যে পাশটা দিয়া সিড়ি দিয়ে আমরা কেওকারাডাং উঠি তার বিপরিত পাশ দিয়া যদি পা পিছলে পড়ে পড়ে যাই তবে যেখানে পড়বো সেই গ্রামের নামই হবে রুমানা পাড়া (আমার ধারণা)। রুমানা পাড়া, একটা বম পাড়া। আগে নাম ছিল সানকুপ পাড়া, সেটা ছিল ‘সানকুপ’ নামক কারবারির নামে। রুমা খালের শেষে পাড়াটার অবস্থান বলে এর নাম রুমানা পাড়া হয়েছে পরে।
রুমানা পাড়াটা বম অধ্যুষিত হলেও “রুমানা” নামটা না বম, না বাংলা, বরং এটা মারমা ভাষা। মারমা ভাষায় “রুঃ” মানে হলো “পাগল” আর “মা” মানে হলো “মেয়ে”। অর্থাৎ পাকিস্তান আমলেই ‘রুমা খাল’ থেকে ‘রুমানা পাড়া’ নামকরণ হয়। এই ‘পাগল মেয়ে’ নামকরণে আছে দারুণ এক রোমান্টিক মিথ, একসময় রুমা খালে, বর্ষাকালে প্রচুর মানুষ মারা যেত। যারা মারা যেত, তাদের মধ্যে নারী ছিল না, শুধু পুরুষরা মারা যেত। তাই রুমাকে, প্রকৃতিদেবী গণ্য করে আদিবাসীরা একে এক মেয়ে কল্পনা করে নেয়, আর সেই মেয়েই যেনবা ছেলেদের নিয়ে যাচ্ছে এভাবে। তাই সেই মেয়ে হয়ে যায় ‘পাগল মেয়ে’, মানে ‘রুঃমা’, যা থেকে হয় ‘রুমা’ অতঃপর রুমানা।
(২/৩) কেওকারাডাং এর সেকাল ও একাল। ২০১৩ সালে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা কেওকারাডাং যাওয়ার পর ওখানকার চুড়ার মিনারটায় বেশ কিছুটা আধুনিকতা চলে আসে, প্রথম ছবিটা আগের। রুমানা পাড়ায় যাওয়ার খুব সম্ভবত বিকল্প পথ আছে, তবে আমরা গিয়েছিলাম কেওকারাডাং এর পথ ধরেই।
(৪) কেওকারাডাং এর চূড়ায় দাঁড়িয়ে তোলা সুংসাং পাড়ার আর্মিদের ছাউনি, রুমানা পাড়ায় যেতে হয় ওখান থেকে অনুমতি নিয়ে।
(৫) কেওকারাডাং পেড়িয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেলেই পড়বে বাংলাদেশের সব চেয়ে উঁচু গ্রাম পাসিং পাড়া।
(৬) পাসিং পাড়া থেকে বামে বাঁক নিয়ে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ পথ ধরে নেমে যেতে হয় সুংসাং পাড়ার দিকে, তখন অভিযাত্রীদের অভয় দিয়ে থাকে এমন পাহাড়ি ফুলগুলো।
(৭) খাড়া পাহাড়ি পথটা পেরিয়ে কিছুটা সমতলে এসেই চোখে পড়বে একটা নরবড়ে কাঠের সেতু, নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে নাম না জানা পাহাড়ি একটা স্রোতধারা।
(৮) সেতু পেড়িয়ে ২০/২৫ মিনিট হাটলেই একটা চমৎকার পাহাড়ি গ্রাম, এর নাম সুংসাং পাড়া। এই গ্রাম থেকে বামে মোড় নিয়ে আরো ঘন্টা দেড়েকের পাহাড় ট্রাক করলেই আমাদের গন্তব্য রুমানা পাড়া।
(৯) সুংসাং পাড়া আর্মি ক্যাম্প, আর্মি ক্যাম্পের অনুমতি না নিয়ে রুমানা পাড়ার দিকে যাওয়া যাবে না।
(১০) অনুমতি সাপেক্ষে এক সময় আমরা চলে এলাম রুমানা পাড়ায়। রুমানা পাড়ায় কয়েকটা ঝর্ণা রয়েছে, এখানে এসে ওদিকে ঢু না মেরে যাওয়াটা চরম বোকামী হবে, এক দিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে অন্য দিকে আকাশ কালো করে ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা জেগে উঠেছে। তবু আমাদের ঝর্ণায় যেতেই হবে, কারণ রাতেই আবার আমাদের ফিরে যেতে হবে সুংসাং পাড়ায়।
(১১/১২) রুমানা পারায় ঢুকতেই গ্রামের আদিবাসীরা আমাদের উৎসুক নয়নে দেখছিলো, কিন্তু আমরা হাই হ্যালোর বেশী কিছু করার মতো সময় ছিলোনা। পাড়া থেকে নতুন গাইড নিয়ে ছুটে চললাম রুমানা ঝর্ণার দিকে।
(১৩/১৪) ঝর্ণায় যাওয়ার পথটা দূর্গম বললেও কম বলা হবে। বেশীর ভাগ পথই খাড়া বাঁশ বনের ভেতর দিয়া যেতে হয়েছিলো। কোথাও কোথাও হামাগুড়ি দিয়ে ছেচড়ে, ঝোপঝাড় কেটে নামতে হয়েছিলো।
(১৫) সেই সাথে আমাদের আপ্যায়ন করার জন্য ওনারা যেন এই দিন অনেক বেশী উম্মুখ ছিলো। মুসলধারে বৃষ্টিতে অন্ধকার রাতে বার বার পিছলা খেতে খেতে রুমানা ঝর্ণা দেখে ফেরার পর সবার শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত ঝড়ছিলো, কারো কারো গা থেকে সারা রাতই ব্লিডিং হচ্ছিল। জোঁকের কামড়ের রক্ত বন্ধ করার পাহাড়িদের চুলার ছাই দিয়েও বন্ধ করা যাচ্ছিল না। আপুদের অবস্থা ছিল সব চেয়ে করুণ। এদিনের কথা আমি জীবনেও ভুলব না।
(১৬) এতো কষ্টের রুমানা ঝর্ণাটা এক সময় দূর থেকে আমাদের চোখে ধরা দিল, তবে কাছে যেতে যেন আরো সাত সমুদ্র পারি দিতে হলো।
(১৭) এক সময় জংলা পথ ছেড়ে আমাদের ধরতে হয়েছিলো ঝিরিপথ।
(১৮) ঝিরি পথের শেষ মাথাটা হঠাৎ খারা নেমে গিয়েছে, যার নিচে সৃষ্টি হয়েছে অন্য একটা ঝর্ণা।
(১৯) রুমানা ঝর্ণাটা উপর থেকে দুটি ধারা নামলেও নিচের দিকে এসে চারটা ধারা আছড়ে পড়ছিলো পাথুরে পাহাড়ের চাতালে।
(২০) অনেক ঘাম আর রক্ত ঝড়িয়ে রুমানার দুয়ারে এসে দাড়ালাম, সে নিমেষেই আমাদের সব ক্লান্তি দূর করে দিল তার আচলে ঢেকে নিয়ে।
রুমানা আমাকে আবারো ডাকছে তার শান্ত স্নিগ্ধ সবুজ গায়ে অবগাহন করার জন্য। এ্যাডভেঞ্চারের নেশায় যারা ঘুরছেন তাদের আমি বলবো রুমানা পাড়াও তার ঝর্ণাগুলো ঘুরে আসুন ষোলকলা পূর্ণ হবে নিশ্চিৎ।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১২:২৪