আমার মাদকাসক্ত জীবন-৩(ফেনসিডিল পর্ব)
(এই লেখাটিকে কেউ মাদকাসক্তির পক্ষে দাঁড় করাবেন না অনুগ্রহ করে)
গাঁজা তো বাদ দিলাম। কিন্তু খাবোটা কি? যাদের সাথে নিত্য ওঠাবসা তারা নেশা ছাড়া কিছু বোঝে না। আমার কিছু বন্ধু গাঁজার পাশাপাশি ডাইল-ও খেতো। তো তাদেরই প্ররোচনায় একদিন ডাইল ধরলাম। তখন ৪০/৫০ টাকা বোতল। এক বোতল ২জন ভাগ করে খেতাম। বর্ডার এলাকায় বাড়ি। চাইলেই ডাইল পাওয়া যায়। নেশাটাও ভালো লাগল। চা খাও, আর সিগারেট খাও। বেশ ফুরফুরে লাগে। কাজে কর্মেও জোস পাই। রাত জেগে জেগে পড়ি, অংক কষি, গান শুনি। বাড়ির সবাই ভাবল, যাক ছেলের মতি ফিরেছে। কিন্তু হায় ক’দিন যেতে না যেতেই আবার উৎপাত। ওটা ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগে না। পড়তে গেলেও মন বসে না। শুধু উড়–উড়– করে। কি করলে যে শান্তি পাবো, তাও জানি না। সারা রাত জেগে থাকি, ঘরের মধ্যে খুটুর খাটুর করি, বাবা ক্ষেপে যান। কি করিস, রাত জেগে? আমি বলি, পড়ি। পড়িস তো শব্দ হয় কেন?
মা রক্ষা করে, অতক্ষণ কি টেবিল চেয়ারে পড়া যায়, একটু শোয়, একটু পড়ে। আমি কিছু বলি না। এসএসসি পরীক্ষা হলো। ৫টাতে লেটার মার্কস পেয়ে পাশ করলাম। সবাই খুব খুশি। মা বাবাকে বলল, দেখ তুমি যে ওকে শুধু গালমন্দ করতে, না পড়লে কি এরকম রেজাল্ট কেউ করে। বাবা চুপ থাকেন। আমার দিকে আড়ে আড়ে তাকান, বুঝতে চেষ্টা করেন। পাড়াতেই সরকারী কলেজ, ভর্তি হলাম। কলেজে গিয়ে শুধু তাস পিটানো, আর মেয়েদের সাথে মাখামাখির চেষ্টা সকলের। আমি শুধু ব্যতিক্রম। প্রেমের নাম বেদনা জানিয়ে চলে গেছে আমার প্রেমিকা। কাউকে আর ভালো লাগে না। ডাইল খাওয়া চলছে। কলেজের পাশেই একটা নার্সারি ছিল। আমরা বলতাম বাগানবাড়ি। একটা মাচা ছিল। সেখানেই বসে তাস, গাঁজা, ডাইল যে যার খুশি তাই করত। কলেজ জীবন মানেই হচ্ছে স্বাধীন। স্কুলে থাকতে মাসের ২০ দিন স্কুল পালাতাম। তবে ক্লাস নাইন, টেনে উঠে প্রথম বাংলা ক্লাসটা মিস করতাম না। যিনি বাংলা পড়াতেন সেই আইন স্যার-এর ক্লাস এত ভালো লাগত যে ওটা মিস করলে মনটা খারাপ হয়ে যেত। তিনি কখনো বই হাতে নিতেন না। গল্প করতে করতে পড়াতেন। অসাধারণ ছিল তার পাঠদান পদ্ধতি। তিনি বাংলাভাষা, সাহিত্যটাকে এমনভাবে মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে, জীবনে আর কোনোদিন নোটবইয়ের দ্বারস্থ হতে হয় নি। বাংলার প্রতি ভালোবাসা তাঁরই অবদান। জানি না, আজ তিনি বেঁচে আছেন কিনা? আপনাকে হাজার সালাম, স্যার। তো, কলেজে এসে পেলাম কবীর স্যারকে, উনিও বাংলা সাহিত্য পড়ান। তিনিও অসাধারণ। এই দুই শিক্ষকই আমার ভালো জীবনটার অনেকখানি নির্মাণ করেছেন। যাই হোক, সেই মাচায় তাস পিটাতাম, হোটেল থেকে খাবার আসত সেখানেই। যা কিছু করতাম সব ওখানে বসেই। অদ্ভুত মায়াময় ছিল সেই বাগানটা। কত স্মৃতি। আজো অম্লান।
বই পড়ার নেশা ছিল ছোটবেলা থেকেই। যুদ্ধের সময় এক প্রাচীন লাইব্রেরীর লাইব্রেরিয়ান সমস্ত ভালো ভালো গ্রন্থ আমাদের বাসায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। যদি পাকিস্থানীরা পুড়িয়ে দেয়। তিনি হিন্দু ছিলেন। যুদ্ধ শেষে তাঁকে আর পাওয়া গেল না। আমাদের সংগী হয়ে গেল বইগুলো। বোনেরা পড়ত, বাবা পড়ত। তাদের দেখে দেখে আমিও পড়ি। দয়স্তভস্কি, চেখভ, টলস্টয়, গোর্কি, পুশকিন, মার্কস, লেলিন কত কি। আমি না বুঝেই পড়ি। পাশাপাশি পড়া চলে ঠাকুর মা ঝুলি, আরব্য রজনী। একদিন এক বন্ধু এনে দিল, দস্যু বনহুর। পড়ে তো ব্যাপক মজা পেলাম। তারপর থেকে, বনহুর, দস্যু পাঞ্জা, কুয়াশা, দস্যু মোহন, মাসুদরানা, ওয়ের্স্টান পড়া চলতে থাকল। কখনো হাতে কোনো নতুন বই না থাকলে বাধ্য হয়ে রবীন্দ্রনাথ, শরৎ, আশুতোষ, বিমলকর, নিমাই, নীহার রঞ্জন এদের লেখা পড়তে হতো। তো নেশা করলেও হাতে একটা গল্পের বই থাকত। আমার সঙ্গি গল্পের নর-নারী, তাদের সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা। বন্ধুরা একারণে আমাকে কখনো কখনো ক্ষ্যাপাতো, পন্ডিত বলে। নেশার সাথে এসবের যায় ভালো। চরিত্রগুলোকে আমি মাথায় নিয়ে ঘুরতাম।
একদিন হঠাৎ করে আমাদের এক বন্ধু মারা গেল। কোনো অসুখ নেই, দিব্যি ভালো মানুষটা মারা গেল। জানা গেল, ওর লিভার সিরোসিস হয়েছিল। তখনো বুঝিনি, অসুখটা কি। শুধু জানলাম, ডাইল খেয়েই ও মারা গেল। একটা ভয় ঢুকে গেল। নাহ্, ডাইল রেগুলার খাওয়া যাবে না। বিকল্প বের করতে হবে। তখন কলেজে কেউ কেউ চোরশ খাওয়া শুরু করেছে। অনেকটা গাঁজার মতোই নেশা। শুরু হলো, চরোশ খাওয়া। (চলবে)
প্রথম পর্ব
View this link
দ্বিতীয় পর্ব
View this link
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ দুপুর ১২:৩৪