নেফারতিতি!
তুমি হতে পার সুপ্রাচীন প্যাপিরাসের পাতায় বিস্মরন,
দৃষ্টির অন্তরালে যাপিত কুয়াশা জড়ানো মায়াজাল
নীল চাঁদ আকাশে তিন সহশ্রাব্দ রাত্রির অপার ঘুম; অথবা,
জোনাক জ্বলা মিটিমিটি আধো আলো-ছায়ার অঘোর নিরবতা
নেফরেতিতি, প্রাচীন মিশরীর এই রানী তাঁর অসাধারণ সৈন্দর্য্যের জন্য মৃত্যুর হাজার বছর পরে আজও পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে আছেন। অনেক ঐতিহাসিকদের মতেই তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী, এখনও প্রকৃত সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসেবে নেফ্রেতিতিকেই বিবেচনা করা হয়। ১৯১২ সালে এক প্রত্নতাত্বিক উৎখননের নেফ্রতিতির একটা অসম্পূর্ণ অবাক্ষ মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছিল, এই মুর্তির মুখ সৌষ্ঠ্যব এই বিংশ শতকের কসমেটিক সার্জারির আউটলাইন হিসেবে অনেকই ব্যবহার করে!
তিনি তাঁর অসাধারণ সৌন্দর্যের পাশাপাশি দৌর্দান্ড প্রতাপশালী সম্রাগিও ছিলেন। তাঁর রাজত্ব কাল মাত্র ১২ বছেরের হলেও সম্ভবত তিনিই পৃথিবীর এখন পযর্ন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী, ক্ষমতাধর নারী।
বার্লিন মিউজিয়ামে রক্ষিত নেফ্রতিতির অবাক্ষ মূর্তি
নেফারতিতি ছিলেন মিশরীয় ফারাও চতুর্থ আমেনহোটেপ (১৫৫০-১ খ্রী পূ প্রধান স্ত্রী। তাঁর বংশপরিচয় নিয়ে এখনও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়ে গেছে। অনেকে ধারণা করেন সে, উত্তর ইরাকের কোন রাজ্যের রাজকণ্যা হতে পারেন, আবার কারো কারো মতে তিনি তৃতীয় আমেনহোটেপ আর তার প্রধান মহিষী টিয়ার সন্তান। এটাকে যদি সত্যি ধরা হয় তাহলে আবার আরেকটা সমস্যা সৃষ্টি হয়, চতুর্থ আমেনহোটেপ তাহলে কে ছিলনে? তিনি কি তাহলে তৃতীয় আমেনহোটেপ এর পুত্র নয়, নাকি নেফ্রেতিতি তার ভাইকে বিয়ে করেছিলনে(এটা অবশ্য তৎকালীন মিশরে রেওয়াজ ছিল, যেমন আমরা দেখেছি ক্লিওপেট্রার ক্ষেত্রেও)।
ফারাও চতুর্থ আমেনহোটেপ মিশরে নতুন ধর্মমত একেশ্বরবাদের সূচনা করেছিলেন। এই ধর্মমত কিন্তু পরবর্তিকালে হিব্রুবাসী ইহুদিদের প্রভাবিত করেছিল। তিনি দীর্ঘদিনের আমন-রে উপাসনার পরিবর্তে একেশ্বরবাদী সূর্যদেবতা আতেন উপাসনার সিদ্ধান্তে নিয়েছিলেন এবং এই পুরো সময়টাতে তাকে সমর্থন দিয়েছিলেন তাঁর অন্যতম সহধর্মিনী নেফ্রেতিতি। এর ফলে মিশর জুড়ে আমুন-রে অনুসারী পুরোহিতদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তাঁরা একত্র হয়ে সশস্ত্র আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়, অনেক রক্তপাতের পরে এদের কঠোর হাতে দমন করে আমেনহোটেপ এবং নেফেরেতিতি।
অবশ্য কোন কোন ঐতিহাসিকদের মতে সূর্য দেবতা আতেন এর এই নতুন ধর্মমতটি প্রবক্তা নেফরেতিতি নিজেই ছিলনে। নতুন ধর্মমত প্রবর্তন করার পরে নেফেরতিতি তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন নেফরেনেফিরেতেন-নেফরেততি, যার অর্থ "সূর্যদেবতা আতেন উজ্জল হয়েছেন, কারণ সৌন্দর্যের আধার এসেছে"। একই সময় আমেনহোটপও তাঁর নাম পরিবর্তন করে রাখেন ইখানাটন।
সন্তান সহ সূর্যদেবতা আতেনর উপাসনার নেফ্রেতিতি এবং চতুর্থ আমনেহোটেপ
প্রত্নতাত্বিক এবং ঐতিহাসিক সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে অনুমান করা যায় সুন্দরী এই রাণী শুধু সৌন্দর্য্যের আধার ছিলেন না, মিশরীর ১৮ রাজবংশের আমরান শাসনেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ প্রতক্ষ্য প্রভাব ছিল। এই সময়কার প্রাপ্ত নিদর্শনে তাঁর ব্যাপক উপস্থিতি প্রমাণ করে যে স্বামী আমেনহোটেপের উপর তাঁর প্রভাব ছিলো অনেক বেশি। আমেনহোটেপের রাজ্বত্ব কালের প্রথম পাঁচ বছরের যত রিলিফ পাওয়া গেছে তাতে আমেনহোটেপের চাইতে নেফারতিতির উপস্থিতির পরিমান প্রায় দ্বিগুন।
ধারণা করা হয়, তৎকালিন মিশেরর ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে নেফারতিতির প্রতক্ষ্য ভুমিকা ছিল। বিভিন্ন রিলিফে তাকে পুরোহিত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাকে সূর্যদেবতা আতেনের উপাসনাও করতে দেখা যায়, যে কাজ গুলো অন্য কোন রাণীকে কখনো অধিকার দেয়া হয়নি। এমন কি নেফ্রেতিতির সাজ পোষাকও ছিল সূর্যদেবতার স্ত্রীর মতো। কানারাকের রিলিফে দেখা যায়, তাঁর পরনে লম্বা আলখেল্লার মতো পোষাক, কোমরের কাছে লাল ফিতা বাঁধা, চুল ছোট ঘাড় পর্যন্ত।
এলোচুলে তিনি স্বামী আমেনহোটেপের সাথে সূর্য দেবতাকে নৈবদ্য দান করেছেন।
রাণী হিসেবে এমন অনেক ভুমিকায় তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেটা শুধু সে সময়রের রাজারাই করত। যেমন তাকে প্রায়ই ফারাওয়ের মুকুট পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত অবস্থায় উপস্থান করা হয়েছে।
নৌকায় যুদ্ধরত নেফ্রতিতি
চলে গেছ তুমি অস্তাচলে, বাষ্পচাকতির অরুণাভা পেরিয়ে
উড়ন্ত কাশফুল আচ্ছাদনে মেঘদলে বিষাদ-পাখি হয়ে ।
রাতজাগা জোৎস্না বিলাসী তারার আলোর সেতু ধরে
ভোরের পর্দা তুলে স্বপ্নের ব্যালকনির পথে এসেছিল তুমি!
হে প্রাচ্য সুন্দরী
নক্ষত্র-রোদনে আরো নীলচে হয়েছে নীল নদ,
রুপালি রোদের মিছিলের নিবিড় জোছনা পথে ।
রাতজাগা জোৎস্নার রাতে মেঘ করেছে সাম্রাজ্য বিস্তার
জোৎস্না ঝরে গেছে, ফিরে আসে না সে আর
আমরানা শাসন আমলের দ্বাদশ বছর থেকে হটাৎ করেই এই প্রতাপশালী রানীর আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি, না কোন ঐতিহাসিক উপাদানে, না কোন প্রত্নত্বাত্বিক সাক্ষ্যে।
কি হয়েছিল তাঁর??
কারো কারো মতো হয়তোবা সে সম্রাটের বিরাগভাজন হয়ে উঠেছিলেন একসময়ে। তার ছয়টি মেয়ে সন্তান ছিল, কোন পুত্র সন্তান ছিল না। বংশধর হিসেবে ছেলের দরকার ছিল, নেফ্রেতিতির উপস্থিতিতে হয়তো অন্য কোন রাণীর পুত্রকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নির্বাচন সম্ভব না মনে করেই কি তাকে সরিয়ে দেয়া হলো চিরতরে!!
আবার কারো কারো মতো ৪র্থ আমনেহোটেপের পরবর্তি ফারাও সিমেনখারেই (আমনেহোটেপের শ্যালক ) হলেন নেফরেতিতি।
নেফরেতিতির অন্তর্ধানের পরে হটাৎ করেই শাসনক্ষেত্রে সিমেনখারের গুরুত্ব বেড়ে যায়। অনেক ঐতিহাসিকদের মতেই বিশেষ রাজনৈতিক কারণেই হয়তো নেফরেতিতি পুরুষবেশে সামেনখারে হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিলেন।
ভিন্ন মতনুসারে আমেনহোটেপের রাজত্বের পরে মিশরের আমনে-রে পন্থী পুরোহিতদের হাতে তিনি নিহত হন।
শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল এই প্রতাপশালী রানীর, এখনও রহস্যমন্ডিতই রয়ে আছে। তাঁর মমি এমনকি ব্যবহার্য কোন উপাদানও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, হয়তোবা মিশরীয় পুরোহিতরা মিশরের সোনালী বালুর অতলে লুকিয়ে রেখেছেন তাঁকে।
স্বপ্নময় চোখ, অপার্থিব লাবণ্যে বিস্ময়ের রাজকুমারী তুমি
অহোরাত্রি তোমার অপেক্ষায় দিন গুনি।
ক্লান্ত প্রাচীন শিশির রাতভর ঝরে পরে মৌনতায়,
মরীচিকার গোধূলিতে অনুপ্রাস প্রতিধ্বনি শুনি
নেফারতিতি!
নেফারতিতি!
নেফারতিতি!
কবিতার অংশ গুলো প্রিয় কবি ফাহাদ চৌধুরীর লেখা কবিতাঃ নেফারতিতি! এবং একটি ঐতিহাসিক ডকুমেন্টরী থেকে নেয়।
তথ্য সূত্র:
Joyce.......... Nefertiti: Egypt's Sun Queen
Grimal Nicolas.................. History of Ancient Egypt
ইমন জুবায়ের ভাইয়ের পোস্ট..........আতেন-এর জন্য রক্তপাত!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১২:৩৯