মেঠোপথে বা পরিত্যক্ত প্রান্তরে এক ধরনের ঝোপগাছে সাদা সাদা বুনোফুল ফোটে । ফুলগুলো মুখে দিলে মধুবিন্দুর তৃষ্ণাবর্ধক আস্বাদ পাওয়া যায় । সে ছিল সেই ফুলপরীদের একজন । অভিভাবকদের অনুপস্থিতিতে আমাদের বাগানের এক তরুন বৃক্ষের শিকড়ে সে মধু বিলোতে আসত । মাঝে মাঝে এসে বসত আমি নামক এই কৌতূহলী ছটফটে নবীন গাছটির কাছে । ছোট ছোট বাক্য, দৃষ্টির ইশারা আর নানারকম অধরভঙ্গি দিয়ে সে কথা বলত । কণ্ঠে ছিল সার্বক্ষণিক অপরিচিত বিষণ্ণতা । কি এক মুগ্ধতায় তার কথা শুনতাম আর ভাবতাম আমি কবে পরী হব ।
আমি জানতাম সে কেন আসত ; হয়ত জানতাম তার হাসি ছিল কান্নার ছায়া । তারপরও উদগ্র নিষিদ্ধ কৌতূহলে একদিন জিজ্ঞেস করে বসলাম, সে তার সাথে কি করে ?
কি করি ? সে মিটমিট করে হাসল, বললে বুঝবি তুই !
আমি অনেক কিছু বুঝি .. , কণ্ঠ দৃঢ় করে বোঝাতে চাইলাম আমি তেমন অজ্ঞ নই ।
মুখে বলে বোঝাতে পারব না তবে তুই চাইলে উদাহরন দেখাতে পারি, ঠোঁটে বিরল উচ্ছল হাসি ফুটিয়ে তুলল সে ।
সামান্য কিশোরী হলেও ততদিনে মানুষের চোখের ভাষা ঠিকই চিনি । কিন্তু তার চোখে যে ভাষা ঝলমলিয়ে উঠল সে ভাষা আমি কখনই দেখিনি । দেবীরা কি এই ভাষায় কথা বলে, দৃষ্টি একইসময়ে এত নরম, স্নেহময় এবং পুজার আকাঙ্ক্ষী হয় কেমন করে । আমাকে অবাক আর বিহ্বল করে, আমার চোখে ডুবল সেই দৃষ্টির জাল । দক্ষ শিকারির মুগ্ধতা শিকারকে মোহাবিষ্ট করে ফেলে । অনুভব করলাম নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রন নেই আর । সে যা চাইবে তাই পাবে, যা ঘটাবে তাই ঘটবে । কিছুক্ষনের জন্য মনে হল অন্ধ হলেই ভালো, কেননা অন্ধকার আলোর জন্মদাত্রী ; এক সুগন্ধি ঘোর নেমে এল, আমার অনস্তিত্ব তখন তার নিঃশ্বাসের অস্তিত্ব ।
সময় স্থির থেকে ধাবমান হয় । হৃদয়ে রক্তের বদলে বয়ে চলে দিকহারা নদীর ভাঙন । উচ্ছলতা রুপান্তরিত হয় অস্থিরতায় । ঘুমের মাঝে চোখের সামনে অপার্থিব একজোড়া চাহনি দেখি । কেউ যেন গালে হাত ছুঁইয়েই সরিয়ে নেয় আর আমি ধড়ফড় করে জেগে উঠি । ঘরময় অন্ধকার আগে ভয় জাগাতো .. এখন একাকীত্ব জাগায় । বিছানায় ভুতের মত বসে অলৌকিক কোনও স্পর্শকে দুহাত বাড়িয়ে খুঁজি । কারও জন্যে নয় .. স্পর্শের তীব্র পিপাসায় নিজেকে পাপদগ্ধ নরকবাসি মনে হয় । রাত জাগে অথবা আমিই জাগি । আপনমনে বিড়বিড় করি .. কেন .. কেন বুঝতে চাইলি !
কিছু মুহূর্ত সময়ের মাত্রাকে হাতের মুঠোয় দিয়ে নির্মমভাবে আবার ছিনিয়ে নেয় । ভবিষ্যতের নিয়ন্ত্রন তুলে দেয় অতীতে পর্যবসিত বর্তমানকে । নিয়ন্ত্রন .. হ্যা সেটা আসলেই আমার প্রয়োজন । নিজেদেরকে পরিশীলিত জ্ঞানবৃক্ষে পরিণত করতে আমাদেরকে প্রায়ই বিদ্যালয়ে হাজিরা দিতে হয় । সেখানে রুটিন বেঁধে আমরা জ্ঞান গলাধঃকরণ করি অতঃপর উগড়ে দেই । এইসব বমন কেচ্ছার শিডিউল এখন নিয়ন্ত্রনহীন । মন বসে না .. মনের ঘরের ছোট চড়ুই পাখি রুপালি চাঁদের পিছনে আঁধারের রুপ দেখে ফেলেছে । মনের সাথে তাল মিলিয়ে চারপাশে জ্ঞানবৃক্ষের পরিবর্তে রুপবৃক্ষদের হেটে যেতে দেখি । বৃক্ষ মানেই কুসুম সম্ভার । এই বৃক্ষদের হৃদয়ে ভালোবাসার পুস্প আর বাহিরে কামজ কুসুম । সৌন্দর্য সবসময়েই দৃষ্টিকামনার ওপর নির্ভর করে, প্রবল তৃষ্ণায় নষ্টনদীর জল হয়ে ওঠে অমৃত । কীটের চোখে দুই পাপড়ির ওষ্ঠপুস্পে মধুগন্ধী ছায়া দেখি , নষ্টনদীর জোয়ারে ডুবিয়ে দিতে চাই দুই চরণ । নির্লজ্জের মত ভাবি যা ভাবিনি আগে কখনও ।
কালো রঙের মোহের বিজ্ঞাপন - এক কৃষ্ণনয়না কৃষ্ণসুন্দরী প্রায়ই পাশে বসে । আমার অন্যমনস্কতা অথবা দৃষ্টির বিশৃঙ্খলা সে হয়ত খেয়াল করে থাকবে । একদিন যেমন আমি জানতে চেয়েছিলাম সেও জানতে চাইল আমার সমস্যাটা কি ?
'কোন সমস্যা নেই তো !' আমি নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চাইলাম যদিও জানি না আসলে কি লুকাতে চাই ।
- মিথ্যে বলনা, তুমি সবসময় ছটফট কর, কি যেন খোঁজো ।
'তুমি কেমন করে জানো ?' আমি ওর পর্যবেক্ষণশক্তি বুঝতে চাইলাম ।
- আমি জানি কারন এই মুহূর্তে তুমি আমার এমন কিছু দেখছ যা তোমার দেখার কথা নয় ।
সত্যিই আমি ওর রক্তাভ ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছি । লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলাম ।
মৃদু হাসির শব্দ পেলাম । আমি নিচের দিকে তাকিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুল মাটিতে খুঁটছি । ও চিবুক ধরে আমার মাথা উঁচু করল, ফিসফিস করে গাইলো আমার মত দিগভ্রান্ত পাখির গান, ' আমারে বলবা তুমি কি দ্যাখো !'
'আমি জানি না আমি কি দেখি, আমার শুধু কিছু একটা করতে ইচ্ছে করে ।'
- কি করতে ইচ্ছে করে ?
'বলতে পারব না ।' ভীষণ অসহায় মনে হল নিজেকে ।
- ছুটির পর তুমি আমার সাথে যাবে । আজ আমি দেখবই তোমার কি করতে ইচ্ছে করে ।
খুব বুঝতে পারছি এটা ভুল ধরনের জেদ । ওর কোন ধারনাই নেই আমি কি করতে পারি ; সত্যি বলতে কি আমারও জানা নেই । হতে পারে যেকোনো ভুল আবেগের বলি হব দুজনেই । তারপরেও দুয়ারে করা নাড়ে অবধারিত প্রতীক্ষা ।
হয়ত চাই তোমার হৃদয় পদদলিত করুক যে কেউ ...
হয়ত চাই শোবার ঘরে নগ্নপদে হাটুক যে কেউ ...
কৃষ্ণবতীর ঘরটি তার রঙরুপের বিপরীত আভায় উদ্ভাসিত । ঘরে গোলাপি ছাড়া আর কোন রঙ চোখেই পড়ে না । দেয়াল, মেঝে, চাদর, আসবাব এমনকি সামান্য পেনসিল কলমগুলো পর্যন্ত ঐ রঙের । তাজা উষ্ণ রক্তের উজ্জ্বলতা আমাকে মুগ্ধ করে কিন্তু এ তো আমার চেয়েও বড় ম্যানিয়াক । আমাকে বিছানায় একা বসিয়ে রেখেছে ও অনেকক্ষণ । কিছুটা আড়ষ্ট বোধ করছি .. গাধী টা করে কি .. আর আমি এখানে কি ঘাস কাটছি ! অজান্তেই পা দুটো কাঁপছে .. রক্তে অজানা শিহরণ ।
স্বাভাবিক হওয়ার জন্য কোলবালিশের সমান পুতুলটাকে ঠোঁট ভেংচি দিতে যাব তখনি ও এল । হাতে একটা ক্যাডবেরি আর ঠোঁটে .. ডিপ পিঙ্ক গ্লস । উফফ আবারও .. এখন লিপস্টিক দেবার কি এমন প্রয়োজন পড়ল । আমি বলেই বসলাম, কালো মেয়েদের পিঙ্ক মানায় না ।
কালো বলে আমার শখ হয় না বুঝি, কাছ থেকে দেখে তারপর বলো সত্যি খারাপ লাগে নাকি, আমার নাক বরাবর তিন ইঞ্চি তফাতে মুখ এগিয়ে আনল ও । হৃদয় স্পন্দন মুহূর্তের তরে থেমে দাঁড়াল কি । পিঙ্ক শেডটা তো বেশ ।
ঢোক গিলে বলতে পারলাম, চকলেট কি আমার জন্য আনছ ?
হুম ..
একটা ক্যান ? তুমি খাবেনা ?
দুইজন মিলে শেয়ার করব .. এই নাও তোমার অর্ধেক ।
প্রায় শোনা যায় না এরকম চকলেট ভাঙার শব্দে হার্টবিট মিস আর আমার মুখের সামনে বাড়ানো হাত । দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছে বোধহয় .. আঙুল, চকলেট, অধর সব গুলিয়ে ফেলছি । দুহাত বাড়িয়ে কোনটিকে টেনে নিলাম নিজেও জানি না । অরণ্য বন্যতার মতই উন্মুক্ত । সেই অরন্যের উষ্ণ হ্রদে ডুবে যাচ্ছি । শুধু ডুবে যাবার অনুভুতি বাদে সমস্ত ইন্দ্রিয় অসার হয়ে আসছে ।
এই কি হচ্ছে এসব !
দুজনে ছিটকে লাফিয়ে উঠলাম । গাধী টা দরজা লক করতে ভুলে গেছে । খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে ওর হতবিহ্বল মা । আমি মাথা নিচু করে ছিলাম তারপরেও বুঝতে পারলাম উনি আমার দিকে তাকিয়ে বরফহিম গলায় বললেন, 'এই মেয়ে, বাড়ি যাও ।'
যন্ত্রচালিতের মত বেরিয়ে এলাম । চিন্তা কেমন জানি থম মেরে গেছে । নিজের ঘরে ঢুকে ভুতগ্রস্তের মত কাপড় পালটে বিছানায় উপুর হয়ে শুলাম । একজন মায়ের বিচারক চোখ আমাকে শাস্তি দিয়ে ফেলেছে । মাথার কাছে প্লেয়ার টা অন করে জাগিয়ে দিলাম ফিওনা অ্যাপলকে । কেউ মারেনি কেউ বকেনি তবু কান্নার ঢেউ ভাসিয়ে নিতে চাইছে । পাতলা কাঁথায় পুরো শরীর মুড়ে অশ্রুজলে জানতে শুরু করলাম জীবনের প্রথম অপরাধবোধ ।
What I need is a good defense 'Cause I'm feelin' like a criminal And I need to redeemed To the one I've sinned against.