আমার মাদকাসক্ত জীবন-৭( ট্যাবলেট, ইঞ্জেকশন)
(এই লেখাটিকে কেউ মাদকাসক্তির পক্ষে দাঁড় করাবেন না অনুগ্রহ করে)
ভুলেই বসেছিলাম যে, একবার কী যেন কী ভেবে ট্যাবলেট খাওয়া শুরু করেছিলাম। ইনোকটিন ছিল সেটা। তখন মগবাজারে থাকতাম। ট্যাবলেট খেলে কিন্তু বিষণœতা গ্রাস করে। কোনো ফূর্তি থাকে না মনে। ২ টা করে খেতাম আর চা। শরীর অবসন্ন হয়ে পড়তে চাইত। চা আর সিগারেট জাগিয়ে রাখত। এই জাগিয়ে রাখাটার ফলে শরীরের সাথে মনের যে দ্বন্দ্ব, সেটাই নেশা। কষ্টকল্পনা করে দুঃখবোধ তৈরি করি। জীবনানন্দ দাশ তখন খুব পড়ি। যে জীবন দোয়েলের, ফড়িং-এর তার সাথে হয় না তো দেখা মানুষের এরকম সব লাইন খুব হন্ট করতো? অর্থ নয়, কীর্তি নয়, আরো এক বিপন্ন বিস্ময় মানুষের অন্তর্গত রক্তের মধ্যে খেলা করে... এইসব পড়তে পড়তে জীবনটাকে নেতিবাচক ভাবতে শুরু করলাম। জীবনানন্দ দাশ আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি। আজো তাকে নিয়মিত পাঠ করি। এমন সর্বগ্রাসী কবি পৃথিবীতে দুটো জন্মেছে কিনা সন্দেহ। ভুল ইন্টারপ্রিটশনের কারণে সে আপনাকে জীবনের খাদের কিনারে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। ভয়ঙ্কর ক্ষমতা। যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ, মরিবার হলো স্বাধ...। বাপরে বাপ। অথচ এই চরম রোমান্টিক মানুষটি নাকি দেখতে মোটেই রোমান্টিক ছিলেন না, এমনকি কথাবার্তায়ও। আসলে ভেতরে ভেতরে লালন করে গেছেন সবকিছু। ঐ যে ট্রাম দুর্ঘটনা। সেটাও এর ফল বলে আমার মনে হয়। যাই হোক, ট্যাবলেটের পরিমাণ বাড়ছে। ২,৪,৬ করে। একদিন কী হলো এলিফ্যান্ট রোড থেকে রিক্সায় ফিরছি। তখন এসব ওয়ান ওয়ে টু ওয়ে ছিল না। পেছন থেকে একটা রিক্সা দিল ঢুসা। যেমনটি এখনো দেয়। ধুপ করে সামনে জড় বস্তুর মতো গড়িয়ে পড়লাম। উঠে যে দাঁড়াবো সেই শক্তি নেই। রিক্সাঅলা মধ্যবয়সী। সে আমাকে একহাত দিয়েই উঁচু করে ফেলল। খুব লজ্জা পেলাম। সামান্য এক রিক্সাঅলার মতো শারিরীক সক্ষমতাও আমাদের নেই? খুব ভাবালো আমাকে। বাসায় ফিরে ঘুম। টানা ১৬ ঘন্টার মতো ঘুমালাম। ওঠার পর বোনের গালিগালাজ। যাই হোক, একটানা চিন্তা করতে পারতাম না। একটা ধুম্রজাল তৈরি হতো সবসময়। কনটিনিউটি থাকত না। ভাবলাম, দুর ছাই। এভাবে কি হয়? একটাও কবিতা লিখতে পারি না, ভাবতে পারি না। এ নেশা বাদ।
মরফিন বা প্যাথেড্রিন-এর নেশা করেছি মোটেই দুদিন। সব বন্ধুরাই এ নেশার স্বাদ নিয়েছে। কেউ কেউ করছেও। আমি ভাবলাম, আমি বাদ যাবো কেন? একদিন বিকেলে প্যাথেড্রিন আনা হলো দু এম্পুল। ৫ জন বসলাম এক নিমার্ণাধীন ভবনের ভেতর। এম্পুল ভেঙে সিরিঞ্জ দিয়ে সামান্য ঔষধ টেনে একে একে পুস করে চলছে অভিজ্ঞ বন্ধুটি। আর আমি ভাবছি আমার মা’র কথা। বাসায় সবসময় ২/৩টা মরফিন বা প্যাথেড্রিন থাকত। সন্তান হারানোর পর থেকে না খেয়ে না খেয়ে মার পিত্তাশয়টা শুকিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ করেই ব্যথা উঠত। তখন চিৎকার, কান্নাকাটি। সারা বাড়িটাতে একটা অস্থির অবস্থা। মাকে তখন মরফিন বা প্যাথেড্রিন দেয়া হতো। তখন তিনি আর চিৎকার করতেন না বটে তবে ঘুমিয়ে পড়তেন না। কতটা যন্ত্রণা থাকলে পুরো একটা এম্পুল ইনজেক্ট করার পরও একটা মানুষ ঘুমায় না, ভাবতে পারেন। যাই হোক, আমার পালা এলে আমাকে পুস করা হলো। মুহূর্তেই মধ্যেই মুখের ভেতরটা গোলাপজলের ঘ্রাণে ভরে গেল। অসংখ্য প্রজাপতি নাচতে শুরু করল। সে এক অসম্ভব সুন্দর অনুভূতি। স্বর্গের বর্ণনা পড়তে পড়তে যেভাবে আমাদের অনুভূতিগুলো নাড়া দেয় সে-রকম অনুভূতি। বুদ হয়ে পড়ে থাকলাম। নড়াচড়ার শক্তি নেই। কতক্ষণ ছিলাম মনে নেই। রাত গভীর হয়ে এলে একটা রিক্সায় উঠে কোনোক্রমে বাড়ি ফিরেছিলাম। তবে এ নেশাটা আমার মনঃপুত হলো না। কেননা এটা নিলে নড়াচড়া করার শক্তি থাকে না, শুধু নিজের সাথে নিজের শেয়ার। আমি তো নড়াচড়া করতে চাই, গল্প করতে চাই, প্রগলভতা এসে যেন আমার ভেতরের সমস্ত কথাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় বাতাসে, সে রকম চাই। ফলে আর নেশাটা চালু রাখেনি। অনেকবছর পরে আরো একবার নিয়েছিলাম, একই অনুভূতি। তবে নেশার মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী মনে হয়েছে এটাকেই। সমগ্রটা গ্রাস করার ক্ষমতা রাখে।
অনেক হলো নেশা নিয়ে কথা বলা। এবার থামতে চাই। আগামী পর্বেই শেষ করতে চাই এই প্যাচালি। আপনাদের সবার এতএত ভালোবাসা, শুভেচ্ছা পেয়ে ক’দিন ধরে ভাবছি, আহ যদি এসবকে মুঠোবন্দি বা বাক্স বন্দি করে রাখা যেত। তারপর কোনো এক মাদকাসক্তের কাছে গিয়ে খুলে ধরতে পারতাম। বলতাম দেখ চোখ মেলে, তোমার ফিরবার অপেক্ষায় দেখ কত মানুষ তোমার জন্য শুভেচ্ছার ডালি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কতজন তোমাকে বুকে আগলে ধরবার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে, কতজন তোমাকে ভালোবাসবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে...।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ দুপুর ২:১৮