ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর কথা কে না জানে? ঐশ্বর্যশালী বিস্তৃত এই নগর সভ্যতাও এক সময়ে ধ্বংস হয়েছিল শক্তিশালী যোদ্ধা জাতি আর্য আক্রমন কিংবা ক্রমাগত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে।
কিন্তু ধ্বংসের ভিতর থেকেই মানুষ আবার ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে নতুন সভ্যতা। প্রত্নত্বাত্তিকগণ যার নাম দিয়েছেন দ্বিতীয় নগরায়ন। তাম্র-প্রস্তর যুগের পর আদি ঐতিহাসিক যুগের এই নগরায়ন ঘটেছিল ভারতের চন্দ্রকেতুগড়, বানগড়, মঙ্গলকোট, তমলুক সহ আরও কিছু অঞ্চলে, এবং এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে শনাক্তকৃত মহাস্থানগড় (পুন্ড্রনগর) আর নরসিংদীর বেলাব থানার ওয়ারী-বটেশ্বরে।
মহাস্থানগড় সম্পর্কে আমরা কম বেশি জানলেও এক দশক আগ পর্যন্ত আমাদের ধারণার বাইরে ছিল উয়ারী দূর্গ নগরীর সমৃদ্ধির তথ্য। এর কারণ পর্যাপ্ত অনুসন্ধান ও প্রত্নতাত্ত্বিক খননের অভাব।
তবে স্থানীয় স্কুল শিক্ষক হাবীবুল্লাহ পাঠান ও তাঁর পিতা হানিফ পাঠান ব্যাক্তিগত উদ্যোগে দীর্ঘ দিন এই অঞ্চলের প্রত্নবস্তু সংগ্রহ, সংরক্ষন আর সে সব নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি করছিলেন। এতে অনুপ্রানিত হয়ে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের প্রবল প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে প্রাচীন এই নগর সভ্যতার এক একটি দ্বার, নতুন নতুন স্থাপত্য ও প্রত্ননিদর্শন। বৈচিত্রময়, বিস্ময়কর আর উন্নত কারিগরী দক্ষতার এসব নিদর্শন শুধু আমাদের মুগ্ধই করে না, প্রাচীন এক সমৃদ্ধ জনপদের অংশীদার হিসাবে গর্বিতও করে।
এবার তাহলে আসুন এক নজরে দেখে নেই ওয়ারী বটেশ্বরে ক্ষেত্রীয় অনুসন্ধান আর প্রত্নতাত্ত্বি উৎখনন সমূহে প্রাপ্ত কিছু স্থাপত্য আর প্রত্নবস্তু ..........

নব্য প্রস্তর যুগীর পাথের হাতিয়ার (হাবিবুল্লাহ পাঠান সংগ্রহ)।

লৌহ হাত কুঠার (হাবিবুল্লাহ পাঠান সংগ্রহ)।

২০০৪-৫ উৎখননে প্রাপ্ত পিট ডুইলিং বা তাম্রপ্রস্তর যুগীর গর্ত বসতি। আদি ঐতিহাসিক প্রত্নস্থান মহারাস্ট্রের ইনাম গাওয়ে এই ধরনে প্রচুর গর্তবসতি পাওয়া গেছে, এমনকি আধুনিক কালেই এই ধারা বর্তমান আছে ওখানে।

২০০৫-২০০৭ উৎখননে প্রাপ্ত বাই লেন সহ প্রাচীন রাস্তা। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই রাস্তার উপরের স্তরে আধুনিক রাস্তার মতো একটা কোটিং ছিল, উপাদান গুলো এখনও নিশ্চিত হওয়া যায় নি।

ব্রোঞ্জের নবড ওয়ার (হাবিবুল্লাহ পাঠান সংগ্রহ)। নবড ওয়ারকে বৌদ্ধ ধর্মের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়। এই ধরনে আরও বেশ কিছু মাটির নবড ওয়ার এই অঞ্চলে পাওয়া গেছে।

২০০৬-২০০৭ উৎখননে প্রাপ্ত চমৎকার একটা স্থাপত্য, তবে এটা কি ছিল আদতে সেটা এখনও পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

কাজ চলছে উৎখননের।

শুঙ্গ যুগীয় টেরাকোটা ফলকে যক্ষ(?)। এই ধরনের প্রচুর টেরাকোটা ফলক পাওয়া গেছে চন্দ্রকেতু গড়ে। এই ফলকটা উপরের সে স্থাপত্যের ছবি দেয়া হয়েছে, ওখানে উৎখননে এটা পাওয়া গিয়েছিল।

ছাপাংকিত রৌপ্য মুদ্রা। প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায় এই অঞ্চল থেকে। এই ধরনের মুদ্রা ভারতবর্ষের সর্ব প্রাচীন মুদ্রা!

কয়েন হোরড বা কলসি ভর্তি মুদ্রা! এটা উৎখননে পাওয়া।

উত্তর ভারতীয় কালো মসৃন মৎপাত্র। বাংলায় সময়কাল ধরা খ্রী:পূ ৪০০ থেকে খ্রী: ১০০ পর্যন্ত। এটা এক ধরনের অভিজাত মৃৎপাত্র ছিল, সাধারণত কালো তবে লাল রং এরও হয়।

স্বল্প মূল্যবান পাথরের পুতি। এটা স্থানীর ভাবে সোলেমানী গোটা বলে!
ওয়ারী বটেশ্বরে সব চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে এই পুতি, কোন কোন টা ইনপারফোরেটে (মানে তখনও ছিদ্র করা হয়নি), ফ্লেক। পাথরের মধ্যে জেসপার, চেলসিডনি, এগেট, কার্লেনিয়ান ইত্যাদি। মজার ব্যাপর হলো এই পাথর গুলোর কোনটাই আমাদের দেশে পাওয়া যায় না।
এই সকল বিষয় গুলোর উপর ভিত্তি করে ধারণা করা হয়, এই অঞ্চলটা ছিল পুতি তৈরির কারখানা, কাচাঁমাল আসতো বাইরে থেকে। এই অঞ্চলের পুতি সিল্ক রোড ধরে রপ্তানী হতো ভুমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে!

কার্লেনিয়ান পাথরের তৈরি টাইগার এমুলেট। প্রাচীন সময়ে এই ধরনের পশু পাখি আকৃতির লকেটে ব্যাবহার দেখা যায় বিভিন্ন সংস্কৃতিতে, ধারণা করা হয় এগুলো সেই সব প্রানীর শক্তির প্রতীক!

২০০৮-২০১০উৎখননে আবিস্কৃত মন্দিরধাপে অবস্থিত বৌদ্ধ লোটাস টেম্পল! চারিদিকে প্রদক্ষিন পথ পাওয়া যাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে এটা একটা বৌদ্ধ মন্দির।

ছবির ডান দিকের উপরের কোন পদ্মটি!

উৎখননের পরে এভাবে ঢেকে রাখা হয় স্থাপনা গুলো!

জাঙ্খারটেক বৌদ্ধ বিহার। এখন পর্যন্ত উৎখননে এখানে তিন চারট কক্ষ আবিস্কৃত হয়েছে।

উৎখননের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত গুলো ভিডিও ডকুমেন্টেশন করা হয়। (মেঝেতে উপুর হয় শুয়ে আছে গামছা মাথায় সোহার বাবা


মোস্তাফিজুর রহমান লাল স্যারের তত্বাবধানে চলছে শুঙ্গ ফলকটির ক্লিনিং। (পাশে সোহার মা


প্রতি বছর উৎখনন চলাকালিন সময়ে চলে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তু নিয়ে ওপেন এয়ার মিউজিয়াম প্রদর্শনী।
জাহাঙ্গীর নগর প্রত্নতত্ব বিভাগের শিক্ষক শাহ সুফি মোস্তাফিজুর রহমান স্যারের নেতৃত্বে প্রতি বছরের মতো এবারও শুরু হতে যাচ্ছে শীতকালিন উৎখনন কাজ। উৎখননের উদ্বোধন হবে ২৪ ডিসেম্বর।
যদি যেতে চান নিজের শেকড় খুজঁতে, দেখতে চান নিজের প্রাচীন সেই গৌরবময় নিদর্শন গুলো তাহলে যে কোন দিন বেরিয়ে পরুন। ঢাকা মহাখালী থেকে ভৈরবগামি বা সিলেট রোডের যে কোন গাড়ি উঠে পড়ুন, নামতে হবে মরজালে। এর পরে রিক্সা বা সি এন জি নিয়ে 'খনন দেখতে যাবো' বললেই তারা নিয়ে যাবে অভিস্ট লক্ষে

শুভকামনা রইলো উৎখনন টিমের জন্য..........
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১২ বিকাল ৫:৩৮