আমার মাদকাসক্ত জীবন-৬( মদ পর্ব)
(এই লেখাটিকে কেউ মাদকাসক্তির পক্ষে দাঁড় করাবেন না অনুগ্রহ করে)
গাঁজা খেতে খেতেই মনে আছে ক্লাস এইটে বৃত্তি পাওয়া উপলক্ষে বন্ধুরা ধরল যে, খাওয়াতে হবে। কি আর করা। মার টাকা চুরি করলাম। মা ছিলো আমার ভুলো-মনা। কোথায় কোথায় যে টাকা রাখত আর ভুলে যেত। আমাকে বলত, একটু খুঁজে দে। আমি বালিশের কভার, শাড়ির ভাঁজ, চাদরের ভাঁজ, বিছানার নীচ থেকে টাকা বের করে দিতাম। দিতাম মানে চার ভাগের এক ভাগ। বাকীটা আমার। আবার বাবা হাট থেকে ধান বিক্রি করে অনেক টাকা এনে আমাকে বলতো, গোন তো। ১০,৫০,১০০,৫০০ টাকার নোট থাকত সেগুলো। গুনতে গুনতে একটা ৫০০, দুইটা ১০০ এভাবে সরিয়ে ফেলতাম। বলতাম, কই মিলছে না তো! বাবা আশ্চর্য হতেন। আমার এই সুন্দর মুখখানিতে পাপের চিহ্ন খুঁজতেন। পেতেন কিনা কে জানে? বাবা মারা গেছেন। বহুদিন ভেবেছি জিজ্ঞাসা করি, বাবা তুমি কি জানতে তোমার ছেলে কতটা খারাপ ছিল ? জানা হয় নি কিছুই। যখন তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দাঁড়াল তখনই তিনি হুট করে মারা গেলেন। হা! কপাল। তো, সেই চুরি করা টাকা দিয়ে এক সন্ধ্যায় আরেক পাড়ায় পিকনিক আয়োজন করা হলো। রাত গভীর হলে, এক বন্ধু বলল, মাল খাবি। গাঁজা খেয়ে বুঁদ হয়ে আছি, এখন আবার কি মাল। মেয়েমানুষ-টানুষ নাকি ? সে বলল, মদ। সেই প্রথম খেলাম। গলাটা জ্বলে গেল। গোলাপি রঙের ছিল মদটি। শরীর দিয়ে ঘাম ছুটতে শুরু করল কিছুক্ষণ পর। কেমন যেন টলছি। সিনেমাতে যে-রকম মদ-খাওয়া দেখায়, শারিরীক অসঙগতি দেখায়, ওরকমই দেখা দিতে শুরু করল। একসময় গড়গড় করে বমি করলাম। শরীর নেতিয়ে আসল। শুয়ে থাকলাম, সবুজ ঘাসের উপর। উদ্দাম গান বেজে চলছে, ওরে সালেকা, ওরে মালেকা...। আজম খান আমাদের গুরু। সব গাঁজাখোরদের গুরু ছিলেন তিনি। তাঁর গান না শুনলে নেশাই জমতো না। আর ছিল গুলাম আলী, মেহেদী হাসান, পঙ্কজ উদাস, মান্না দে। বুঁদ হয়ে শুনতাম। জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই, শেখ ইসতিয়াকে একটা গানের কথা খুব মনে পড়ে, একদিন ঘুম ভেঙে দেখি, সুখের সমুদ্র শুকিয়ে গেছে...তো, নেশা কাটলে সাহায্যকারী হিসাবে এক বন্ধুকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। সেই প্রথম মদ খাওয়া তারপর মাঝে মাঝে, উৎসবে খাওয়া হতো। কিন্তু পাড়ার এক বন্ধু যে গাঁজা খেত না। সে একদিন বলল, আরে কী যে পাস গাঁজার মধ্যে? মদ খা। মজা পাবি। কিন্তু মদের তো অনেক খরচ? বলতেই সে বলল, দুর, ওটা নিয়ে ভাবিস না, আমি খাওয়াবো। আমার সাথে খাবি। পরে বুঝেছি, আসলে সে-সময় তার সঙ্গ দরকার ছিল। সবাই তো গাঁজাখোর। সে শুধু একেলা। যাই হোক, সন্ধ্যা হলেই আমি তার সাথে হয় মদের দোকানে না হয় কোনো হোটেলে বসে মদ গিলতাম। লেখাপড়া উচ্ছন্নে যেতে শুরু করেছে ততদিনে। বাবা জিজ্ঞাসা করলে বলতাম, বন্ধুর বাড়িতে পড়তে যাই। আসলে ক্লাস নাইনে ওঠার পর যেদিন আমি সায়েন্স নিলাম সেদিন থেকে বাবা আর আমাকে পড়াতে পারতেন না। ইলেকটিভ ম্যাথ, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি নিয়ে বসে থাকতাম বাবা পড়াতে আসলেই। বলতাম, খুব জরুরি পড়া তৈরি করছি। বাবা দুঃখ করে পরে বলতেন, যেদিন পর্যন্ত তোকে পড়াতাম সেদিন পর্যন্ত তুই মানুষ ছিলি, তারপর থেকে তুই অমানুষ হয়ে গেছিস। সত্য কথা বাবা। আমি আসলেই অমানুষ হয়ে গেছিলাম। নইলে কৈশোরের প্রেমিকাকে কেউ ত্যাগ করে, তোমাদের মতো মা-বাবাকে ফাঁকি দেয়? সন্ধ্যা হলেই আমার রক্তের ভেতরে যেন কুকুর ডেকে উঠত- নেশার জন্য। ছুটতাম, সব কিছু ছুড়ে ফেলে। এই করতে করতে বেড়ে উঠছি। লেখাপড়া শেষ করে চাকুরি করছি। সব নেশাকে বিদায় করতে পারলেও মদের নেশা আমাকে ছাড়ছে না। এক ঈদের রাতে কয়েক বন্ধু ধরল, আজ মদে মদে সয়লাব হবো? আমি না করি কিভাবে? তিন বোতল মদ আনলাম। বসলাম মাঠের মধ্যে। খাচ্ছি তা খাচ্ছিই। সিপ এ সিপ অফ লাইফ। একসময় মাঠের মধ্যে দৌড়াচ্ছি। কেউ কেউ ততক্ষণে জামা কাপড় খুলে ফেলেছে। আমিও অর্ধ নগ্ন। একসময় বমি শুরু হলো। বমি একটা মড়কের মতো। একজনের শুরু হলো অন্যজনও সংক্রামিত হয়ে পড়ে। সবাই চিৎ হয়ে পড়ে আছি মাঠের মধ্যে। শীতের শুরুর দিক ছিল সেটা। একসময় ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি। এক চুল নড়বার ক্ষমতা নেই। কি যে কষ্ট। মৃত্যুর দিকে তিলে তিলে এগিয়ে যাচ্ছি। কেউ নেই উদ্ধারের। বেহুশ সবাই। কে যেন একজন দেখে ফেলে আমাদের এই মৃত্যুদশা। সে এসে ম্যাচ জ্বালিয়ে আমাদের মুখ দেখে চিনতে চেষ্টা করে। শুধু বুঝছি ঘোলা ঘোলা স্বপ্নের মতো ঘোরে। একসময় দেখি চ্যাংদোলা করে আমাদের ভ্যানে ওঠানো হলো। চলছি তো চলছি। একটা ঘর। কিছু মানুষের কোলাহল। আমার নাম ধরে ডাকছে, বন্ধুদের নাম ধরে ডাকছে। সাড়া দিতে পারছি না। চেতনার কোন অতলে চলে যাচ্ছি। ঝাপসা ঝাপসা সে-সব মুখ। যখন জেগে উঠলাম, পাশ ফিরে দেখলাম এক বন্ধুর মেসে। শরীর তখনো স্বাভাবিক নয়। কোনোরকমে টেনে তুলে অন্যবন্ধুদের খুঁজলাম। দেখলাম জড়াজড়ি করে সবাই ঘুমিয়ে আছে ঐ ন্যাংটো অবস্থাতেই। হায় মদ।
জীবনে নতুন প্রেমিকার আবির্ভাব হয়েছে। চুটিয়ে প্রেম করছি, টিএসসি, বাংলা একাডেমী, পলাশী, চারুকলা, শাহবাগ,সংসদভবন চত্তর। যদিও জানি, তাকে পাবো না আমি! ( এটা একধরনের নেশাজাত ব্যাপার। সব নেশাখোররাই মনে করে তাদের মাঝে কিছু অতিপ্রাকৃত ব্যাপার আছে। আগে থেকেই তারা অনেককিছু বুঝতে পারে। এ নিয়ে পরে বলা যাবে) এ সত্য ততদিনে জানা হয়ে গেছে, সমস্ত পাপের ফল এ জীবনেই বইতে হবে। জানি, কৈশোরের সেই প্রেমিকার বেদনা শতগুন আমাকে পোড়াবে। হলোও তাই। আমি তার হাতে হাত রেখে ঘুরছি, কপালে চুমু খাচ্ছি, বৃষ্টিতে ভিজছি। কিন্তু কোথায় যেন ছন্দপতন। শেষে জানলাম আমার নিয়তি- তার পুরাতন প্রেমিকের আগমন। মদ তখন হয়ে উঠল আমার অবলম্বন। অফিস থেকে ঘরে ফিরেই দরজা বন্ধ করে চলে আমার মদ পর্ব। ক্ষয়ে যাচ্ছি, ধ্বংসের কিনারে চলে যাচ্ছি। কেউ জানে না। জানে শুধু সে। মাঝে মাঝে এসে সান্ত্বনা দেয়। আমাকে নিয়ে ঘোরে, লং ড্রাইভে যাই। যেমন আগে আদর, সোহাগ করত ঠিক তেমনি করে। আমি বুঝি, এটা অপরাধবোধ। কিছুই বলি না তাকে, কোনো অভিযোগ, অনুযোগ। একদিন ঘুম থেকে উঠেই বমি করলাম। তারপর থেকে চলতে থাকল, বমি পর্ব। যাই খাই, বমি হয়। কাউকে কিছুই বলি না। সে বুঝে যায়। আমাকে জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাঃ মবিন খান সব কিছু পরীক্ষার পর ফল ঘোষণা করেন, লিভারটা বড় নাজুক হয়ে গেছে। ৩বার জন্ডিসের ইতিহাস, তার সাথে মদ। টোটালি নিষেধ। নইলে মৃত্যু অনিবার্য। প্রেমিকার চোখে জল। সে শুধু কাঁদে। বলে, আমি কি করব বল? এতবছর পর সে আবার ফিরে আসবে? কে জানত? আমার জন্যই তোর এই দশা। আমাকে ক্ষমা কর। আমি শুধু হাসি। সে হাসি বড়ই কষ্টের। বলি, ভাবিস না। আমি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠব, দেখে নিস। তুই শুধু বদলাস না। যেমন ভালোবাসতিস, তেমনি বাসিস। শুরু হলো যুদ্ধ। মদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। খাটের নীচ থেকে একদিন সব খালি বোতল বের করে বিক্রি করে দিলাম। কাজের বুয়ার চোখ কপালে, ভাইজান এতদিন এই কইরাই শরীরটা শেষ করছেন। তাইতো ভাবি, আফায়ে (প্রেমিকা) ক্যান কান্দে? সব ছাইড়া দেন ভাইজান। আমিও বলি, হ্যাঁ, সব শেষ! আবারো মেতে উঠি নতুন সৃষ্টির আনন্দে- আমার লেখালেখি, ছবি আঁকা নিয়ে। ব্যস্ত সময় যায়। কখনো নেশার জন্য মনটা ছটফট করলে মনকে বলি, এ তোর আগের জন্মের শাস্তি! (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ দুপুর ২:১৬