আমরা চিরজীবন একসাথে থাকার অঙ্গীকার করেছিলাম । ভাবতেই একদলা ঘৃণা গলায় উঠে আসল । হাহ! চিরজীবন! চার বছর বিতৃষ্ণা আর অসুস্থ কামনার আঘাতে মরতে মরতে আমি কয়েকটি জীবন কাটিয়েছি । প্রতিশ্রুতির প্রতি নিশ্চয় বিশ্বস্ত ছিলাম । শরীরজুড়ে অসংখ্য চাঁদের কলঙ্ক তার প্রমান । এই যে এখন আয়নার সামনে দাড়িয়ে একদা সতেজ মুখশ্রীতে হলুদ মরচে রঙের দাগটি চুল দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করছি সেটা তারই সাম্প্রতিক উপহার । অনেক পেয়েছি, আজ তাকে সব ফিরিয়ে দেব । হ্যা, ফিরিয়ে দেব সব অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রণা যা সয়ে এসেছি এতকাল, তারপর পালিয়ে যাব এই নরক ছেড়ে । আজকের দিনটির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি প্রায় দুই মাস ধরে । আমাদের যৌথহিসাব থেকে অল্প অল্প করে বেশ ভালো অংকের টাকা নিজের গোপন হিসাবে পার করেছি । বেজন্মাটা এখনো কিছু ধরতে পারেনি, যখন টের পাবে পাখি তখন ফুরুত । ধূর্ত শেয়ালের সাথে থেকে আমিও কিছুটা ধূর্ততা শিখেছি বলা যায় ..
সকাল থেকেই আকাশে বৃষ্টিহীন ধুসর মেঘ জমে আছে । আমার মনের মতই শান্ত গুমোট প্রকৃতি অপেক্ষা করছে বৃষ্টির । আমিও অপেক্ষা করছি .. শয়তানটির জন্য । মনে হয় তাড়াতাড়িই ফিরবে । এরকম দিনে মদ গিলে আমার শরীর ছিঁড়ে ছিঁড়ে অন্য কোন নারীকে ছুঁতে চায় সে । পারভার্ট .. ভাবতেই আরেকদলা ঘৃণা উগরে আসতে চাইল । আমি ভালবাসতে ভুলে গেছি । এই হারামির বাচ্চা আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে । প্রেমের স্পর্শের মধুর স্বাদ হাজার চেষ্টাতেও অনুভব করতে পারি না । অথচ সামান্য চড়ুই পাখির জন্যেও এই বুকে কত ভালবাসা ছিল ..
কি করিনি আমি ! স্বাভাবিক কোন মেয়ে করতে চাইবে না এরকম অনেক কিছুই করেছি আমি । শুধু তাকে সুখী করার জন্য .. কিন্তু সে তো এক অসুখী নেকড়ে, তাজা রক্তের গন্ধে মাতাল, বন্য । তারপরেও আমি নিয়তিকে মেনে নিয়েছি কারন না মেনে উপায়ও ছিল না । কোথায় যেতাম আমি, আমার বাবা-মায়ের কাছে! তারা তো নিজেরাই পরাজিত জীবন যাপন করছে, চাই নি তাদের বেঁচে থাকাকে আরও কষ্টকর করে তুলতে । তারচেয়ে আমি চেষ্টা করে গেছি আশা নিয়ে হয়ত একদিন বসবাসের স্থানটি নীড় হয়ে উঠবে .. একটা সময় পর্যন্ত । তার অনুমুতি ছাড়া গর্ভধারণ করেছিলাম বলে যেদিন সে গর্ভপাত না হওয়া পর্যন্ত আমাকে পিটিয়ে যাচ্ছিল সেদিনই সবকিছু শেষ হয়ে গেল । ডালপালা মেলতে শুরু করল হৃদয়ে ঘুমিয়ে থাকা ঘৃণার বীজটি । কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি .. শুধু আমার হাত দুটোকে তার গলা থেকে দূরে রাখার জন্য । আঁধারে ঘৃণার চাষ করে আমি ক্লান্ত .. একটিবারের জন্য হলেও এখন ঘুমাতে চাই । যদি সেটা হয় শেষ ঘুম, তবুও ..
বিকেলের দিকে ছিপছিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল । উঠে জানালা বন্ধ করতে গিয়ে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করলাম সে যেন বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত না নেয় । দুঃসহ অপেক্ষার জ্বালা ভুলতে সাজতে বসলাম । জানি সে সন্দেহপ্রবন হয়ে উঠতে পারে .. কিন্তু কেন জানি খুব সাজতে ইচ্ছে করছে । হলুদ ফুল ছাপা শাড়ি, সবুজ ব্লাউজ বের করে নিলাম । কাপড় বদলাবার সময় বুকের উপরে কালচে দাঁতের দাগটা চোখে পড়ল । কেমন করে ভালবাসার দাঁতে বিষ মেশাতে পারে মানুষ ! দূর ছাই ! চোখ ভিজে ওঠে কেন ? টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে আইলাইনার হাতে তুলে নিলাম । আজ আমি কাঁদব না .. কোনভাবেই না । হলুদ দাগটি ধর্তব্যে না আনলে লাল লিপস্টিক দেবার পর নিজেকে মোটামুটি সুন্দরীই মনে হল । সারা দিনে এই প্রথম হাসলাম । আমি এখনো নিজেকে সুন্দর ভাবতে পারি ..
ঘড়িতে পাঁচটা বেজে পার হবার পর ড্রয়ার খুলে একপাতা সিডেটিভ নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম । ছোট অথচ শক্তিশালী ঘুমপরীগুলোকে লুকিয়ে নিলাম ব্রার ভিতর । রান্নাঘরে গিয়ে পানি গরম তুলে দিলাম নুডুলস আর কফি করব বলে । এসেই হয়ত খেতে চাইবে সে .. সেটা হবে আমার প্রথম সুযোগ । রান্না শেষে সবটুকু নুডুলস বাটিতে তুলে রাখতে হল । যদিও খিদে পেয়েছে কিন্তু এক চামচ মুখে দিতেই বমি ভাব হওয়ায় সে চেষ্টা আর করলাম না । নিজের জন্য মগ ভর্তি করে ক্যাফে লাত্তে বানিয়ে বসার ঘরে এসে বসলাম । টেলিভিশনের পর্দায় দুজন মানুষ নিজেদের মধ্যে প্রেম, ঘৃণা অথবা অর্থহীন কোন বোধের বিনিময় করছে । এমনটা মনে হল কারন আমি তাদের ভাষা বুঝতে পারছিনা । বাইরে বৃষ্টির ঝিরঝির শব্দের শরীরে আমার কান ডুবে আছে । যেকোনো মুহূর্তেই ঝনঝন করে বাজবে সময়সঙ্কেত । বুকদুটো হাপরের মত উঠছে নামছে । ঘুমপরীরা অস্থিরভাবে জানতে চাইছে তারা কখন ঘুমাতে যাবে? আমি কি কিছু ভুলে যাচ্ছি! ঘুমপাড়ানি গানগুলিকে কি আমার কফির মগে মিশিয়ে দেব ..
প্রাচীরের ওপাশে একলা আকাশ ভাবে হাওয়ার তোড়ে কার মন ভেসে যায় ..
সবাই বৃষ্টি থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলছিল । কিন্তু কাজ শেষে অফিসে বসে থাকতে একদম ভালো লাগে না । খণ্ডকালীন এই কাজটি শুধু অতিরিক্ত স্বাধীনতা আর সচ্ছলতার জন্যই করা । নইলে মানুষের সঙ্গ আমি পারতপক্ষে এড়িয়েই চলি । পুরুষদের অযাচিত প্রগলভতা বা নারীদের কথাচালাচালি, কিছুর সাথেই আমি নিজেকে মেশাতে পারি না । তাই একপাশে থাকি, এককোণে একাকী । তারা ভাবে আমি অসামাজিক অথবা বোকা .. ভাবুক, নিজেকে নিয়ে সুখী না হতে পারি, অসুখীও তো নই । লিফট থেকে বের হয়ে মনমরা বৃষ্টি দেখে অবশ্য মনে হল, শীতাতপ উষ্ণতাকে অবহেলা করা ঠিক হয়নি । রাস্তায় পায়ের পাতা ছুঁতে চাওয়া জল, ভরসন্ধ্যাতেই রাতকে ডেকে আনা জনশূন্যতা, ঝিরঝির বৃষ্টির সাথে শীতল বাতাসের সঙ্গত । লম্বাহাতা কামিজের নিচেও লোমকূপে বাতাসের তীক্ষ্ণ শিহরণ । পথে নামবো কিনা এই নিয়ে খানিক দ্বিধায় ভুগলাম, যদিও সামান্য হাঁটা পথ দুরেই বাসস্টপ । শেষমেশ ওড়না মাথায় পেচিয়ে, জুতোজোড়া হাতে নিয়ে নেমে পড়লাম । সঙ্গে সঙ্গেই নিজের ভিতর টের পেলাম পাখির মত এক মন .. যে ভিজতে চায়, উড়তে চায়, হারাতে চায় ।
এই সময় বাসছাউনিটি ঘরফেরত মানুষদের কোলাহলে ভরে থাকে । আজ কেউ নেই । হয়ত সবাই অপেক্ষা করছে .. তারা তো আমার মত বোকা না । শরীর জুড়ে বৃষ্টিবিন্দুর নদী । ওড়না চিপে নিয়ে যতটুকু পারি পানি মুছে নিলাম দেহ থেকে । বাস কখন আসে কে জানে, ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে সেলফোন বের করে কানে হেডফোন গুঁজে দিলাম । ভেজা কাপড়ের নিচে জলের অবশিষ্ট শীতলতা, স্নায়ুর রন্ধ্রে রন্ধ্রে সুরের আবেশ আমাকে প্রায় নিদ্রাতুর করে তুলছিল । মাথায় তখন শেরিল ক্রোর গান বাজছে , ' you are my favourite mistake ' । এই সময় হলুদ ফুল ছাপা শাড়ি পড়া, বেগুনী ছাতা মাথায় মেয়েটিকে চোখে পড়ল । বৃষ্টিতে মানুষ দ্রুত হাঁটে কিন্তু মেয়েটির পায়ে যেন ভারী কিছু বাঁধা । তার ধীরগতিই আমার মনোযোগ কাড়ল কিম্বা তার হলুদ শাড়ির বক্রিম বিন্যাসও সেজন্য দায়ী হতে পারে । মেয়েটি যখন ছাতা গুটিয়ে আমার পাশে এসে বসল তার গালের কাটা দাগটাই প্রথমে নজরে আসল । তারপরেও আমি স্বীকার করতে বাধ্য হলাম মেয়েটি সাজতে জানে । রঙতুলির ছোঁয়ায় তার মুখ হয়ে উঠেছে বহুবর্ণা তৈলচিত্র এবং এই ক্যানভাসের নিচে কি লুকিয়ে আছে সেটা অনুমান করা মুশকিল ।
মেয়েটির সাথেকার ঢাউস ব্যাগটি দেখে মনে হতে পারে সে হয়ত অনেকদূর যাবে কিন্তু সেকথা জানার আগ্রহ আমার নেই । বরং তার অদ্ভুত উদাসীনতা আর বিষণ্ণ দৃষ্টির প্রতিই আমি আগ্রহ বোধ করছি । তার একহাত দূরত্বে কেউ বসে আছে সে ব্যাপারে তার কোন ভ্রূক্ষেপ আছে বলে মনে হচ্ছে না । সম্পূর্ণ নিজের মাঝে ডুবে আছে সে । বিদঘুটে অস্বস্তি পেয়ে বসল যখন মনে এল বিষণ্ণতায় আমিও এরকম নিজের মাঝে ডুবে যাই । যা আমি করি না কখনো, আগ বাড়িয়ে মেয়েটিকে কিছু বলতে চাইলাম । জলময় রাতের পর্দা ভেদ করে বাসের হলুদ আলোয় সেকথা উচ্চারিত হবার অবকাশ পেলোনা । আমি উঠে তাকে পাশ কাটালাম । সে তখনো বসে । বাস থামার পরও সে যখন উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকল তখনি আমি বুঝলাম, সে আসলে নিজের মাঝেই নেই । আমার ভিতরে কে নির্দেশ দিল জানিনা, পিছু ফিরে আমি তার হাত ধরে টানলাম, " আপু ওঠেন, বাস ছেড়ে দেবে তো ।"
শিশুর মত সে আমার হাত আঁকড়ে ধরল । একহাতে তার ভারী ব্যাগ, আরেকহাতে তার কব্জি চেপে ধরে আমরা বাসে উঠে পড়লাম । জীবন তার রাস্তার মোড়ে মোড়ে চমকের লন্ঠন ঝুলিয়ে দ্যায় । কখনো সেই আলোয় আমরা নতুন কোন পথ খুঁজে পাই, কখনো নিজেরাই ঢিল ছুঁড়ে পথে ছড়িয়ে দেই ভঙ্গুর কাঁচের জীবন ।