আমার মাদকাসক্ত জীবন( সিগারেট পর্ব)
(এই লেখাটিকে কেউ মাদকাসক্তির পক্ষে দাঁড় করাবেন না অনুগ্রহ করে, কেননা জীবনের একটা পর্যায়ে আমরা কেউ না কেউ এর ভয়াবহতার মুখোমুখি দাঁড়াই। বরং ঐ জীবন থেকে পাওয়া খারাপ দিকগুলোকে তুলে ধরা এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায়ই- এ লেখার মূল উদ্দেশ্য। সমগ্র রচনাটি কয়েকটি পর্ব ভাগ করা হবে, যেমন, সিগারেট পর্ব, গঞ্জিকা পর্ব, মদ পর্ব, চোরশ পর্ব, ফেনসিডিল পর্ব, হিরোইন পর্ব ও সর্বশেষ সুস্থ জীবন )
ঠিক মনে নেই সময়টা বোধহয় ৭৭ সনের কোনো একদিন। গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছি। মনে হয় ধান কাটার মৌসুম ছিল সেটা। গ্রাম থেকে আমাদের নেয়ার জন্য নৌকা এসেছিল। সকাল সকাল আমি ও মা যাত্রা শুরু করেও পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেছিল। নৌকার গুনটানা লোক দুটোও ক্লান্ত। বাড়িতে গিয়েই তারা হুকা সাজাতে বসল উঠোনে বসে। আমি শহুরে বালক। তাদের তামাক সাজানো দেখি, টানা দেখি। গুড়গুড় শব্দ শুনি। একটা ভালোলাগার ঘোর ঘোরে মনে। গ্রামের সেই বিশাল প্রকৃতি, উদ্দাম বাতাস, সবুজ বৃক্ষ হাতছানি দিয়ে কোথায় যে নিয়ে যায় আমাকে, জানি না। সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমিও আর পথ চিনতে পারি না বাড়ি ফেরার। আমাকে না পেয়ে কাজের লোকেরা লণ্ঠন হাতে খুঁজতে বেরই। তাদের সাথে মেঠোপথে দেখা হলে তবে উদ্ধার। বাড়ি ফিরলে মায়ের প্রচণ্ড বকুনি। যাই হোক, রাতে খাওয়াদাওয়ার পর উঠোনে দড়ির খাটে শুয়ে শুয়ে আকাশের তারা গোনা। আর গল্পের আসর। সেই গল্পের আসরেরই এক ফাঁকে আমার চুরি করে হুকায় টান দেয়া। এত তিতকূটে বিশ্রী স্বাদ যে আর দ্বিতীয়বার ওমুখো হই নি।
শহরে এসে ওসব ভুলে গেছি। একদিন আমার চাচাত ভাই বলল, চল আব্বারা সব গ্রামে গেছে, বাড়ি ফাঁকা। বিড়ি খাই। চরম উত্তেজনা, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বিড়ি কেমন করে ম্যানেজ করা যায়। দোকানে গেলে যদি দোকানদার আব্বাকে বলে দেয়। উপায় একটা পাড়ার বাইরের কোনো দোকান থেকে কিনতে হবে। দুজনে মিলে হাঁটতে শুরু করলাম। পাড়া ছেড়ে অনেকদূর রুবি সিনেমার সামনে থেকে ১টাকার হারাগাছের ১নং বিড়ি কিনে ফিরলাম। সারা শরীরে ঘাম। চুলার পাড় থেকে ম্যাচ নিয়ে দুজনে দুটো বিড়ি ধরালাম কাঁপা কাঁপা হাতে। আহ্ কষ্ট। কোনো মজা নেই। তবুও টানছি। খুকখুক করে কাশছি। কিন্তু কেউই বলছি না, নারে এটা পচা। খাওয়া যায় না। দুজনেরই চোখ লাল। বিড়ি টানা শেষে মুখের গন্ধ পরীক্ষা। বিশ্রী গন্ধ থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে প্রথমে লবণ দিয়ে দাঁত মাজলাম। ভালো ভাবে মুখ ধুয়েও গন্ধ যায় না। শেষে চাচাত ভাই বুদ্ধি দিল লেবুর পাতা চাবিয়ে খাওয়ার। তাতেই বিশেষ ফললাভ হলো। তারপর বিড়িগুলোকে লুকিয়ে রাখলাম একটা পাঁচিরের প্রকোষ্ঠে। সেই বিড়ি পরদিন গিয়ে দেখি নাই। কে যেন নিয়ে গেছে। মনটা খুব খারাপ হয়েছিল সেদিন।
পাড়ার বড়ভাইরা নিয়মিত স্কুল পালায়। আমাকে বলে খবরদার একথা কাউকে বলিস না। আমিও বলি না। ভদ্র ছেলের মতো স্কুলে যাই, ফিরি। একদিন বড়ভাইদের একজন বলল, এই তোর কাছে টাকা আছে? আমি বললাম আছে। সে বলল, দে, তোকে কাল দিয়ে দিব। আমি বললাম, তাহলে আমি টিফিন খাবো কেমন করে? সে আমাকে বুদ্ধি শিখিয়ে দিলো, ধার করবি বন্ধুর কাছ থেকে। তোর কোনো বন্ধু নেই? আমি লজ্জায় সেদিন কোনো বন্ধুর কাছে টাকা ধার করতে পারি নি। টিফিনও খাই নি। পরদিন সেই বড়ভাইকে বললাম, আমার টাকা দেন। সে বলল, শোন তোকে একদিন সিনেমা দেখাব। আমিও লোভে পড়লাম সিনেমার। স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখা শুরু করলাম তাদের সাথে। মনিং শোতে তখন রুবি সিনেমায় দারুন দারুন ছবি হতো। নাম মনে নেই এখন সে-সবের। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। থার্ড ক্লাসে পড়তে পড়তেই আমার থার্ড ক্লাসে বসে সিনেমা দেখার শুরু। আর তখন থেকেই তাদের সাথে অল্প অল্প করে সিগারেটে টান। স্টার, ক্যাপিস্টান, কে-টু, সিজার, ডানহিল। পকেটের অবস্থার উপর নির্ভর করত। আমি আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে শুরু করলাম। মনে আছে আরেকটু বড় হয়ে ক্লাস সেভেন এইটের দিকে, তখন সিগারেট-এর শেষ টানটা দেবার জন্য উন্মুখ থাকতাম সকলে। একটা শ্ল্যাং তখন প্রচলিত ছিল, সিগারেটের শেষ টান আর একটি যুবতী মেয়ের সাথে সঙ্গম করা এক কথা। কতদিন যে হাত পুড়ে গেছে সে-লোভে। হা! সিগারেট! এখন পর্যন্ত অসংখ্যবার যাকে ত্যাজ্য করতে গিয়েও পারি নি। আজও এটি পেড়ে আর আমাকে পোড়ায়! রক্তে কোলেস্টরল বাড়ছে, বুকে মাঝে মাঝেই ব্যথা করে। ডাক্তার বলেছে, যদি বাঁচতে চান, তাহলে ধূমপান আপনাকে ছাড়তে হবে। কিছুতেই পারিনা। আমার কাছে মনে হয়েছে, সিগারেট ছাড়াটা সবচেয়ে কষ্টকর। কারণ এটার বিরুদ্ধে সামাজিক কোনো প্রতিরোধ নেই, অভিযান নেই এবং সমাজ এটাকে খারাপভাবে গ্রহণও করে না। ফলে সিগারেট ছেড়ে দেয়ার পক্ষে কাউকে পাওয়া যায় না। আর একটা ব্যাপার কারো মাঝে ক্রিয়া করে কিনা জানি না যে, হঠাৎ একটা ভাবনা এল। ভাবলাম একটা সিগারেট ধরাই। সেই সিগারেটে টান দিলাম, ভাবনা উধাও। কত সুন্দর মুহূর্ত যে ধ্বংস করেছি সিগারেটের জন্য তার ইয়ত্তা নেই। আজো প্রাণপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছি এ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য। সিন্দবাদের দৈত্যের মতন কিছুতেই ঘাড় থেকে নামাতে পারছি না। যারা পেরেছেন তাঁদের জন্য রইল আমার শুভ কামনা। সালাম।