গাইতে গাইতে কি কখনো গায়েন হওয়া যায়? আমার মনে হয় এই প্রবাদটি ভুল। এই যেমন আমি, গলার স্বরের সাথে হুলো বিড়ালের স্বরের অপূর্ব মিল থাকায় ছেলেবেলায় বেশ অনেক বছর হারমোনিয়ামের সাথে গুতোগুতি করে, গানের টিচারের কালো ঘাম ছুটিয়ে শেষে ঐ রাস্তায় হাটাচলা বাদ দিয়েছি। তাই বলে গানের প্রতি ভালবাসা কমেনি।
গান শোনার ক্ষেত্রে আমি মোটামুটি সর্বভুক, সেই সাথে গানের ইতিহাস গুলোও জানতে ভাল লাগে।
ভাল লাগে আমাদের লোকসঙ্গীত গুলো। কি অসাধারণ ঐশ্বর্য্যশালী আমাদের লোক গানের ভান্ডার, কত শত তার ডালপালা দেখলে অবাক বিস্ময় জাগে মনে।
ঘেটু গান ও নাচ:
শুরুতেই ঘেটু গান ও নাচ, কারণ ইদানিং হুমায়ূন আহমেদে "ঘেটু পুত্র কমলা" নিয়ে এত সোরগোল হচ্ছে, যে আপনা আপনি ঘেটু গান সিরিয়াল ব্রেক করে সামনে চলে আসলো!
ঘাটু গান’ এর নামকরণের ইতিহাস একেক জনের বর্ণনায় একেক রকম। সাধারণের ধারণা, ঘাটে ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে গাওয়া হতো বলে এর নাম হয়েছে ঘাটু গান। নেত্রকোনার স্থানীয় লোক সাহিত্য সংগ্রাহক গোলাম এরশাদুর রহমান তার ’নেত্রকোনার লোকগীতি পরিচয়’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন: “ঘাটু নামকরণ সম্পর্কে স্থানীয়ভাবে আদিকালের সমঝদারদের বক্তব্য ছিল- কৃষ্ণের বাঁশির ঘাট শব্দ থেকে ঘাটু নামকরণ হয়। কারণ ঘাটু ছেলেটিকে মূলত নাচে ও গানে নিয়ন্ত্রণ করে বাঁশি’’।
ঘাটু গানে প্রধান আকর্ষণ ঘাটু চরিত্র। একজন সুন্দর কিশোর মেয়ের সাজে সজ্জিত হয়ে গান ও নাচ করতো। এই ছেলেদের মাথায় লম্বা চুল রাখা ছিল বাধ্যতামূলক। তারা চুলে বেণী ও খোঁপা বাঁধতেন। উকিল মুনশীর নাম অনেকেই শুনেছেন। তিনি শৈশবে ঘাটু গানের ঘাটু ছিলেন। তাছাড়া আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও ঘাটু গানের (লেটো গান) দলে ছিলেন।
ঘাটু গানের মূল বিষয়বস্তু ছিল রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলা। চিরায়ত এ প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করেই রচিত হতো ঘাটু দলের গান। আসরে উঠে ঘাটু প্রথমে বন্দনা গাইতেন। এরপর প্রেম, প্রেমতত্ত্ব, মান, অভিমান, বিচ্ছেদ, মিলন, সন্ন্যাস প্রভৃতি বিষয় অবলম্বন করে প্রবাহিত হতো তার গীতধারা।
ঘাটু গান নিয়ে চমৎকার একটি লেখা পড়ুন এখানে ....লোকসঙ্গীতের সাতরঙ (পর্ব -০২)
জারী গান:
বাংলার অন্যতম ঐতিহ্যবাহি গান হলো জারী গান, অপ্রতিদন্ধি গায়ক জারী সম্রাট আবদুল গনি বয়াতীর গান নিশ্চয় অনেকেরই শোনা।
জারী গানের সৃষ্টি হয়েছিল মুসলমানী পৌরনিক ঘটনাবলী নিয়ে, পরে মুহররমের করুন কাহিনী এতে প্রাধন্য লাভ করে। জারী গানে মূলত: কোন ঐতিহাসিক ঘটনা দলীয় সংগিত আকারে পরিবেশন করা হয়। এতে এক সময়ে চন্ডিদাস-রজকিনী, নিমাই-সন্ন্যাস প্রভৃতি কাহিনীও জারীর সুরে গাওয়া শুরু হয়, মানে শ্রোতার চাহিদা ভিত্তিক কাহিনী সংযোজন হয় এত।
এবার আবদুর রহমান বয়াতীর একটি জারী গান শুনন
সোহেলির গান:
এটা একদম মেয়েলি গান। এক সময়ে গ্রাম বংলায় মেয়েদের মধ্যে ঘটা করে সই পাতানোর প্রচলন ছিল। এর অনেক নিদর্শন আমরা রবীন্দ্র বা শরৎ রচনা গুলোতে পাই। এই সই' দের সম্বন্ধের আবার আলাদা নামও থাকতো, যেমন চোখের বালি।
যাই হোক এই সই' প্রথাকে ঘিরেও সৃষ্টি হয়েছিল গানের একটি ধারা, যার নাম 'সহেলার গান'। এমন একটি গান.....
চলিল, কমলা গো-সহেলা পাতিবারে
চিড়া গুড় লৈক কমলা, ডাইলারে ভরিয়া
কলা চিনি লৈল কমলা, ডাইলারে ভরিয়া
পান শুবারি লৈল কমলা বাটারে ভরিয়া
পুস্প দূর্বা লৈল কমলা সাজি ভরিয়া!
মানে হলো চিড়া-গুড়, কলা-চিনি, পান-শুপাড়ি নিয়ে কমলা সই পাতাতে যাচ্ছে।
দারুন ব্যাপার না?
আবার সহেলী গানের পরিচয় দিতে গিয়ে মোহাম্মদ আবদুল আজিজ (আমাদের লোক সাহিত্য) বলেছেন, "এই সব সঙ্গিত সাধারণত বিবাহ, উপনয়ন, খাৎনা প্রভৃতি উপলক্ষে মেয়েরা একসাথে গাহিয়া থাকেন"।
গাজীর গান:
বাংলাদেশের সুন্দরবন আর উত্তরবঙ্গের এক সময়ে বাঘের বেশ উপদ্রব ছিল। ধর্মভীরু মানুষ এই বাঘের উপদ্রব থেকে রক্ষাপেতে এক সময়ে কল্পনা করে নেয়ে বাঘের দেবতা বা পীরের। এই পীরের নাম গাজী।
গাজী নামে কোন ঐতিহাসিক চরিত্র ছিল কিনা সেটা একটি বিতর্কিত বিষয়, তবে লোকমানসে তিনি পরম শ্রদ্ধার। তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে অসংখ্য লোকসঙ্গিত, যা গাজীর গান নামে পরিচিত।
"ঢাহারে দোম দোম বলিয়া গাজি ছাড়িল জীহির
নন্দ ঘোষরের মায় বলে, এই আইল ফকির,
নন্দ ঘোষের মায় বলে কালু ঘোষের ঝি
বাড়ি আইল গাজির ফকির ভিক্ষা দেবো কি!"
যশোর জেলার একটা ঐতিহ্যবাহী গাজির গান
ঝুমুর গান:
ঝুমুর প্রধানত পশ্চিম বাংলার সীমান্ত অঞ্চলের গান। এক কালে এই সংগীতে শুধু আদিবাসীদেরই আধিকার ছিল। সাওতাল গান যে গুলো আমরা শুনি, এগুলোও ঝুমুর। ঝুমুর গান ও নাচের আছে অনেক গুলো শাখা, যেমন ছো নাচের ঝুমুর, করম নাচের ঝুমুর, সাওতালি ঝুমুর, পাতা নাচের ঝুমুর ইত্যাদি ইত্যাদি।
কালক্রমে এই মৌলিক ঝুমুর গান ধীরে ধীরে বাংলা লোকসংগিতে চলে আসে, এক সময়ের লোকসংস্কার মুক্ত বাস্তব জীবন ভিত্তিক এই গানে প্রবেশ করে ধর্ম, চলে আসে রাধাকৃষ্ণ।
অমিতাভ ঘোষের গলায় ঝুমুর গান, সেই সাথে করম নাচের ঝুমুর..
এখানে একটা কথা উল্লেখ্য যে ঝুমুর গানের সাথে নাচ অঙ্গাআঙ্গিক ভাবে জড়িত।
গম্ভীরা গান:
এই গানের প্রচলন দেখা যায় বাংলাদেশের চাপাই নবাবগঞ্জ আর ভারতের মালদহ জেলায়। হিন্দু ধর্মাবলম্বিদের ধর্মালম্বীদের অন্যতম দেবতা শিব, তার অপর এক নাম‘গম্ভীর’। শিবের উৎসবে শিবের বন্দনা করে যে গান গাওয়া হত- সেই গানের নামই কালক্রমে হয়ে যায়‘গম্ভীরা’এক সময়ে শিবের পুজা উপলক্ষে এই গানের প্রচলন হলেও কালক্রামে এতে সামাজিক বিষয় গুলো প্রাধান্য লাভ করে।
বর্তমানে বাংলাদেশের যে গম্ভীরা গান চলে, তাতে প্রধান দুটো চরিত্র থাকে, নানা এবং নাতি। এই নানা ও নাতীর ‘নানা-নাতি’র সংলাপ ও গানের মধ্য দিয়ে দ্বৈতভাবে গম্ভীরা গান পরিবেশিত হয়।
ভাওয়াইয়া:
বাংলাদেশের রংপুর ভারতের জলাপাইগুড়ি ও কোচবিহারই ভাওয়াইয়া গানের উৎস ভূমি। এই গান মূলত: প্রেম সঙ্গীত, এর গানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ গানগুলোতে স্থানীয় সংস্কৃতি, জনপদের জীবনযাত্রা, তাদের কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক ঘটনাবলী ইত্যাদি নিয়েই গান গুলো রচিত হয়।
গাড়িয়াল কে উদ্দেশ্যকে রচিত ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের সেই বিখ্যাত গানটি...
তবে লোকসংগীতের অন্যতম নায়ক "কৃষ্ণের" উপস্থিতিও আছে অনেক ভাওয়াইয়া গানে।
ভাটিয়ালি:
ভাটিয়ালি কিন্তু গানের কোন শ্রেণীর নাম নয়, এটা লোক সঙ্গীতের একটা সুরের নাম। ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম এবং ত্রিপুরা অঞ্চলের লোকগিতী ভাটিয়ালি নামে পরিচিত। ভাটিয়ালী গানও প্রেম এবং ধর্ম ভিত্তিক।
ফেরদৌসি রহমানের দরাজ গলায় ভাটিয়ালি...
সারি গান:
‘সারিগান’ বলতে সাধারণত নৌকা বাইচের গানকেই বোঝায়। মাঝি-মাল্লার বিষয়টি এখানে জড়িত। তবে ভাটিয়ালী গানের মতো সারিগান একক সঙ্গীত নয়, সমবেত। কর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত সমবেত সঙ্গীতকে সারি শ্রেণীর গান বলা যায়। সারিগানের সংজ্ঞা নিয়ে লোক-বিজ্ঞানীদের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। মুহম্মদ আব্দুল হাই এর মতে, ‘ইংরেজিতে যাকে বলে Action song. সারিগান হচ্ছে তাই। ‘সারিগান নৌকা বাইচের গান।’ ড. ওয়াকিল আহমদ- এর মতে, ‘সারি’ (√সৃ+নিচ) শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ গমন করানো। নৌকাকে দাঁড়ের টানে সামনে এগিয়ে নেয়া হয়। ‘সারি’ শব্দের অর্থ পঙতি বা শ্রেণী। এ থেকে শ্রেণী বা সারিবদ্ধভাবে যে গান গাওয়া হয় তাই সারিগান নামে পরিচিতি লাভ করে।আবার ড. শুদ্ধসত্ব বসুর মতে ‘কর্মরত অবস্থায় সমবেতভাবে গেয় এক বিশেষ সঙ্গীতের নাম ‘সারিগান।’ ‘সারি’ কথাটির মানে শ্রেণী, যখন এক শ্রেণীর লোক একই কর্মেরত। কর্মের সঙ্গে সঙ্গে গান করে থাকে- সেই গান হলো ‘সারিগান।’ সারিগান সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হয়।’ চর্যাপদে ‘সারি’ শব্দ আছে ‘বীণার ছড়’ অর্থে। বিজয় গুপ্তের পদ্মপুরাণে (১৪৯৪) সারিগানের উল্লেখ আছে। শ্যাম চাঁদ গুপ্ত (১৭৭৪-১৮৫৪) এর রচিত সারিগান সংগ্রহ করে রামপ্রাণ গুপ্ত ‘সারিগান’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর এর আমলে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা অবলম্বন করেই সারিগানের উৎপত্তি ও বিকাশ লাভ করেছে।
যাই হোক সারিগানকে কেউ কেউ কর্ম সঙ্গীত, কেউ কেউ মাঝি-মাল্লাদের সঙ্গীত হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন। আমার মতে নৌকার মাল্লারা বা বাইচালরা সারিবদ্ধভাবে বসে বৈঠার তালে তালে যে গান গায় তাকে ‘সারিগান’ বলে।
টাংগাইল অঞ্চলের একটা সারি গান দেখুন..
"একটা জয়-ধ্বনি দে গো তোরা
রহিম মিঞার নৌকাতে
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ
একটা জয়-ধ্বনি দে……।
আল্লাহর নামটি নইয়্যা আমরা নৌকা দিলাম ছাইড়
কোথায় আছো দয়াল নবী আমরা হইলাম বাইড়।
একটা জয়-ধ্বনি দে…….।
তোমার নামটি ভসসা কইরা নৌকা দিলাম ছাইড়া
কোথায় আছো ইমাম দুইভাই দ্যাখো না চাইয়্যা।
একটা জয় ধ্বনি দে …………।
কবি গান: '
খেউড়' বা খেড়ু থেকে কবি গানের উদ্ভব হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। সপ্তদশ শতেকর মাঝামাঝিতে এই গানের প্রচলনের নিদর্শন পাওয়া যায়। কবি ঈশ্বর গুপ্ত এই গানের উদ্ভব স্থাল বলে নদীয়া লেজার শান্তিপুরকে নির্দেশ করেছেন।
কবি গানের বিশেষত হলো একাধিক দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা, এবং সেটা গানের মাধ্যমে। একদল প্রশ্ন করবে সুরে সুরে, অন্য দল সুরেই তার উত্তর দেবে।
পরবর্তিকালে কবি গানের বিষয় বস্তুতে আদিরসের অতিরিক্ত ছড়াছড়ি অনেকেরই কাছে স্থুল মনে হয়েছিল. রবি ঠাকুর একবার কবি গান নিয়ে তার বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। নারী পুরুষ দ্বন্দ নিয়ে কবি গানের একটা অংশ দেখুন, কথা গুলো খেয়াল করুন.....
ছোকরা এবং খেমটা গান:
আসরের কম বয়সি ছেলেদের দলীয় গান গুলোই ছোকরা গান নামে পরিচিত। এই গান একেবারেরই ধর্ম আর লোক সংস্কার নিরপেক্ষ।
খেমটা হলো ছোকারা গানের একটা অপরিহার্য অঙ্গ। ছোকরা গানের গায়ক আর তার সংগীয়া যখন টানা গান গেয়ে ক্লান্ত হয়ে যায়, সেই মধ্যবর্তি সময়ে গাওয়া হতো খেমটা গান, যার বেশির ভাগই আদিরসাত্মক ছিল। এই গানের সাথে আবশ্যিক ভাবে থাকতো একক বা দলিয় নাচ। এখনকার যাত্রা পালা গুলোতে যেটা আমরা দেখি এখনও। আধুনিক আইটেম সং বলা যায়।
আরও বাকি রইলো অনেক অনেক শাখা প্রশাখা আমাদের ঐতিহ্যবাহী গানের।
অন্য কোন দিন হয়তো আবার কথা হবে সে সব নিয়ে...
গানচিল ভাইয়া...........এমন কোন বাংলা গান কি আছে, যা তার কাছে জানতে চাইলে খুজে পাওয়া যাবে না? না নেই! শুধু মাত্র গান এবং তার ইতিহাস নিয়ে চমকপ্রদ লেখা গুলো আমাদের শোনা আর জানার চাহিদাকে সমান তালে পূরণ করছে।
এই সামান্য লেখাটি তাকেই উৎসর্গ করলাম...