আমার মাদকাসক্ত জীবন-২( গঞ্জিকা পর্ব)
(এই লেখাটিকে কেউ মাদকাসক্তির পক্ষে দাঁড় করাবেন না অনুগ্রহ করে, কেননা জীবনের একটা পর্যায়ে আমরা কেউ না কেউ এর ভয়াবহতার মুখোমুখি দাঁড়াই। বরং ঐ জীবন থেকে পাওয়া খারাপ দিকগুলোকে তুলে ধরা এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায়ই- এ লেখার মূল উদ্দেশ্য। সমগ্র রচনাটি কয়েকটি পর্ব ভাগ করা হবে, যেমন, সিগারেট পর্ব, গঞ্জিকা পর্ব, মদ পর্ব, চোরশ পর্ব, ফেনসিডিল পর্ব, হিরোইন পর্ব ও সর্বশেষ সুস্থ জীবন )
গত পর্বে বলেছিলাম যে, পাড়ার বড় ভাইদের সাথে সিনেমা দেখা আর সিগারেট টানার কথা। তো সেই করতে করতে ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় এক বন্ধু বলল, চল আজ নতুন একটা জিনিস খাওয়াবো। কি জিনিস? জিজ্ঞাসা করতেই বলল, গাঁজা। আমি বললাম, না বাবা আমি পারব না। সে আমাকে চৌদ্দ গুষ্টি তুলে গালিগালাজ করল, আমার পৌরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলল। আমি শেষে বললাম, ঠিক আছে, চল। নওগাঁ তখন গাঁজার জন্য বিখ্যাত। তখনও পুরোদমে উৎপাদন হয় গাঁজা। এরশাদ এসে ঠিক মনে নেই ৮৪ সালের দিকে মনে হয় গাঁজা চাষ বন্ধ করে দেয়। যাই হোক, মনে আছে পাড়ার আরো সব বড়রা মিলে গাঁজার কল্কে সাজাচ্ছে একটা ভাঙা স্কুলের ভেতরে। একটা ছোট কাঠের উপর কাটারি দিয়ে গাঁজা কাটছে, একজন হাতের তালুতে গাঁজা ডলছে, আরেকজন নারিকেলের ছোবা ছিড়ছে। এলাহী কান্ড। আমি তো এতসব দেখে হতবাক। সবশেষে কল্কেতে গাঁজা সাজানো হলো। সবাই গোল হয়ে বসে। হাতে হাতে ঘুরছে কল্কে। একসময় আমার টানার পালা। আমি কিছুতেই টানতে পারছি না। সবাই হাসাহাসি করছে। শেষে একজন কিভাবে কল্কে ধরতে হয় শিখিয়ে দিল। আমি কোনো রকমে একটা টান দিয়ে বেদম কাশতে শুরু করলাম। চোখ দিয়ে পানি গড়াতে শুরু করল। মনে হলো বুকটা ফেটে যাচ্ছে। সবকিছু অন্ধকার দেখছি। ঠাস করে গড়ে পড়ে গেলাম। সবাই হাসাহাসি করছে। কিছুক্ষণ ওভাবেই পড়ে থাকার পর অন্য সবার সাথে স্থান ত্যাগ করলাম। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ভাবছি, বাড়ি ফিরতে পারব তো। আব্বা যদি বুঝে যায়? কত দোয়া দরুদ পড়েছি তার ইয়ত্তা নেই। চোরের মত বাড়ি ফিরে টিউবঅলে ভাল করে মুখ-হাত-পা ধুয়ে ঘরে ঢুকলাম। মাটির দিকে চোখ। মাথা সোজা করতে পারছি না ভয়ে। সেদিন সন্ধ্যায় গ্রামের বাড়ি থেকে ৪/৫জন আসলো। আব্বা আম্মা তাদের নিয়ে ব্যস্ত। আমি বেঁচে গেলাম সে-যাত্রা। পরদিন থেকে আবার শুরু। বন্ধুদের কিছুতেই বোঝাতে পারি না যে গাঁজা আমার ভালো লাগে না। মজা পাই না। এই করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম। গাঁজা নিয়ে কত যে স্মৃতি আছে বলে শেষ করার নয়। তখন সকাল, দুপুর, বিকেল, রাতে গাঁজা টানতাম। গাঁজা খেলে আত্মবিশ্বাসের বড় অভাব দেখা দেয়। ধরেন, একটা ছোট ড্রেনও পার হতে ভয় ভয় লাগে। আমরা বাজি ধরতাম, একলাফে পার হতে পারবি ড্রেন? পারবি না তুই। এভাবে ক্ষেপিয়ে দিতাম একজনকে। একসময় সে ঠিকই লাফ দিত আর ড্রেনের ভেতর গিয়ে পড়ত। মনে আছে একবার গ্রামে গেলাম কয়েক বন্ধু মিলে। বর্ষার সময়। বাড়ির পাশেই বিল। ঠিক হলো, বিলের ভেতর গিয়ে গাঁজা খাবো। একটা নৌকা জোগায় করলাম। কেউই নৌকা চালাতে পারি না। লগি, বৈঠা নিয়ে রওনা দিলাম। বৈঠা একদিকে মারলে অন্যদিকে নৌকা ঘূরে যায়। একসময় লগিও তল পায় না। এভাবে কোনোভাবে ডাঙ্গা থেকে অনেক দূরে আসলাম। তারপর গাঁজা বানাতে বসে বাতাসের অত্যাচার। বারবার গাঁজার আগুন নিভে যায়। বহু কষ্টে গাঁজা খাওয়া শেষে সবাই তখন টাল- উদ্দাম বাতাসে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ফিরতে হবে। কিন্তু এতটাই নেশা ধরে গেছে যে নৌকা কিছুতেই আর সামনে এগোয় না। শুধু ঘোরে। এভাবে চক্কর খেতে খেতে একসময় পাড়ে ভিড়লাম। দেখি লন্ঠন হাতে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপার কি? জানলাম যে, সবাই ভেবেছে আমরা বিলের ভেতর হারিয়ে গেছি। এভাবে এভাবেই চলছে গাঁজা টানা। ৮৯/৯০ সালের দিকে এরশাদ বিরোধি আন্দোলন তুঙ্গে। আমিও ছাত্র রাজনীতি করি। ঢাকা, নওগাঁ করছি। মিছিল করছি, পেট্রোল বোমা ছুড়ছি, রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছি, পুলিশের পিটুনি খাচ্ছি। গাঁজা খাওয়াও চলছে। যেদিন আর গাঁজা খাবো না বলে শপথ নিলাম, সেদিনের কথা বলি, এক কুরবানী ঈদ। আমি আর এক বন্ধু রিক্সায় করে যাচ্ছি। হঠাৎ করে এক বন্ধুর সাথে দেখা। সে চিৎকার করে রিক্সা থামালো। কোলাকুলি করলাম। তারপর সে ফিসফিসিয়ে বলল, মামা আমেরিকা থেকে গাঁজা এনেছে, খাবি? আমরা তো উল্লাসে নেচে উঠলাম। খাবো না মানে, তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়। সে একটা প্যাকেট থেকে ২টা সিগারেট বের করে দিল। খুব কড়া মাল। সাবধানে খাবি কিন্তু। আমরা তো ব্যঙ্গ করতে শুরু করলাম। ব্যাটা, ২টা সিগারেট দিয়ে কয় সাবধানে খাস। ভাগ শালা। রিক্সায় চড়ে খুব হাসাহাসি করলাম ওকে নিয়ে। বিভিন্ন বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি ঘুরে গরু-খাসির মাংস খেয়ে সন্ধ্যার সময় বাড়ির পাশে পুকুর পাড়ে বসলাম। বন্ধুকে বললাম, ধরা একটা স্টিক। সে ধরাল। একটা টান দিয়ে বলল, এরকম লাগে কেন? আমি বললাম, কি রকম? সে বলল, গলা জ্বলে যাচ্ছে। আমি বললাম, বেশি মাংস খাওয়া হয়েছে তো তাই। সে কয়েকটা টান দিয়ে আমাকে দিল। আমি টান দিয়ে বুঝলাম, কোথাও গন্ডোগোল আছে। গাঁজা তো এরকম নয়। গলাটা জ্বলছে কেন। যাই হোক, শেষ তো করতে হবে। হাজার হোক বিদেশী মাল। একটু ধক তো থাকবেই। নেশাটা চড়তে শুরু করল। একসময় আমার বন্ধু বলল, চল আপার বাসা থেকে ঘুরে আসি। আমি বললাম, এসময় যাওয়া ঠিক হবে না। কেমন কেমন যেন লাগছে। সে বলল, আরে দুর, এই যাবো আর আসবো। চল। না গেলে মাইন্ড করবে। আমিও বাধ্য হয়ে উঠলাম। কিছুদূর যেতেই দেখি পাড়ার মুরুব্বিরা আড্ডা দিচ্ছে। পা তখন টলছে। একটা ল্যাম্পপোস্টের সাথে ধাক্কা খেলাম। ওকে বললাম, বন্ধু পা টলে তুমি আমাকে ধরো। দুজনে গলা জাড়াজড়ি করে হাটছি। অল্প দূরেই ওর বোনো বাসা। গিয়ে চুপচাপ বসে আছি। খাবার দিলো। কোনো রকমে পোলাও দু মুঠো খেয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিলাম। বন্ধুকে তাড়া দিলাম। সেও তাড়াতাড়ি দুমুঠো খেয়ে উঠে পড়ল। সরু রাস্তা দিয়ে ফিরবার সময় বারবার দুই দেয়ালে ধাক্কা খাচ্ছি। দুজনেই বুঝছি অবস্থা খুব খারাপ। কোথাও থামতে হবে। আবার পুকুর পাড়ে গেলাম। গিয়েই শুয়ে পড়লাম। একসময় মনে হলো, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। বন্ধুকে বললাম, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। সে তো ঘাবড়ে গেল। আমার বুক মালিশ করতে লাগল, আর বলতে লাগল, এই তো নিঃশ্বাস নিতে পারছিস। এই তো পারছিস। কিন্তু কিছুতেই বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। মনে হচ্ছে মারা যাবো। চোখ খুলে দেখি, সব অন্ধকার। আমি কি তবে অন্ধ হয়ে গেলাম? তাকে বললাম, আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। সে ভীষণ ঘাবড়ে গেল। বলল, একটু অপেক্ষা কর। আমি যাবো আর আসব। দেখি কোথাও লেবু বা তেঁতুল পাওয়া যায় কিনা। সে দৌড় দিল। আমি মরণ যন্ত্রনায় শুয়ে ছটফট করছি। একসময় সে ফিরে আসলো লেবু নিয়ে। মুখের ভেতরে লেবুর রস পড়লে সবকিছু দেখি আবার সব অন্ধকার। বমি করলাম কয়েকবার। একসময় মনে হলো পানি না খেলে মারা যাবো। কিন্তু পানি আনতে গেলে তো জানাজানি হযে যাবে, সে বলল। আমি বললাম, পুকুরের পানি খাবো। সেদিন বোধকরি পূর্ণিমা ছিল। চাঁদের আলোতে দেখি, শান বাধানো ঘাটে গরু, ছাগলের ভুঁড়ি পানির নিচে। সে তো কিছুতেই আমাকে সে পানি খেতে দিবে না। আমি আজলা ভরে ঢকঢক করে সেই পানিই খেলাম। আবার বমি করলাম, আবার খেলাম। রাত ১১টার দিকে ও বলল, চল তোকে বাসায় দিয়ে আসি। পারবি তো বাসায় যেতে। তখন কিছুটা সুস্থির আমি। বললাম, তুই আমাকে আমার ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিবি, মশারি টাঙ্গিয়ে দিবি আর ২০/২৫ মিনিট অপেক্ষা করবি। যেন কেউ আমাকে ডিস্টার্ব না করে। তারপর তুই চলে যাবি। কেউ কিছু বলবে বলবি, ওর শরীর খারাপ। সেভাবেই একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। আর সেদিনই তওবা করলাম। আর গাঁজা খাবো না। মৃত্যুকে আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম সেদিন। অথচ কৈশোরের প্রেমিকা কতদিন বলেছিল, বলো আর কোনোদিন গাঁজা খাবা না। আমার মাথার দিব্যি। তাহলে চুমু খেতে দিব না। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি আর ভেঙেছি। কত যে মিথ্যাচার! বাবা, মা বোনরা যখন বলেছে, এই তোর চোখ লাল কেন? বলেছি, কি যেন চোখে পড়ল। মিছেমিছে চোখ ডলেছি। স্কুলে বরাবরই ভালো ছাত্র। ক্লাস ফাইভে, এইটে বৃত্তি পাওয়া এই আমি যে ভেতরে ভেতরে কতটা ক্ষয়ে যাচ্ছি, তা কেউ বুঝতে পারত না। শুধু বুঝত আমার প্রেমিকা। যার জন্য বুকের ছোট্ট এক কোণায় কিলক পোতা ব্যথা আজো করে। আমকে ক্ষমা করো, বন্ধু আমার। যদি সত্যি তোমার কথা শুনতাম তবে হয়ত জীবনটা এরকম হতো না। তোমাকেও পেতাম। যাই হোক, সে বেদনা একান্ত আমার। সেদিনের পর থেকে গাঁজায় ইস্তফা দিয়ে আমি আরেক নেশার দিকে ধাবিত হলাম। কারণ নেশা ছাড়া কিছুই ভালো লাগে না আমার।(চলবে)