আমার মাদকাসক্ত জীবন-৫( হিরোইন পর্ব)
(এই লেখাটিকে কেউ মাদকাসক্তির পক্ষে দাঁড় করাবেন না অনুগ্রহ করে)
হিরোইন ব্যাপারটাই না কত অদ্ভুত। সিনেমার, যাত্রার, নাটকের নায়িকাদের আমরা আহ্লাদে হিরোইন বলে ডাকতাম। সেই হিরোইন কিনা নেশা হয়ে গেল। মানুষ থেকে বস্তুতে। সাদা, ব্রাউন সাধারণত এইরকমই পাওয়া যায়। সাদাটার দাম অত্যধিক চড়া, যারা নেশা করে তারা ব্রাউনটাই খায়। খায় তো না টানে। আমার অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী (বর্তমানে) এক বন্ধুর মারফৎ পেলাম সেই দর্শনযোগ্য জিনিসটা প্রথম। নানান ক্যারিক্যাচা খেতে গেলে। সিগারেটের প্যাকেট সুন্দর করে কেঁচি দিয়ে লম্বা লম্বা করে কাটো, প্যাকেটের ভেতরের রাংতা সর্তকভাবে আলাদা করো, মোমবাতি জোগাড় করো, আধুলি নেও। হ্যাপার শেষ নাই। প্রথম প্রথম তো মহা বিরক্ত লাগত। কিন্তু নেশাটা ভালোই ছিল। রক্তের মধ্যে কেমন যেন বায়বীয় ব্যাপারস্যাপার ঘটত। উড়ে উড়ে চলার মতো। ফুরফুরে একটা অনুভূতি। নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে, চোখের তারায় রঙ জমেছে। হায় রে নেশা। মিরপুর কাজীপাড়া থাকি। তখন রোকেয়া স্মরণীতে আমরা ক্রিকেট খেলতাম। রাস্তায় গাড়ি এত কম থাকত যে, অনায়াশে ক্রিকেট খেলা যায়। আজকের কঠিন হরতালে যেরকম গাড়ি চলে তার চাইতেও কম। আসলে মাজার রোডটাই তখন ব্যবহার হতো। ১০ নম্বর গোল চক্করের পর সব শুনশান। একদিন পাড়ার এক বড়ভাই আমাদের ধরে নিয়ে গেল বিচার-শালিশ করাতে। মনে আছে একটা বাঁশের সাঁেকা ছিল। সেই সাঁকো পার হতে গিয়ে ধপাস। কচুরিপানা এত ঘন ছিল যে, ঢুবে যাই নি। সকলে ধরাধরি করে তুলল। ওপারে গিয়ে বিচার করলাম। কিছুই না। এক বুড়া বেটা যোয়ান এক মেয়েকে (বউ) তালাক দিবে। কারণ তার চরিত্র খারাপ। আমরা তো দিলাম ঝাড়ি। বুড়া বেটা মিনমিন করতে করতে রাজি। পরে জানলাম যে, ঐ বড়ভাই মেয়েটির কাছে যায়। মিরপুর তখন গ্রামই বলা যায়। ৮৬,৮৭ সালে কেউ ওদিক মাড়াতো না। শিক্ষিত লোকের সংখ্যাও কম ছিল। আমরা ক’বন্ধুই তাদের কাছে মহাপন্ডিত। বাপরে বাপ ভার্সিটিতে পড়ে। যাই হোক, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে কথাটা একশতভাগ সত্য। আমার বন্ধুরা নেশা আর মেয়েমানুষ নিয়ে পড়ে থাকতে শুরু করল। আমি নিজেরে দোষে প্রত্যহ হতেছি আলাদা। আমি বলি, নেশা করবি ঠিক আছে কিন্তু এসব মেয়েমানুষ-টানুষ কেন? শুরু হলো গন্ডোগোল। কোথায় যেন একটা নৈতিকতা আমাকে টেনে রেখেছিল আগাগোড়া। আমি ভাবতাম, আমি খারাপ ঠিক আছে কিন্তু অন্যকে কেন আমি নষ্ট করতে যাবো। যে কষ্ট, যে বেদনা তা তো আমার একার। অন্যকে পোড়াতে যাবো কেন? বন্ধুরা মানল না। আমি আবার ঢাকা ছাড়লাম। একসময় চিঠির পর চিঠি। তুই ফিরে আয়। ক্ষমা করে দে। যা হওয়ার হয়েছে। এইসব। ফিরলাম। তখন চোরশ, গাঁজা, হিরোইন যে যার খুশি খাচ্ছে। একটা মহামারী, মড়ক। এরই মাঝে একদিন নওগাঁ থেকে ৫০০ গ্রাম হিরোইন নিয়ে এলো এক বন্ধু। বিক্রি করবে। তখন মিরপুর ১০ এ বিরাট এক বস্তি ছিল। মতিন, ভুঁড়িঅলা এক ব্যাটা হিরোইনের ব্যবসা করত। তার কাছে গিয়ে ১০০ গ্রাম বিক্রি করলাম ৩৫০০ টাকায়। সেই টাকা নিয়ে ভরপুর বিরানি খেলাম। রুমে ফিরে হিরোইন। হঠাৎ কি হলো, বমি করলাম। ভাবলাম পেটে গ্যাস হয়েছে। পরদিন থেকে যেই হিরোইন খেতে যাই দু টান দিলেই বমি আসে। পানির মতো একটা কিছু বের হয়। মহা ঠেলা। আমি তো আনন্দের জন্য নেশা করি। আমার কোনো দুঃখবোধ নেই, কোনো অশান্তি নেই, কোনো উচ্চাভিলাষ নেই। শ্রেফ আনন্দ। কিন্তু সেই আনন্দই যদি ঠিক মতো করতে না পারি তবে কেন নেশা করা। বন্ধুদের দেখতাম তাদের অবর্ননীয় কষ্ট। নেশা কেটে যাচ্ছে ঘুমের মধ্যে। হাত পা কুঁকড়ে আসছে, কুকুরের মতো গুটিসুটি হয়ে যাচ্ছে, সারা শরীর চুলকাচ্ছে, রক্ত বের হয়ে যাচ্ছে, তারপর কাঁপাতে কাঁপতে ধড়মড় করে উঠে বলছে, দোস্ত রেডি কর। নেশা ফাইটা গেল। আমি সেইসব দেখছি আর ভাবছি। আমার সে-সব উপসর্গ না হওয়ার পেছনের কারণ অবশ্য কোনো নেশাতেই থিতু না হওয়া। কোনোদিন হিরোইন খাচ্ছি, তো কোনোদিন শুক্রাবাদ থেকে ডাইন এনে খাচ্ছি, আবার কেউ ধরল চল আজ মদ খাই, তো মদ খাচ্ছি। বন্ধু ছিল প্রচুর। আর সকলে কেন যেন আমাকে পছন্দ করত। বিভিন্ন সার্কেলে আমি মিশতে পারতাম। সেটা সাহিত্য নিয়ে, খেলা নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে যে বিষয়ই হোক না কেন? আমি সাবলিলভাবে ঢুকে যেতে পারতাম। তো, ভাবলাম এই যদি হিরোইনের নেশা হয় তবে থাক। আমার অন্যকিছুই ভালো। তারা যখন হিরোইন খেত আমি বাইরে চলে যেতাম। বলতাম আমার শুকনাতে পোষায় না, ভিজা দরকার। বাঙলা মদ খেতাম ১১ নম্বর গিয়ে। আর মদারুদের দেখতে আমার ভালোই লাগত। কত দিল খোলা। একদিন সেই আসরেই এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে পরিচয়। সে মূলত গাঁজাখোর। মাঝে মাঝে মদ খায়। এভাবে দেখা হতে হতে তাকে বড়ভাই ডাকা শুরু করলাম। তার আমন্ত্রণে একদিন শাহ আলী (রঃ) মাজারে গেলাম। মূল মাজার থেকে পৃথক এক আসর। নারী, পুরুষ গাঁজা টানছে। আমি তো হতবাক। সব নিম্নআয়ের মানুষ, পতিতাও আছে মনে হলো। আসলে সব পতিত মানুষ। রাত ১২টার পর শুরু হলো, ঢোলের বাদ্য, গান আর নাচ। উহ্ কি ভয়াবহ চিত্র। একজন ‘বাবা’ কে তারা হাঁটু মুড়ে সেজদাহ করছে। আমাকে সেই বড়ভাই বলল, সেজদাহ করেন। আমি হাসলাম। করজোড়ে সেই প্রায় ন্যাংটা মানুষটার আগাপাশতলা দেখলাম। পরে তো বড়ভাই মহা ক্ষ্যাপা, নারে ভাই তোমারে এখানে আনা ঠিক হয় নাই। তুমি কামেল চেন না? আমি বললাম, ন্যাংটা মানুষ কামেল হয় কেমনে? তিনি বললেন, তুমি অন্তরটা দেখলা না। আমি বললাম দেখেন, আমি নেশাখোর ঠিক আছে। আমার কাছে কামেল আর কুকুর একই। যারে ভালো লাগবো, তারেই গলা জড়ায়া ধরুম। নেশা কাটলে না ভেদ-বিচার? তিনি আর কোনো কথা বললেন না। তবুও বন্ধুদের জোরাজুরিতে মাঝে মাঝে হিরোইন খাই। মজা পাই না। আর সবচেয়ে বড় যে কথা তা হলো, হিরোইন আমাকে পরিচালিত করতে চায়। কিন্তু আমি চাই আমি যেভাবে চাইব সেভাবেই পরিচালিত হোক আমার মন, শরীর। দ্বন্দ্বটা শুরু হলো। আমি বলি, এখন আমি পড়ব, সে বলে, তুই এখন ঝিম মেরে পড়ে থাক। কোনো ভালো গান দু তিন লাইনের বেশি শুনতে পারি না। বাকি লাইনগুলো হারিয়ে যায়। আমি ভাবি, এই জোছনা রাতে লেকের পাড়ে হাঁটি। আমার পা কাঁপে, হাঁটতে পারি না। এই দ্বন্দ্বেই নেশাটা ছেড়ে দিলাম। আর তখন বিশাল বিশাল ফিচার প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল, বিচিত্রায়, বিভিন্ন পত্রিকায়। হিরোইনের সর্বনাশা কাহিনী নিয়ে। পারমানেন্টভাবে মদ ধরলাম। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ দুপুর ২:১৫