প্রত্যাশা, প্রাপ্তি ও পরিণাম (প্রথম পর্ব)
আমি জানি আমার পাপের কোন ক্ষমা নেই। কিন্তু তাই বলে আমি তো এত ব্যড় পাপ করি নাই যে এর পরিণাম আমাকে এত ভয়াভব ভাবে পেতে হবে। বিধাতা আপনি আমাকে এত বড় শাস্তি না দিলেও পারতেন। আপনি যদি এই কঠোর শাস্তি আমাকে দেবেন, তবে মৃত্যুর পরে শাস্তির জন্য নরক কেন তৈরি করে রেখেছেন। পাঠক আপনিই বিচার করুন বিধাতা আমার প্রতি সদাচরণ করেছেন কিনা।
আমার ও ইমরানের বিয়ের বয়স তিন বছর। বিয়ের আগে আমরা একে অপরকে ভালোভাবে চিনতামও না। দু-একবার চোখাচোখি হয়েছে মাত্র। ওকে দেখে আমার কোন অনুভুতি আসেনি বা আসতো না। কিন্তু যখন থেকে শুনলাম অর সাথেই আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে তখন থেকে কোন অদ্দৃশ্য এক কলকাঠির অণু-নরণের ফলে ইমরানের কথা ভাবতে আমার ভালো লাগতো, ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে আমার ভালো লাগতো। কল্পনায় নিজেকে যখন ওর সাথে বিছানায় দেখতাম অদ্ভুত এক অনুভুতি তখন আমার ভেতরে কাজ করতো। আনুভুতিটা ঠিক ভয় না আবার ভয়ও। নিঃশ্বাসের বাতাস ভাড়ি হয়ে উঠতো। এখন আর সেই অনুভুতি পাইনা। এখনকার অনুভুতিটা কেমন যেন একটা বাসি-বাসি একটা ভাব। যা একটা কাপর বহু ব্যাবহারে মলিন হয়ে গিয়েছে। আর এই কারনেই হয়ত কিছুদিনের মধ্যেই স্বামী-স্ত্রীরা একে অপরের উপর থেকে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। আমি ভেবে পাইনা তারা কি করে বছরের পর বছর একসাথে সংসার করে। আমি বিশ্বাস করি যারা স্ব-চ্ছাই ছারা-ছারি করে ফেলে, সে সমস্ত দম্পতিরা জীবনের চরম বাস্তবতকে মেনে নেয়।
বিয়ের পর আমি জানতে পারি, আমার স্বামী ইমরানের কাছে সবচাইতে প্রিয় বস্তু তার ক্যারিয়ার। নাওয়া-খাওয়া ভুলে ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠার জিকির করতে থাকে। আমি কিংবা তার পরিবারের অন্য কোন সদস্য যে এই ধরাধমে অবস্থিত আছে এ কথা যেন মহাশয়ের মনেই থাকেনা । ভবিষ্যতের সুখ স্বপ্ন সবসময় তার চোখের তারায় ভাসে। যখনই তার সাথে কথা বলতে যাই তার আচরণ এমন হয় যে অন্যকোন ভুবনের বাসিন্দা আর আমারা সবাই বুঝি খুব নিচু চিন্তার ভুবনের বাসিন্দা।
বিয়ে যখন করেছি তখন সন্তান নিতেই হবে। আমার জীবনেরও সবচাইতে বড় স্বপ্ন সুন্দর ফুটফুটে একটা সন্তানের। বহু কষ্টে আমার স্বামীর সাথে আলোচনা করতে পারলেও এ ব্যাপারে সে কোন কথা শুনতে বা বলতে কোনটিই চাইতনা। আমিও নাছোরবান্দা। এক সময় জানতে পারলাম ইমরান আসলে ক্যারিয়ারে সফল না হওয়া পর্যন্ত সন্তানের বাবা হতে চাইছে না। এ কথা শুনে আমরা চিন্তাধারা তখন অন্য খাতে বইতে লাগলো। আমি ভাবতে থাকলাম, ইমরান যদি কোন দিন ভালো একটা কায়রিয়ারে সফল না হয় বা করতে পারে তবে সে খখন সন্তান নেবে না। এবার কেন জানি লোকটাকে আমার ঘৃনা লাগতে শুরু করলো। আমার প্রতিটা বান্ধবী অন্তত যাদের বিয়ে হয়ে গেছে, তারা প্রত্যেকে এখন সন্তানের জননী। প্রত্যেকের বাচ্চারা হেসে-খেলে বেরায় অথচ আমি এখনও জানিনা, আমার কোল পূর্ণ হিবে কিনা, হলেও কবে হবে। এক প্রকার দাবী নিয়েই ইমরানকে প্রশ্ন করলাম কবে নাগাদ আমি সন্তানের মা হতে পারবো।
সে কোন সদুত্তর দিতে পারেনা। আমার বুকের ভেতরটা হটাৎ করে শুন্য আনুভূত হয়। রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা যা কিছু থাকলে একজন নারীর পক্ষে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে তার সবকটা আমার উপর ভর করে। আমি মনকে পাথর করি। আমি জান এখন যদি এ ধরণের শারিরীক বা আত্মীক সিদ্ধান্ত নেই তবে জয়টা ইমরানেরই হবে। বোঝার চেষ্টাকরি এ মুহুর্তে আমার কি করা উচিৎ, এই অবস্থায় যদি আমার মা থাকতো তবে তিনি কি করতেন আমি জানতে চাই। হয়তো কিছুই করতেন না, কারন তিনি এ অবস্থায় কখোনই পরতেন না। শুধু এই একটা কারনে সংসারে এক প্রকার অশান্তি সৃষ্ট হল। ঘটনা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে দাড়াল যে ইমরান খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া বাড়িতে সময় কাটানো বন্ধ করে দিলো। যেন ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না।
যখন কোন কিছুতেই কাজ হলোনা তখন সেই প্রেক্ষাপটে হিন্দি সিরিয়াল দেখে বেশ চমৎকার একটা বুদ্ধি মাথায় এলো। আমি ঠান্ডা মাথায় ভাবতে লাগলাম ইমরানের বাবা না হতে চাওয়ার পেছনে কারন গুলো ঠিক কি কি? এক নম্বর ক্যারিয়ার। এদিক অদিক থেকে এই সদ্ধান্তে আসতে পারলাম না যে তার বাবা না হওয়ার পেছনে ক্যারিয়ারে সাফল্যা হতে পারে। কারন তার যে ইনকাম কম এ কথা কোন ক্রমেই বলা যাবে না। এই শহরের বুকে একটা না তিন-তিনটা শিশুকে প্রতিপালন করার সামর্থ্য তার আছে। অতএব আপাত দৃষ্টিতে বা তার ভাষ্য মতে ক্যারিয়ার হলে আদৌতে ক্যারিয়ার নয়। একটু খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলাম অন্য কোন জায়গায় ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছে না’তো। খবর পেলাম অফিসে তার কলিগ শাহ্রিন ছাড়া অন্য কোন মেয়ের সাথে সেরকম সম্পর্ক নেই। খোজ নিয়ে জানতে পারলাম শাহ্রিনের শুধু যৌবনই নয় জীবনও শেষের পথে। তিনি তিন ছেলে-পুলের জননী। তিন বছর আগে ঐ বৃদ্ধার বড় মেয়ে মারা গেছেন বয়স-জনিত কারনে। বড় ছেলেটার বড় ছেলে এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। অতএব এই সম্ভবনাও আমি উড়িয়ে দিলাম। শেষ যে সম্ভবনা আছে সেটাকে সম্ভবনা হিসেবে না ধরলেও পারতাম। কিন্তু হাতের কাছে একটা বিষয় আছে যখন তখন সেটাকে নিয়ে গবেষণা না করে পারছিনা। ইমরানের বয়স পঁচিশ বছর আমার সাতাশ বছর। যদিও খুব একটা বেশী না কিন্তু গুরুত্ব না দেয়ার মত ব্যাপারও না। তার আচরণে এই ব্যাপারটা এতদিন আমার চোখে ধরা পরে নি। তবে আর অন্য কোন কারন থাকলেও থাকতে পারে যা আমি ভেবে পেলাম না।
প্রিয় পাঠক আপনার কাছে এর পরের ঘটনাটা একটু কাকতালীয় লাগলে লাগতে পারে। কিন্তু ঘটনাটা আমার জীবনে কিভাবে ঘটে গেলো আমি তা বুঝতেও পারলাম না।
সময়টা ছিলো বর্ষা কাল। আকাশা স্বাভাবিকের চাইতে একটু বেশিই মেঘলা। আমার মা হটাৎ করেই বাথারুমে পিছলে পড়ে যান। বাড়িতে শুধু মাত্র বাবা ছিলেন। অনেক কষ্টে তিনি মাকে মেডিকেল পর্যন্ত নিয়ে আসেন এবং ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়ে দেন। এ দেশের সরকারী হাসপাতালগুলো নরক সমান।বেড থাকতে টাকার অভাবে রোগীদের ফ্লোরে ঘুমোতে হয়। সহজে কেবিন পাওয়া যায় না। ডাক্তারদের পিছনে ঘুর-ঘুর করতে হয় কেবিনে জন্য। বাবা অনেক কষ্টে মা’র জন্য একটি কেবিনের ব্যাবস্থা করেন।
সেদিন বিকেলে আমার শশুর বাড়িতে ফোন করলেন বাবা। আমি তখনই বেড়িয়ে গেলাম বাড়ি থেকে। বৃষ্টি বাদলার দিন, রাস্তা-ঘাট এমনিতে বেশ ফাঁকা। হাসপাতালে ইদানিং পাসের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। পাস ছাড়া ভিজিটরদের রোগী দেখতে দেওয়া হয় না। পাস সংগ্রহ করতেও টাকা লাগে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোক গুলোকে টাকা দিয়ে পাস সংগ্রহ করা সহজ। তা-না হলে এদিক সেদিক ঘুরো-ঘুরি করে পাস সংগ্রহ করা বেশ কষ্ট সাধ্য কাজ। সুন্দরী মেয়েদের সব জায়গাতেই অগ্রাধিকার একটু বেশিই থাকে। ভিতরে প্রবেশ করতে আমাকে বেশি বেগ পেতে হলো না।
মায়ের কপালের এক কোণে কেটে গেছে মারাত্বক ভাবে। ডাক্তার সেলাই করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন। কোমরেও আঘাত পেয়েছেন গুরুতর। রুপালী রঙের চশমার ফ্রেম ওয়ালা ডাক্তারটা বললেন ‘শরীরে পুষ্টির অভাব দেখা গেছে। ঠিক মত খাওয়া-দাওয়া করেন না।’
আমি মায়ের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালাম, বোঝাতে চাইলাম__ এসব কি শুনছি? ডাক্তার সাহেব কিছু ভিটামিন ও ব্যাথার ট্যাবলেট দিয়েছেন নিয়মিত খাবার জন্য। আর পুষ্টিকর খাবার খেতে বলেছেন বেশি করে। ডাক্তার সাহেব আরো জানালেন খুব শিঘ্রই তিনি সেরে উঠবেন এবং আগের মতো চলাফেরাও করতেও পারবেন। এরপরের সময়টা একঘেয়ে। মায়ের সাথে কিছু আনুষাঙ্গিক বিষয় নিয়ে গল্প করলাম, বাবার বনসাই গুলো কেমন আছে? পিচ্চি বিড়ালটা এখনও কি পিচ্চিই আছে নাকি কিছুটা বড় হয়েছে এই সব।
বর্ষাকালে তারাতারি সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। মায়ের কাছে সাতটার সময় বিদায় নিলাম। তখনও অন্ধকার একেবারে পুরোপুরি নেমে আসেনি। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বেড়িয়ে এলাম বারান্দার মত প্যাসেজে। সামনেই গাইনী ওয়ার্ড, ওয়ার্ডটা একটু বেশিই নোংরা, সব সময় স্যাত-স্যাতে একটা ভাব থাকে। নাকে-মুখে রুমাল গুজে ওয়ার্ডের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। জঘন্য গন্ধের কারণে কোন দিকে না তাকিয়ে দ্রুত ওয়ার্ডটা পার হওয়ার জন্য জোড়ে জোড়ে পা চালালাম। দ্রুত বর্ধনশীল জনগোষ্ঠীর দেশে এই ওয়ার্ডটা অন্যান্য ওয়ার্ডগুলোর থেকে একটু বড়ই বলা চলে। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির কারণে হাসপাতালটা বেশ ফাঁকা।
হটাৎ বারান্দায় এক মহিলার দিকে আমার দৃষ্টি আটকে গেলো। বাড়ান্দায় কাঁথা বিছিয়ে শুয়ে আছে মহিলা। বুকের কাছে তার সন্তান। দুজনেই ঘুমুচ্ছে কুম্ভকর্ণের মতো। এমন ভরা সন্ধ্যা বেলায় কেউ নাক ডেকে ঘুমুতে পারে মানুষ! আমার একটু অবাকই লাগলো।
ওদেরকে পাশ কাটিয়ে কয়েক কদম চলে এলাম আমি। হটাৎ ঐশরিক কোন আদেশে আমি দাঁড়িয়ে পরলাম যেন। কেউ আমার মনকে যেন একটা পাপ করতে বলছে। আমি জোড় করে চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলাম। এই পাপ মানসিক ভাবে অতিক্রমের ক্ষমতা আমার নেই। পাপটা এমনই যা কখোন কোন নারীকে করতে হয় না। কিন্তু আমি করার জন্য ব্যাস্ত হয়ে গেলাম। শয়তানই হবে কিনা কে জানে আমার উপরে ভর করেছিলো হয়তো, তা-না হলে এমন চিন্তা আমার মাথায় আসবে কেন?
চলবে...
[কিছুটা স্বপ্নে পাওয়া ও বস্তবতার সমন্বয়ে একটি বড় গল্প। ব্যাবহৃত স্কেচটি আমার আর্ট বুক থেকে। ভয়ে ভয়ে লিখেছি সহিত্য বোদ্ধাদের অনুমতি থাকলে পরবর্তি পর্ব গুলো পোস্ট করবো।]
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন