বড় ভয়ংকর জিনিস, সুমনের মনে হচ্ছে উল্টোটা, বরং বিশ্বাসই সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর, মানুষকে অন্ধ করে দেয়। শ্রেফ অন্ধ। না হলে সে কিভাবে বুঝল না, তিথি অন্য একটা সম্পর্কে জড়িয়েছে। বাসার সমস্যার কথা বলে তিথি বেশিরভাগ সময় ফোন অফ করে রাখার কথা বলে আসলে অন্য এক নাম্বার ইউজ করে !! এমনকি, আজ ওরা চুপিচুপি কাজী অফিস থেকে বিয়ে অবধি করে ফেলেছে! তারপর যার যার বাসায়! কিভাবে সম্ভব? সুমনের পুরো জগত অন্ধকার লাগে। মাথা কাজ করে না। সে জানে না, সে কিভাবে বাচবে! কিভাবে!! এই কষ্ট অসহ্য! এতো কষ্ট! এতো কষ্ট!! এতো কষ্ট সে কিভাবে বইবে। সে পারবে না। অসম্ভব! সে তিথির কাছে ফোন করে কাঁদবে। প্রয়োজনে পায়ে ধরবে। প্রয়োজনে তিথির সামনে বসে গায়ে আগুন ধরিয়ে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সে তিথিকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না।

এক মুহূর্ত না। এক মুহূর্ত না।

সুমন তিথির নতুন নাম্বারটায় ডায়াল করে, ইউজার বিজি, সে আবার ডায়াল করে, ইউজার বিজি, ইউজার বিজি। সুমনের সারা শরীর থরথর করে কাঁপে। চোখভর্তি উদ্ভ্রান্ত শুন্য দৃষ্টি। খ্যাপাটে। সে পাগলের মত ডায়াল করতে থাকে। কিন্তু সেই ফোন তিথির ফোনে ঢোকে না। সুমন উন্মত্ত পাগলের মত মোবাইল ফোনটা আছড়ে ফেলে দেয়ালে। টুকরো গুলো ছিটকে পরে এখানে সেখানে। সে মেঝেতে বসে ঝরঝর করে কাঁদে। দু হাতে চুলের গোছা ধরে টানে। পৌষের ভয়ংকর হিমেও ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর। মাথার ভেতর প্রচণ্ড যন্ত্রণা। আর স্মৃতি। অজস্র স্মৃতি। সুমন এই স্মৃতিগুলো থেকে নিস্তার চায়। এই স্মৃতিগুলো থেকে। সে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে দেয়ালের সাথে মাথা ঘসে। কি করবে সে? কি করবে? সে পারবে না তিথিকে ছাড়া বাঁচতে। অসম্ভব! এই পৃথিবীতে তিথি ছাড়া আর কিচ্ছু নেই তার। কিচ্ছু না। শুন্য এক শ্মশান যেন, খাঁ খাঁ মরুভূমি। এখানে তিথিকে ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব! অসম্ভব! কিন্তু কিভাবে মরবে সে? কোন উপায়তো নেই।

সুমন ফ্যানের দিকে তাকায়, তার চোখে শীতল দৃষ্টি। সেই দৃষ্টি জুড়ে ঘোর, আবছায়া, বিভ্রান্তি। সেই দৃষ্টি জুড়ে মৃত্যু। তারপরও সেই দৃষ্টি জুড়ে শুন্যতা, শুন্যতা! সুমন হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, তারপর টেনে নেয় বিছানার চাদর, ছুড়ে দেয় উঁচু সিলিঙে ঝোলানো ফ্যানের দিকে। কিন্তু এভাবে হবে না। অতো উঁচুতে সে উঠতে পারবে না! তাহলে উপায়?

আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম... পাশের মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসছে। সুমন তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়। সে উপায় খুঁজে পেয়েছে। সে মসজিদে যাওয়ার নাম করে চাইলেই দারোয়ানের কাছ থেকে চাবি নিয়ে বের হয়ে যেতে পারে। এবং? হ্যা, আর মিনিট কুড়ির মধ্যেই রাতের ট্রেনটা যাবে বাসার পাশের লাইন দিয়ে!

সুমন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, 'এটা অনেক সহজ, কিছু টের পাওয়ার আগেই সব শেষ, সব, সব!'

২।

বাইরে কুয়াশা পড়েছে। সেই কুয়াশার ভেতর দিয়ে শুভ্র পাঞ্জাবী আর টুপি পড়া মানুষগুলো শান্ত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে মসজিদে। দৃশ্যটা কেমন অদ্ভুত লাগে সুমনের! কিন্তু তার মাথার ভেতর প্রবল ঘোর। সেই ঘোর তাকে দ্রুতপায়ে টেনে নিয়ে যায় রেল লাইনের দিকে। সেখানে আরাধ্য মৃত্যু।
প্রবল শীতে পায়ের পাতা অসাড় মনে হয় সুমনের। সে দ্রুত পায়ে ছোটে। রেল লাইনের এই দিকটা ঝোপঝাড়ে ঢাকা। মানুষজন নেই। সুমন সেই ঝোপের ভেতর ঢুকে যায়। ট্রেন আসতে কত দেরি? তার এখন আর কান্না পায় না। ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত প্রতিশোধ কাজ করে, 'কাল তার মৃত্যুর খবর শুনে কি করবে তিথি? নিশ্চয়ই কাঁদবে? নিজেকে প্রচণ্ড অপরাধী ভাববে, খুনি ভাববে নিজেকে, তারা বাকীটা জীবন কাটবে সুমনকে ভেবে ভেবে!

নিজেকে সারাজীবনে আর কখনও ক্ষমা করতে পারবে না সে!

সুমনের বুকের ভেতরটা হঠাৎ প্রবল অভিমানে ফুলে ওঠে, সে অন্ধকার আকশের শুন্য গভীরে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে 'হ্যা, এইবার তুমি বুঝবা, আমি তোমার কি ছিলাম! কি ছিলাম! কাকে তুমি হারাইছ! এইবার বুঝবা! সারাজীবন কাদবা, সারাজীবন।'

তার কান্নায় কি না কে জানে, পৌষের কুয়াশার আকাশ থেকে অদ্ভুতভাবে বৃষ্টি ঝড়ে। প্রথমে ফোঁটা ফোঁটা। তারপর আরও বড়। দ্রুত। অবাক করার মত বিষয়। কিন্তু আজকাল এমন হয়। আবহাওয়া কেমন অদ্ভুত আচরণ করে। জলবায়ু বদলে যাচ্ছে ক্রমশই। সুমনের অবশ্য এই নিয়ে কোন ভাবনা নেই। এই মুহূর্তে মৃত্যু নিয়ে তার ভেতর আর কোন ভয় কাজ করে না। সংশয় কাজ করে না। বরং মনে হয়, তিথির সারাজীবনের উপলদ্ধির জন্য, প্রায়শ্চিত্যের জন্য, ভালোবাসাটুকু বোঝানোর জন্য তার মৃত্যুটা খুব জরুরী। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো একেকটা যেন বরফের টুকরো, হাড়ের ভেতর কাঁপিয়ে দিচ্ছে। সুমন সেই রেললাইনের পাশে বসেই থাকে, মৃত্যুর অপেক্ষায়। প্রতিশোধের অপেক্ষায়। কিন্তু ট্রেন আসছে না কেন?

এই সময় গোঙানিটা কানে আসে সুমনের! সে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায়। তার বা পাশে হাত দশেক দূরে ক'খানা বস্তি মতন ঘর। এই ঘরগুলো সে আগে কখনও দেখে নি, নিশ্চয়ই নতুন হয়েছে। অনেক দিন এদিকে আসে না সে। অন্ধকারে এতক্ষণ দেখতেই পায় নি। সুমন কি মনে করে হেঁটে যায় গোঙানির শব্দের দিকে। আবছা আলোয় সে দেখে, জীর্ণ প্রায় বস্তি ঘরখানা। তিন দিকে প্ল্যাস্টিকের বেড়া দিয়ে ঘেরা। বাকি একদিক প্রায় ফাঁকা। উপরের প্ল্যাতিকের পলিথিন সরে গিয়ে ঝরঝর করে বৃষ্টি ঝরছে ঘরের ভেতর। সেখানে ছেড়া চটের বস্তার ভেতর উবু হয়ে বসে আছেন রোগা এক মহিলা। হাপরের মতন কাঁপছে তার শীর্ণ শরীর। তার হাত দুখান সেই শীর্ণ বুকের উপর শক্ত করে ভাঁজ করে রাখা। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সেই শীর্ণ পিঠের ওপর আছড়ে পড়ছে। মানুষটা প্রচণ্ড শীতে থরথর করে কাঁপছে। চোখের সামনে বীভৎস এক দৃশ্য। সুমনের হঠাৎ কি হল, কে জানে, সে গিয়ে মহিলার পাশে বসলো, তারপর ডাকল, 'এই যে, শোনেন, শোনেন'।

মহিলা শুনল না। সেই শীর্ণ হাত দু'খানা বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে থরথর করে কাঁপছে। সুমন হঠাৎ মহিলার পিঠে আলতো হাত রাখল, তারপর ডাকল, 'এই যে শোনেন'।

মহিলা ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকাল। তার গালের অংশটা ছুঁয়ে গেল সুমনের হাত। সুমন চমকে উঠলো, ভয়াবহ জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সুমন তার কপালে হাত রাখল, সে জানে না, এতখানি তাপ একটা মানুষের শরীরে কিভাবে সম্ভব! মহিলাটা হঠাৎ হড়হড় করে বমি করে দিল। শরীরটা বার দুয়েক প্রচণ্ড খিঁচুনি হল। তারপর সারা শরীর কেঁপে কেঁপে কেমন শিথিল হয়ে এলো। কিন্তু একটা কাপড়ে পেঁচানো তার শীর্ণ হাত দুখানা বুকের সাথে তখনও শক্ত করে জাপটে ধরা। সুমন হঠাৎ আবিষ্কার করল, সেই হাতের ভেতর একটা প্রাণ! একটা ফুটফুটে ছোট্ট শিশু। মায়ের উষ্ণ বুকের ভেতর কি নিশ্চিন্তে সে ঘুমুচ্ছে!

কি নির্ভার! কি নিশ্চিন্ত!! কি প্রশান্ত!!!

সুমন খানিক তাকিয়ে রইলো। তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো, 'মা!'

পুবাকাশে তখন ভোরের আলো ফুটছে। কাছেই কোথাও ট্রেনের তীব্র সাইরেনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। বৃষ্টিটাও ধরে এসেছে প্রায়। সুমন তার গায়ের জ্যাকেটটা খুলে মহিলার শরীর ঢেকে দিল। তার এখুনি বাসায় ফিরতে হবে, মা নিশ্চয়ই এতক্ষনে তাকে খুঁজছে। সে দরজা হাট করে খোলা রেখেই চলে এসেছে। বাসায় গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে সে। অনেকক্ষণ কাঁদবে!

সুমনের হঠাৎ মনে হল, এই যে সে, এই যে তার শরীর, তার পুরোটা তিলে তিলে ওই মা নিজের শরীরের ভেতর দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধারণ করেছে। ঠিক এই শিশুটির মত, এই শীর্ণ মায়ের মতোই, কত ঝড় ঝঞ্ঝায় নিজের শরীর পেতে দিয়ে সেই ছোট্ট সুমনকে বুকের ভেতর আগলে রেখেছে! আর বাবা? কতরাত সে বিছানা ভিজিয়ে দিয়েছে, বাবা তখন সেই ভিজে অংশে শুয়ে তাকে তার পাহাড় সমান বুকের উপর ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন। সুমনের কেমন কান্না পেতে থাকে। অনেক কান্না। বুকের ভেতর উথলে ওঠা ওলটপালট কান্না। সে কাঁদে! সেই কান্নায় বুকের ভেতর জমে থাকা গতরাতের সেই কষ্টগুলোকে দুঃস্বপ্ন মনে হয়। মনে হয়, কান্নার জলের সাথে দুঃস্বপ্নগুলো গলে গলে বের হয়ে যাচ্ছে।

সে মা আর বাবাকে নিয়ে এখানে ফিরে আসবে। আজ এই আরেক মা তাকে তার নিজের মায়ের কাছে কি অদ্ভুতভাবেই না ফিরিয়ে দিল!

ঝনঝন শব্দে ট্রেনটা সুমনের সামনে দিয়ে ছুটে যায়। ট্রেনের জানালায় দেখা যায় কত কত নির্ঘুম ক্লান্ত মুখ। কিন্তু আজ এই অদ্ভুত ভোরের আলোয় সেই মুখগুলোকেও কি যে ভালো লাগে সুমনের! মনে হয়, এই জীবনটা তার অচেনা ছিল, এই পৃথিবীটাও। এখানে সে আসলে আসল ভালবাসাটাই টের পায় নি এতোদিন। ছুঁয়ে দেখে নি। দেখতেও চায় নি। কি এক প্রহেলিকার পেছনে ছুটেছে সর্বহারা হয়ে। মৃত্যু হয়তো তাই অত কাছে ছিল!

সুমন রেল লাইনের উপর দিয়ে ছোটে। যেখানে তার মৃত্যু লেখা ছিল, সে যেন সেখানে জীবনের পদচিহ্ন এঁকে দেয়। তার মাথার উপর যে ভোরের আকাশ, সে আকাশ যেন অদ্ভুত মায়াময় চোখ মেলে চায়। এ এক অন্য আলোর পৃথিবী।

সে এই আলোর সবটুকু ছুঁতে চায়। ছুঁতে চায় জীবনের সবটুকু...
৭টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×