মওদুদীর অনুসারী জামায়াতে ইসলামকে ‘নাস্তিক’ আখ্যায়িত করে দলটির কর্মীদের তওবা করে ইসলামের পথে আসার আহ্বান জানিয়েছেন মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ।
শনিবার মতিঝিলে শাপলা চত্বরের সমাবেশে এই আহ্বান জানান দেশের বৃহত্তম ঈদ জামাত কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার এই ইমাম।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি এবং জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের দাবিতে ‘বাংলাদেশ ওলামা মাশায়েখ তৌহিদী জনতা সংহতি পরিষদ’র ডাকে এই সমাবেশ হয়।
ঢাকার পর জেলায় জেলায় সমাবেশের ঘোষণাও দেন পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা ফরীদ। প্রথমে চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও রংপুরে সমাবেশ হবে বলে জানান তিনি।
শিগগিরই কাউন্সিল অধিবেশন ডেকে জেলাগুলোতে সমাবেশের তারিখ ঠিক করা হবে বলে জানান তিনি।
জামায়াত-শিবিরকে ‘বড় নাস্তিক’ ও ‘মুরতাদ’ আখ্যায়িত করে মাওলানা ফরীদ বলেন, “তারা ইসলামকে কলুষিত করছে। ইসলামের অপব্যাখ্যা দিচ্ছে। যারা কুরআন, নবী-রাসুল সম্পর্কে অপব্যাখ্যা দেয়, তারাই নাস্তিক এবং ইসলামের বড় শত্রু।”
জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমি আদরের সঙ্গে, তাদের কাছে পিতৃস্নেহ নিয়ে বলছি- আপনারা তওবা করে ভুল পথ থেকে ফিরে আসুন।”
যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগ আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি দলের কর্মসূচির মধ্যে মাওলানা ফরীদের নেতৃত্বে ওলামাদের জামায়াতবিরোধী এই সমাবেশ হল।
শাহবাগের আন্দোলনবিরোধী দলগুলো গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকারীদের ‘নাস্তিক’ ও ‘অনৈসলামিক’ আখ্যা দিয়েছে। পাশাপাশি জামায়াত নেতা যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর মুক্তিও দাবি ওঠে তাদের সমাবেশে।
গণজাগরণ মঞ্চ থেকে জামায়াত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বলে চিহ্নিত ইসলামী ব্যাংকে টাকা রাখা ‘হারাম ও না-জায়েজ’ দাবি করে মাওলানা ফরীদ সবাইকে ওই ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নেয়ার আহ্বান জানান।
জামায়াতের ‘প্রাণভোমরা’ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
জোহরের নামাজের পর শুরু হওয়া এই সমাবেশে আল্লাহ, নবী-রাসূল, ইসলাম এবং সব ধর্মের মর্যাদা সংরক্ষণে আইন প্রণয়নের দাবিও জানানো হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে যুদ্ধাপরাধ জঘন্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধ উল্লেখ করে মাওলানা ফরীদ বলেন, “জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ অধিকাংশ নেতাই একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত বলে দেখা গেছে। এদের সর্ব্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
“জামায়াতে ইসলামী নিজেদের নেতাদের সঙ্গে নবী-রাসূলের তুলনা করে। যদিও ইসলামের পবিত্র আকিদা হলো নবীর সঙ্গে কারো তুলনা হয় না।”
সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রতিক হামলায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “কিছু লোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের এজেন্ডা হাতে তুলে নিয়েছে। এদের অবশ্যই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।
“ইসলাম যে কোনো ধর্মের মানুষদের নিরাপত্তা বিধানে শতভাগ নিশ্চয়তা দেয় এবং ইসলামের এ বিধানকে কলঙ্কিত করতেই সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে।”
মাওলানা ফরীদ সরকারের উদ্দেশে বলেন, “এবারের পাঠ্যবইয়ে অনেক ধরনের ভুল, ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর চেতনাবিরোধী কিছু কিছু বিভ্রান্তি তৌহিদী জনতার মনে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এসব বিভ্রান্তি নিরসন করতে হবে।”
শিক্ষানীতি ও নারীনীতিতে যেসব ধারা কুরআন-হাদিসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সেগুলো সংশোধনের দাবিও তোলেন তিনি।
কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতির বিষয়ে কোনো টালবাহানা এ দেশের তৌহিদী জনতা মানবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
কুরআন তিলওয়াতের মধ্য দিয়ে দুপুর আড়াইটার দিকে সমাবেশ শুরু হয়। তবে তার আগে সকাল ১০টা থেকে শাপলা চত্বরে মঞ্চে পরিষদের নেতারা জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরেন।
‘ওয়ার্ক ফর দ্বীন ইসলাম, নট ফর জামায়াত ইসলাম’ স্লোগানের সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চে বক্তব্যের পাশাপাশি হামদ ও নাতে রাসুলের পরিবেশনাও চলে।
পরিষদের সদস্য মাওলানা সাঈদ নিজামী সাংবাদিকদের বলেন, “মওদুদীবাদী জামায়াত পথভ্রষ্ট, কুরআন হাদিসের পরিপন্থী। তাদের দলে শরিক হওয়া, সাথে কাজ করা ও সহযোগিতা করা জায়েজ হবে না।”
তবে ‘ইসলামী রাজনীতি’ বন্ধের বিরুদ্ধেও নিজেদের অবস্থান জানান সাঈদ নিজামী।
“ইসলামী রাজনীতি বন্ধের ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়াতে হবে, আল্লাহ নবী রাসূল ,ইসলাম এবং সব ধর্মের মর্যাদা সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়াতে হবে।”
বাংলাদেশ কওমী শিক্ষার্থী পরিষদের সভাপতি মোর্তুজা আল হোসাইন বলেন, জামায়াত ইসলামের নামে ইসলামবিরোধী কাজ করে যাচ্ছে।
“তাদের নেতা মওদুদী কুরআনের অপব্যাখ্যা করেন ও নবী-রাসূল নিয়ে কটূক্তি করেছেন। তারা পীর ওলামাদের যোগ্য সম্মান দেন না।”
ধর্মের নামে একাত্তরে বাঙালিদের নির্যাতন এবং নারীদের ধর্ষণের জন্য জামায়াতকে দায়ী করে দলটিকে নিষিদ্ধের দাবি জানান আল হোসাইন।
সমাবেশে যোগ দিতে সিলেট থেকে আসা মাওলানা আবদুস সাকি বলেন, “বাংলাদেশের মানুষের দাবি এ দেশে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। ওলামা সমাজের দাবিও এক ও অভিন্ন।”
পরিষদের নরসিংদী জেলা প্রতিনিধি মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ আলী বলেন, “ইসলামের লেবাস গায়ে জড়িয়ে জামায়াত ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। তারা কোরআন শরীফের অপব্যাখ্যাকারী, তারা নাস্তিক। তাদের বাংলার মাটি থেকে নির্মূল করতে হবে।”
গাজীপুর প্রতিনিধি মাওলানা আফসারুজ্জামান বলেন, “জামায়াত-শিবির ইসলামকে কলঙ্কিত করে দেশের ক্ষতি করে চলেছে। এদেশ থেকে তাদের বিতাড়িত করতে হবে।”
ফরিদপুর প্রতিনিধি মাওলানা রেজা আবদুল্লাহ বলেন, জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে এ সমাবেশ আহ্বান করা হয়েছে। সবাই জানেন, জামায়াতকে সবাই দীর্ঘদিন ধরেই ভ্রান্ত ও বাতিল মতবাদ করে চিনে থাকে।”
“একাত্তরে তারা নারী ধর্ষণ ও মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরেছেন। এখন সময় এসেছে, তাদের নিষিদ্ধ করতে হবে,” বলেন তিনি।
সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন পরিষদের সিলেট বিভাগের প্রতিনিধি মাওলানা আবুল হোসেন, কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি মুফতি আইনুল ইসলাম, রংপুর প্রতিনিধি মাওলানা হোসেন আনোয়ার ও মাদারীপুর প্রতিনিধি মাওলানা জহিরুল ইসলাম।
এই সমাবেশকে কেন্দ্র করে মতিঝিল এলাকায় গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে বলে মতিঝিল থানার ওসি হায়াতুজ্জামান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “পুলিশ যথেষ্ট নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। নিরাপত্তার প্রয়োজনেই সমাবেশ সংলগ্ন রাস্তাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।”
জামায়াতবিরোধী ওলামাদের হত্যার পরিকল্পনা ইসলামী ছাত্রশিবিরের রয়েছে বলে চট্টগ্রাম পুলিশ সম্প্রতি জানিয়েছে। এই অভিযোগে কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।
Click This Link