নভেম্বর,১৯৭১। চট্টলার পাহাড়ে হাড়কাঁপানো ঠান্ডার মধ্যে সেনা চৌকির বাইরে সতর্ক প্রহরায় খাকি পোশাক এবং ধাতব টুপি পরিহিত এক পাক সেনা। খচখচ......হঠাৎ কিসের যেন একটা আওয়াজ আলোড়িত করলো তার সচেতন কর্ণপটহকে। না তো! কোথাও কেউ নেই। কিন্তু হিমশীতল ইথারে ভেসে সে রহস্যময় অশরীরী শব্দসত্তা যেন ধীমতালে এগিয়ে আসতে লাগলো আরো কাছে। স্নাইপার ট্রেনিং খতম করা একজন সেনার পক্ষে সহযোদ্ধার কাছে ভূতের ভয় স্বীকার করে কাপুরুষের তকমা মাথা পেতে নেওয়া চলে না বটে;কিন্তু চাকমা অধ্যুষিত আপাত নিরাপদ এ পাহাড়ি মুল্লুকে মুক্তিবাহিনীর উৎপাতও তো নেই। তবে? দ্বিধাভরা সংযত পদক্ষেপে এগিয়ে গেল সেই শব্দের দিকে। কিন্তু......কিছু বুঝে উঠবার আগেই ধাঁরালো কিছুর জখমে শিশিরস্নাত ঘাসের উপর লুটিয়ে পড়ল সে।
চৌকির বিপরীত পার্শ্বে প্রহরারত অপর খান সেনাটা আজিব সে শব্দের অনুসরণে এসে সহযোদ্ধার ভূপতিত নিথর দেহ পেল। অদ্ভুত জখমগুলো চারপেয়ে প্রাণির না দুপেয়ে প্রাণির তা নিরসনের পূর্বেই চারদিক থেকে বুলগেরিয়ান একে-৪৭ গর্জে উঠলো-ঢলে পড়লো দ্বিতীয় খানসেনাটিও। চাঁদতারা পতাকা উড়ানো সেনা চৌকিতে অতর্কিত আক্রমণ শেষে আবারও চট্টলার পাহাড়ে মিলিয়ে গেল দুপেয়ে পাহাড়ি ভূতগুলো।
'৭১ এর শেষ দুমাসে এ পাহাড়ি ভূতেদের ঘনঘন উৎপাতে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল চট্টলার খানসেনারা। বিশেষ ধরণের ছোরা চালানো আর মাঝে মধ্যে বুলগেরিয়ান একে-৪৭ এর গর্জন-আক্রমণ শেষে আবার শূন্যে মিলিয়ে যাওয়া-এদের আক্রমণের অভিনব কৌশল না মিলে মুক্তিবাহিনীর সাথে,না মিত্র বাহিনীর সাথে। পাহাড়ি প্রতিকূল পরিবেশে চাকমা অধ্যুষিত জনপদে অবস্থান নিয়ে গোটা পাকবাহিনীর মধ্যে ত্রাস ছড়িয়ে দেওয়াটা যেনতেন বাহিনীর কম্ম নয়। এরা যে ছিল 'ফ্যান্টমস অব চিটাগাং'।
অপারেশন মাউন্টেন ঈগল:
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং ভৌগোলিক অবস্থানের বিশেষত্বের কারণে মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রাম উভয়পক্ষের কাছেই কৌশলগতভাবে আলাদা গুরুত্ব পেত।ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরসহ চট্টগ্রামের একটা বড় অংশ শত্রুমুক্ত করে মুক্তাঞ্চল গঠনের উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সমন্বিত কভারট সামরিক অভিযান চালানো হয়,তারই পোশাকি নাম 'অপারেশন মাউন্টেন ঈগল'।
'ফ্যান্টমস অব চিটাগাং' আসলে কারা ছিল?
কথিত এ পাহাড়ি ভূতেদের দল ছিল আসলে ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রশিক্ষিত একটি অনানুষ্ঠানিক এক প্যারামিলিটারি বাহিনী;যাদের পোশাকি নাম 'স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স'(SSF)। ১৯৬২ সালে ইন্দো-চীন যুদ্ধ শেষে একঝাঁক তরুণ তিব্বতি যোদ্ধাদের নিয়ে গোপন এ বাহিনীটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আনুমানিক ১০,০০০ সদস্য বিশিষ্ট স্পেশাল ফোর্সটির সদরদপ্তর উত্তর ভারতের চকরতায়। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পেলেও আধাসামরিক বাহিনীটি ভারত সরকারের বেতনভুক্ত । প্যারাট্রুপারস ট্রেনিং সম্পন্ন এ যোদ্ধারা পাহাড়ি এলাকায় গেরিলা হামলা,গুপ্ত অভিযান,নজরদারিতে দক্ষ। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষে তারা অপারেশন ব্লু-স্টার,অপারেশন ক্যাকটাস,অপারেশন পবন,কার্গিল যুদ্ধ ও অপারেশন রক্ষক-এ গেরিলা যোদ্ধা এবং ফিফথ আর্মি হিসেবে অসামান্য নৈপুণ্যের পরিচয় দেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অক্টোবর মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনী 'অপারেশন মাউন্টেন ঈগল' এর অংশ হিসেবে এবং একই সাথে মিজো বিদ্রোহীদের দমন করতে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে সীমান্তবর্তী দেমাগিরিতে এসএসএফ এর ৩,০০০ তিব্বতি যোদ্ধা মোতায়েন করে। তিব্বতি ছোরা এবং বুলগেরিয়ান একে-৪৭ হাতে একের পর এক দুর্ধর্ষ আক্রমণে সফল এ গোপন বাহিনীর বিষয়ে পাকবাহিনী দূরে থাক-ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাধারণ সেনারাও জানতেন না। তাই আক্ষরিকভাবেই চট্টলায় ঘাঁটিগাড়া পাকসেনাদের কাছে এই তিব্বতি যোদ্ধারা ছিল এক 'ভূতুড়ে বাহিনী'।
ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তিব্বতি যোদ্ধা কি করে এল?
এসএফএফ এর সদস্যরা ছিলেন চীন হতে স্বাধীনতাকামী, ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত তিব্বতি যুবক। তিব্বতের নির্বাসিত ধর্মীয় নেতা দালাই লামার অনুসারী এবং অনুগামী হিসেবে তারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের পরপরই উড়িষ্যার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিজু পাটনায়েক কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তিব্বতি যুবকদের নিয়ে একটি স্পেশাল ফোর্স গঠনের প্রস্তাব দেন। ওদিকে তিব্বতি যোদ্ধারাও চীনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে উৎসুক। তিব্বতি বিচ্ছিন্নতাবাদী জাগো নামগিয়াল দর্জি,গনপো তাশি প্রমুখ দলভারি করতে তিব্বতি যুবকদের মধ্যে জোর প্রচারণাও চালাচ্ছিলেন। অতএব দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে তিব্বতি যুবকদের নিয়ে একটি আধাসামরিক বাহিনী গঠনে কৌশলগত কোন বাধাই ছিল না।
অবশেষে ১৯৬২ সালের ১৪ নভেম্বর নেহেরু সরকারের সম্মতিক্রমে ভারতীয় সেনাবাহিনীর 'রিসার্চ এন্ড এ্যানালাইসিস উইং' (RAW) তিব্বতি 'চুসিগ্যাংদ্রাগ' নেতাদের যোগসাজশে প্রতিষ্ঠা করে 'স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (SFF) যা পরবর্তীতে 'Establishment 22' এর মোড়কে আত্মপ্রকাশ করে। পুরো প্রক্রিয়াটি তদারকির দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান ভোলানাথ মল্লিক। ভারতীয় বাহিনী ও তিব্বতি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে এক গোপন চুক্তির মধ্য দিয়ে ৫,০০০ সদস্য নিয়ে SFF যাত্রা শুরু করে। এ বাহিনীর চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল চীন হতে তিব্বতের স্বাধীনতা অর্জন।
দেরাদুনে সিআইএ(CIA) এর অধীনে এসএফএফ-এর তিব্বতি যোদ্ধাদেরকে প্রথমে দু'বছরমেয়াদী গেরিলা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। চীনের বিরুদ্ধে কৌশলগত কারণে ভারত সরকার এসএফএফ-এর দক্ষতা উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করছিলো। তাই প্যারামিলিটারি বাহিনীটির দায়ভার অর্পণ করা হয় মেজর জেনারেল সুজান সিং উবান এর নেতৃত্বাধীন 'Establishment 22' এর উপর। শীঘ্রই বাহিনীর তিব্বতি তরুণরা হয়ে ওঠেন প্রতিকূল পাহাড়ি এবং জংলি পরিবেশের একেকজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। বিভিন্ন সামরিক অভিযান এবং মিজোরামে পাকিস্তানের মদদপুষ্ট মিজো বিদ্রোহীদের দমনে অসামান্য সাফল্য দেখিয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এসএফএফ ভারতের বিশ্বাস এবং নির্ভরতা অর্জনে সমর্থ হয়। এভাবেই শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল সমীকরণে সুদূর তিব্বতের কিছু বীর যোদ্ধা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে জড়িয়ে যায়।
যুদ্ধের শেষ তিন মাসে কী ঘটেছিল চট্টলার পাহাড়ি রণাঙ্গনে?
বিএলএফের চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার এবং অপারেশন মাউন্টেন ঈগলের অন্যতম কলাম কমান্ডার গোলাম রব্বানের বয়ানে সামরিক অপারেশনটির ধারাবাহিক বর্ণনা পাওয়া যায়। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে গেরিলা হামলা পরিচালনা বাঙালি মুক্তিফৌজ এবং বিএলএফের জন্য মোটেও সহজ ছিল না। গোলাম রব্বানের ভাষ্যমতে, বিএলএফের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার শেখ ফজলুল হক মণি মিত্রবাহিনীর হাইকমান্ডের কাছে স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স-কে অপারেশন মাউন্টেন ঈগল-এ সম্পৃক্ত করবার প্রস্তাব দেন। ভারতের ইন্দিরা গান্ধী সরকার এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে। তদুপরি চট্টগ্রামে মিজো বিদ্রোহীদের ঘাঁটিও ভারতের জন্য চিন্তার বিষয় ছিল। অবশেষে অক্টোবরে সীমান্তবর্তী দেমাগিরিতে তিন হাজার তিব্বতি গেরিলাকে মোতায়েন করা হয়।
তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গেরিলা যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল সুজান সিং উবান।
নেপালি গবেষক থাসি ডুন্ডাপের গবেষণায় উঠে আসা একটি চিঠিকে স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের কাছে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর লেখা চিঠি বলে দাবি করা হয়,যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে এসএফএফ কে অংশ নিতে কেন্দ্রীয় সরকার প্রধানের সরাসরি আহ্বানের প্রমাণ পাওয়া যায়। চিঠিটির একটি অংশ উদ্ধৃত করা হলো:
"We cannot compel you to fight a war for us, but the fact is that General AAK Niazi is treating the people of East Pakistan very badly, the same way the Chinese are treating the Tibetans in Tibet. India has to do something about it. It would be appreciated if you could help us fight the war for liberating the people of Bangladesh.”
নেপালি রিভিউ ম্যাগাজিন 'Himal Southasian' এ প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।
দেমাগিরিতে এসএফএফ এর প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল মিজো বিদ্রোহীদের সাথে লড়াই। নভেম্বরের মধ্যভাগে প্রথমে তাদের কিছু সদস্য নয়টি নৌকায় ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে চট্টগ্রামে প্রবেশ করে। অপারেশন মাউন্টেন ঈগল এ অংশগ্রহণকারী তিব্বতি যোদ্ধারা মূলত তিব্বতি ছোরা এবং বুলগেরিয়ান একে-৪৭ দিয়েই একের পর এক সফল গেরিলা হামলা সম্পন্ন করে। তাদের 'Hit and Run' যুদ্ধকৌশলের অভিনবত্ব,ব্যবহৃত অস্ত্র,ইত্যাদি কারণে নব্য এ হামলাকারী বাহিনী সম্পর্কে পাকবাহিনী কোন কূলকিনারা করতে পারছিল না। যশোরসহ সীমান্তবর্তী বিভিন্ন জেলা যখন একের পর এক মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে যাচ্ছিল,বাতাসে যখন 'ঢাকা পতন' এর জোর গুঞ্জন ভেসে বেড়াচ্ছিল,চাকমা রাজা এবং মিজো বিদ্রোহীদের প্রত্যক্ষ মদদ পাওয়া চট্টলার পাকবাহিনী পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক,'পাহাড়ি ভূতেদের' উৎপাতে নিজেদের ঘর সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছিল। আরো বড় ধরণের অভিযানে সম্পৃক্ত করতে পরবর্তীতে তিব্বতি যোদ্ধাদের ৪ টি এম-ফোর হেলিকপ্টার দেওয়া হয়। কাপ্তাই বাঁধ ধ্বংসে পরিচালিত সামরিক অভিযানে মুক্তিবাহিনীর মোড়কে তিব্বতি এসএফএফ এর সদস্যরা অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করে।
তিব্বতি যোদ্ধাদের আরেকটি কৃতিত্ব ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় নেওয়া মিজো বিদ্রোহীদের প্রতিহত করা। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী মিজো বিদ্রোহীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী বহুকাল আগে থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণ এবং মদদ দিত। মুক্তিযুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই তারা মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর বিপক্ষশক্তি হিসেবে অবতীর্ণ হয়।
বছরখানেক আগে এসএফএফ এর ব্রিগেডিয়ার রাতুক স্মৃতিচারণায় বলেন-'৭১ এ এসএফএফ এর প্রথম এবং প্রধান লড়াই পাকিস্তান সেনাবাহিনী নয়-বরং মিজো বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধেই ছিল। মিজোদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে এসএফএফ কে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে মিজো ঘাঁটিগুলো মুক্ত করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় নি। যা ছিল চট্টগ্রামের দায়িত্বে থাকা পাকবাহিনীর জন্য একটি বড় ধাক্কা।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় যখন কেবল সময়ের অপেক্ষা,পলায়নপর পাকবাহিনীর বার্মায় আশ্রয় নেবার পথ রুদ্ধ করে দিতে তিব্বতি এসএফএফ দোহাজারী ব্রিজ গুড়িয়ে দেয়। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর নিয়াজির বাহিনী যখন ঢাকায় আত্মসমর্পণ করছে,সেদিনও চট্টলার পাহাড়ি ভূতুরে যোদ্ধারা চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান নিয়ে সতর্ক অবস্থানে ছিল। ১৮ ডিসেম্বর এসএফএফ বন্দি প্রায় ১,০০০ মিজো বিদ্রোহীকে জড়ো করে।
কেন তিব্বতি যোদ্ধাদেরকেই নির্বাচন করা হয়েছিল?
১) মুক্তিযুদ্ধে চাকমা জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। কেননা তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় '৭১ এ সরাসরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সমর্থন জানান;এমনকি দেশ স্বাধীনের পর তিনি পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে পশ্চিমে চলে যান। খানসেনারা পাহাড়ের চাকমা জনগোষ্ঠীকে তাই 'বিপদের কারণ' হিসেবে গণ্য করত না। চেহারা এবং শারীরিক অবয়বে চাকমাদের সাথে সাদৃশ্যের পুরো ফায়দাটাই তিব্বতি যোদ্ধারা নিতে পেরেছিল। রেকি কিংবা হামলার প্রয়োজনে চাকমা জনগোষ্ঠীর মাঝে মিশে যাওয়াও তাদের জন্য সহজ ছিল। সেনাচৌকিতে হামলা চালানো 'ভূতেদের দল'কে চিহ্নিত করতে না পারার পেছনে এটা একটা বড় কারণ ছিল।
২)এসএফএফ এর প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দশ্যই ছিল তিব্বতের স্বাধীনতা। তাই দূর্গম পাহাড়ি এলাকায় তাদেরকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলতে ভারত সরকার সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিল। পাশাপাশি মিজো বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পাহাড়ি রণাঙ্গনে যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও তাদের দুর্ধর্ষ পাহাড়ি যোদ্ধায় পরিণত করেছিল। অন্যদিকে মুক্তিফৌজ এবং বিএলএফ-এর সদস্যদের পাহাড়ি পরিবেশে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিল না বললেই ছিল। এজন্যই চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায় সেনাচৌকি আক্রমণের জন্য ফিফথ আর্মি হিসেবে এসএফএফ অনেকটা অটোচয়েজ ছিল।
মুক্তিযুদ্ধে তিব্বতি যোদ্ধাদের আত্মত্যাগ:
অপারেশন মাউন্টেন ঈগলে এসএফএফ এর জন্য শুরুতেই একটি বড় ধাক্কা অপেক্ষা করছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশের পর একদম শুরুর দিকেই এসএফএফ-এর দাপোন(কমান্ডার) ধন্দুপ গিয়াৎসু শত্রুর গুলিতে নিহত হন। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে মুক্তিযুদ্ধে ৪৯ জন তিব্বতি যোদ্ধা শহিদ হন। তবে বিগ্রেডিয়ার রাতুকের স্মৃতিচারণ এবং মেজর জেনারেল সুজান সিং উবানের 'ফ্যান্টমস অব চিটাগাং:ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ' গ্রন্থে নিহতের সংখ্যা ৫৬ জন উল্লেখ করা হয়েছে। রোয়ার মিডিয়ায় নিহতের সংখ্যা ৯০ জন ও আহতের অনুমিত সংখ্যা ১৯০ জন বলা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের তিব্বতি মিত্ররা তাদের বীরত্বের জন্য কী স্বীকৃতি পেয়েছেন?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসম সাহসিকতার পরিচয় এবং বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সত্ত্বেও তিব্বতি যোদ্ধারা কোন স্বীকৃতি কিংবা সম্মাননা পাননি বললেই চলে। এমনকি ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর আনুষ্ঠানিক নথিসমূহে তাদের উল্লেখ পর্যন্ত নেই। কাপ্তাই বাঁধ ধ্বংসে পরিচালিত অভিযানে তিব্বতি সেনাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকলেও সকল নথিপত্রে তাদের 'মুক্তিবাহিনী' বা 'মুক্তিফৌজ'এর সদস্য উল্লেখ করা হয়েছে কেননা এসএফএফ একটি সিক্রেট ফোর্স এবং 'অপারেশন মাউন্টেন ঈগল' একটি 'Covert Operation'। যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক দলিলপত্রে এ ধরণের গোপন বাহিনী এবং অভিযানের বিবরণ থাকে না। তাই তিব্বতি মিত্রসেনাদের সম্পর্কে ধারাবাহিক এবং পূর্ণাঙ্গ বিবরণের একমাত্র দালিলিক উৎস মেজর জেনারেল সুজান সিং উবানের 'ফ্যান্টমস অব চিটাগাং :ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ'।
ভারত সরকার ১৯৭১ সালে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় ৫৮০ জন তিব্বতি গেরিলা যোদ্ধাকে বিশেষ 'অর্থ পুরস্কার' প্রদান করলেও যুদ্ধপরবর্তী কোন আনুষ্ঠানিক সামরিক উপাধি,পদক কিংবা সম্মাননা দেওয়া হয় নি। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে কোন স্বীকৃতি বা সম্মাননা দেওয়া হয় নি। তবে তিব্বতি একটি ওয়েবসাইটে বঙ্গবন্ধু অনানুষ্ঠানিকভাবে তিব্বতি যোদ্ধাদের একটি প্রতিনিধিদলকে ডেকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। Tibetwrites নামক ওয়েবসাইটটিতে এ বলা হয়েছে-
"The new country’s founder, Sheikh Mujibur Rahman personally called SFF leaders to thank them for their part in that creation. But this had been a classified mission-one that officially,still does not exist. As such none of the SFF fighters have ever been decorated nor have their contributions ever been officially recognised."
বিশ্ব রাজনীতির জটিল সমীকরণে পড়ে যে তিব্বতি মিত্ররা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন,তারা আজও অনাদৃতই রয়ে গেছেন। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সামরিক অভিযানে নিয়মিত তাদের সম্পৃক্ত করা হলেও,এসএফএফ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য পূরণে আদৌ কোন অগ্রগতি ঘটেছে কি না-সে বিষয়ে প্রশ্নের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে তাদের সম্পৃক্ততার কারণ বা উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন,আপাত সম্পর্কহীন দূর প্রতিবেশীদের যে অর্ধশতাধিক যোদ্ধার রক্ত এদেশের মাটিতে ঝরেছে,সে ঋণ আমরা কোনদিনও শোধ করতে পারব না।
'অপারেশন মাউন্টেন ঈগল'এ অংশগ্রহণকারী সকল বাঙালি,তিব্বতি,ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর যোদ্ধাসহ সকল মুক্তিযোদ্ধার প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম...............
..…........................................................................................................................................................
তথ্যসূত্র:
১)স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স- উইকিপিডিয়া
২)আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিব্বতী যোদ্ধারা-শ্রদ্ধেয় শের শায়রী সাহেব
৩)মুক্তিযুদ্ধের ফিফ্থ-আর্মি : অপ্রচলিত যুদ্ধের কিছু বিষয়ে আলোকপাত
৪)একাত্তরের বিদেশী বন্ধুগণঃ আমাদের দুঃসময়ের সূর্যসারথি (পর্ব-১০)
৫)মুক্তিযুদ্ধে তিব্বতি যোদ্ধাদের ভুলে যাওয়া বীরত্বের ইতিহাস
৬)অপারেশন মাউন্টেন ইগল: মুক্তিযুদ্ধে একদল তিব্বতিয় গেরিলার বীরত্বগাথা
৭)অপারেশন মাউন্টেন ঈগল
৮)পাহাড়ে মুক্তিযুদ্ধ:অন্য আলোয় দেখা-২