পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ধর্ম। এমনকি যারা পুরোপুরি ধার্মিক নয় তারাও ধর্মের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। প্রশ্ন হল কেন তারা ধর্মের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে?
সামাজিক বিশ্বাসের মধ্যেই এর কারণ নিহিত রয়েছে। আমরা আমাদের সমষ্টিগত ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হই। এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি যারা বিশ্বাস করেন যে, ধর্ম ছাড়া আমারা অচল।
সমাজের প্রয়োজনেই ধর্ম প্রয়োজন যা মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করবে। আজকের দিনে যত আইন-কানুন রচিত হচ্ছে তার অধিকাংশই ধর্মীয় শিক্ষার উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। সৎ মানুষ গড়তে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা আছে বা নাই বলে অনেকে তর্ক করলেও মূল কথা হল সামাজিক আইন গুলো ব্যাপকভাবে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত। ধর্ম ছাড়া আমাদেরকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সমাজে বসবাস করতে হবে।
ধর্ম বিভিন্ন কারণে সমাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামাজের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ সহজেই প্রচলিত সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হয়। ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ধর্ম নিম্নলিখিত ভূমিকা পালন করে:
১। ধর্ম মানসিক প্রশান্তি দান করেঃ
মানব জীবন অনিশ্চিত। মানুষ অনিশ্চয়তা , নিরাপত্তাহীনতা এবং বিপদের মাঝে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে। মাঝে মাঝে সে অসহায় বোধ করে। এই অসহায়ত্বের মাঝে একমাত্র ধর্মই তাকে সান্তনা দান করে এবং জীবন সম্পর্কে উৎসাহিত করে। ধর্ম তাকে সঠিক আশ্রয় প্রদান করে। সে ধর্মের মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি ও মনোবল লাভ করে। এটা তাঁর জীবন ও সমস্যা মোকাবেলা করতে উৎসাহ দেয়।
২। ধর্ম মানুষের দুঃখের ব্যাখ্যা প্রদান করেঃ
শুধু জ্ঞানের দ্বারা মানুষ বাঁচতে পারে না। মানুষ আবেগপ্রবণ প্রাণী। দুর্ভোগ ও হতাশার সময়গুলোতে ধর্ম মানুষের আবেগের উপর প্রভাব বিস্তার করে। স্রষ্টার উপর বিশ্বাস মানুষকে এই বিশ্বাস যোগায় যে, তার দুঃখ কষ্টের মাঝে কোন অলৌকিক শক্তি তার সমস্যা দূর করতে সক্ষম বা তার জীবনের দুঃখ কষ্টও নিরর্থক নয়। এইভাবে ধর্ম মানুষের দুঃখ লাঘব করে এবং বিপদকালীন ভয় দূর করে। ধর্ম মানুষকে তার পরাজয়ের গ্লানি দূরীকরণে এবং তার ব্যক্তিত্ব বজায় রাখতে সহায়তা করে।
৩। ধর্ম সামাজিক গুণাবলীকে সুসংহত করেঃ
ধর্ম মানুষের প্রধান সামাজিক গুণাবলী যেমনঃ সততা, অহিংসা, সেবা, প্রেম, শৃঙ্খলা ইত্যাদিকে সুসংহত করে। একজন ধর্মানুসারী এই সকল গুণাবলী আত্মস্থ করে এবং সমাজের একজন সুশৃংখল নাগরিক হিসাবে পরিগণিত হয়।
৪। ধর্ম সামাজিক সংহতি বৃদ্ধি করেঃ
ধর্ম ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সমাজবিজ্ঞানের জনক ডারখাইম (Durkheim)দেখিয়েছেন যে, ধর্ম সামাজিক সংহতিকে শক্তিশালী করে। এ,ডব্লিউ গ্রীন চিহ্নিত করেছেন যে, মানব সমাজে ধর্মের আছে সর্বোচ্চ সংহতি এবং যাচাই বল। এটা সত্য যে, সাধারণ বিশ্বাস, সাধারণ অনুভূতি, প্রার্থনা, সমষ্টিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান ইত্যাদি হল উলেখযোগ্য সামাজিক উপাদান যা একতা ও সংহতি জোরদারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৫। ধর্ম পশুত্বকে মানবিক গুণাবলীতে রূপান্তরিত করেঃ
ধর্ম মানুষকে স্বপ্রণোদিত হয়ে দয়ালু এবং পরোপকারী হতে উদ্বুদ্ধ করে। বিভিন্ন ধর্মীয় আচার, বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সে পার্থিব জীবন ও সমস্যার কথা ভুলে যায়। এভাবে একজন মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতাকে ভর করে পাশবিকতাকে বর্জন করে মানবিক গুণাবলী অর্জন করতে সক্ষম হয়।
৬। ধর্ম সামাজিক নিয়ন্ত্রণের একটি মাধ্যমঃ
ধর্ম জীবনযাপনের একটি মডেল হিসাবে কাজ করে। এটা মানুষের আদর্শ্ ও মূল্যবোধকে সমুন্নত করে। ধর্ম বিশ্বাসী এই আদর্শ ও মূল্যবোধকে তার জীবনে আত্মস্থ করে। ধর্ম যুব সামজকে নৈতিকতা, শৃঙ্খলা ও সামাজিকতা শিক্ষা দেয়। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেমনঃ মসজিদ, মন্দির, চার্চ, পেগোডা ইত্যাদি জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষে ব্যক্তিগত চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণ করে।
৭। ধর্ম কল্যাণ প্রচার করেঃ
ধর্ম সাধারন জনগনের উন্নত সেবা ও কল্যাণেে শিক্ষা দেয়। ধর্ম মানুষকে এই বার্তা পৌছে দেয় যে, "মানবতার সেবাই স্রষ্টার সেবা"। এই কারণে মানুষ দুঃখী জনকে অন্নদান করে ও তাদের দুঃখ মোচনে অর্থ ব্যয় করে।পৃথিবীর বড় ধর্ম গুলো যেমনঃ ইসলাম, হিন্দু ও খৃষ্টান ধর্ম দরিদ্র ও নিঃসকে দান করার উপর ধর্মীয়ভাবে গুরু্ত্ব আরোপ করেছে। ধর্মীয় বিশ্বাস ও বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের প্রভাবে মানুষ নিজেদেরকে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত করে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সেবার লক্ষ্যে মসজিদ, মন্দির, আশ্রম, হাসপাতাল, স্কূল, কলেজ ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে এবং শিক্ষা বিস্তারে বিভ্ন্নি সংগঠন গড়ে তোলে।
৮। ধর্ম মানুষকে আনন্দ দেয়ঃ
ধর্ম মানুষকে চমৎকারভাবে বিনোদন প্রদান করে। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব কম বেশী সকল ধর্মের মানুষকে তাদের মানসিক চাপ থেকে স্বস্তি দেয়। একইভাবে ধর্মীয় বক্তৃতা, ওয়াজ মাহফিল, ভজন , কীর্তন, বাদ্যযন্ত্র স্তবগান ইত্যাদি ধর্মীয় সংগীত মানুষকে অনেক বেশি আনন্দ ও বিনোদন প্রদান করে।
৯। ধর্ম সামাজিক যোগাযোগের একটি উৎস হিসেবে কাজ করেঃ
ধর্ম সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম একটি উৎস। সমাজের প্রয়োজনে সামাজিক মূল্যবোধের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের ও অন্যের কর্ম নিয়ন্ত্রণ করে এবং সমাজের ভিত্তিকে চিরস্থায়ী রূপ দান করে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এই মূল্যবোধ তৈরী করতে পারে না।সন্তান তার পিতামাতাকে মান্য করবে, সদা সত্য কথা বলতে হবে, স্বামী-স্ত্রী উভয়ে থাকবে বিশ্বস্ত, সৎ ও পূন্যবান হতে হবে এবং সামাজিক সু-সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে ইত্যাদি মূল্যবোধ ও গুণাবলীর ভিত্তিই হল ধর্ম।
১০। ধর্ম অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেঃ
সমাজবিজ্ঞানী সমবার্ট এবং ম্যাক্স ওয়েবার সঠিকভাবে ধর্ম এবং অর্থনীতির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ওয়েবার দেখলেন যে, প্রোটেষ্টেন্ট ধর্মমত পুজিবাদের অগ্রযাত্রাকে প্রভাবিত করেছে। তিনি ইহুদী রীতিনীতিতে পুজিবাদের প্রভাব লক্ষ্য করেন। বর্তমান স্বতন্ত্র খ্রীষ্টান প্রটেষ্টেন্ট নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত দেশ গুলোতে পুজিবাদ যেভাবে ভিত্তি গেড়েছে সেইভাবে কিন্তু ভারত , পাকিস্তান বা অন্য দেশ গুলোতে ততটা পুজিবাদী মনোভাব লক্ষ্য করা যায় না। হিন্দুরা যেমন বস্তু জগৎ থেকে আধ্যাত্মিক জগতের প্রতি বেশি মনোযোগী তেমনি মুসলমানেরাও জাগতিক উন্নতির পাশাপাশি পারলৌকিক উন্নতির প্রতি বেশি যত্নবান হতে দেখা যায়। তাই ভারত উপমহাদেশে বস্তুবাদী চিন্তা চেতনা তেমন প্রসার লাভ করতে পারেনি।
১১। ধর্ম রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেঃ
ধর্ম প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সমাজের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি বিশ্বের অনেক দেশে বর্তমান সময়ে ধর্ম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রম প্রভাবিত করছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে সম্রাটগণ নিজেদের স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে বা ঈশ্বরের নামে সমাজে ক্ষমতাসীন হয়ে সমাজকে শাসন করেছেন। এখনও রাজনৈতিক নেতাদের ঈশ্বর বা স্রষ্টার নামে শপথ গ্রহণ করতে দেখা যায়। ভুটান , পাকিস্তান , ইতালি , জার্মানি , ইংল্যান্ড সহবিশ্বের বিভিন্ন দেশে এবং আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা অনেকাংশে ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত।
১২। ধর্ম আত্ম-বিশ্বাসকে শক্তিশালী করেঃ
ধর্ম আত্মবিশ্বাস মজবুত করার একটি কার্যকর উপায়। কতগুলো বিশ্বাস যেমনঃ "কর্মই ধর্ম', "দায়িত্ব ঐশ্বরিক দান," ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত," ইত্যাদি ব্যক্তি জীবনকে ত্বরান্বিত করে এবং আত্ম-বিশ্বাসকে জোরালো করে।
সর্বশেষ কারণ হল ধর্ম এমন একটি বিষয় যা আমাদের কতগুলো বিশ্বাসকে আকড়ে ধরতে শেখায়। মানুষ এটা বিশ্বাস করতে চায় যে, সে যা করছে তার একটি নির্দিষ্ট কারণ আছে এবং তার জীবনের একটি উদ্দেশ্য আছে। ধর্ম তাদের এই কারণ ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে। এই জন্যই একজন মানুষ প্রতিদিন কাজে বের হয় এবং পৃথিবীটাকে সুন্দর ও বাসোপযোগী করে গড়ে তুলতে প্রানান্ত চেষ্টা করে যায়। তারা এমন করে, কারণ তারা বিশ্বাস করে প্রতিটি কাজেরই একটি প্রতিদান রযেছে। এটাই ধর্ম পালনের সবচেয়ে বড় দিক।
উপসংহারঃ
আমাদের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, ধর্ম মানব সভ্যতার কেন্দ্রীয় উপাদান। যুগ যুগ ধরে ধর্ম তার প্রয়োজনীয়তার প্রমাণ রেখেছে। ধর্ম মানুষের মৌলিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার প্রচারক হিসাবে কাজ করেছে যা সমাজ ও ব্যক্তিকে একীভূত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। যারা ধর্মের বিরুদ্ধে যুক্তি দেখান শেষ পর্যন্ত তাদেরও বুঝা উচিত যে, উপরোক্ত বিষয় গুলি আমাদের সমাজের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ন এবং এতসব কিছু মূল্যহীন নয়।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৬ সকাল ১১:৩৫