মেয়েটি খুব বিচিত্র এক অনুভবের জগতে ছিল। এহেন পরিস্থিতি কারুর জীবনে একবারই আসতে পারে,দ্বিতীয়বার আসবার সুযোগটি নেই। সবার অবশ্য এ সুযোগ মেলে না;মর্ত্যলোকে কন্যারূপে ভূমিষ্ঠ হওয়াও আবশ্যক।...অদ্ভুত এক টানাপোড়েনে মেয়েটির মন;যেন নিজের মধ্যে বাস করা ভিন্ন দুটি সত্তা টেনে চিরে নিয়ে যেতে চাচ্ছে তাকে ভিন্ন দুটি সিদ্ধান্তের দিকে।একদিকে বশিষ্ট মুনির স্ত্রী অরুন্ধতীর সমান মর্যাদা নিয়ে মৃত্যুর পর পাক্কা সাড়ে তিন কোটি বছরের স্বর্গবাস এবং পরজন্মে উচ্চতর বংশে জন্মলাভের নিশ্চয়তার হাতছানি।অন্যদিকে বেঁচে থাকার সহজাত আকুতি।জন্ম-মৃত্যু তফাৎ;মধ্যিখানে কেবল চন্দন কাঠের একটা চিতা।মনের অন্তর্দ্বন্দ্বে সদ্য স্বামী হারানোর শোকও শুকিয়ে গেছে।
অবশ্য তার সিদ্ধান্তের জন্য বসে থাকতে কারুর বয়েই গেছে,আয়োজন চলছে মহাসমারোহে।বদ্ধমূল বিশ্বাসে প্রথাটি এতটাই সমাজনিষ্ঠ যে মাতৃস্নেহও হার মেনে নেয়। উপর্যপরি আফিম খাইয়ে আচ্ছন্ন চেতনাকে পাকাপাকিভাবে অবশ করে দিয়ে সতীকে নিয়ে যাওয়া হলো চিতার উপর,গতরাতে মনসা দেবীর প্রকোপে প্রাণ হারানো তার স্বামীর মৃতদেহের কাছে।সব আচার শুদ্ধভাবে পালনের পর ব্যস্ত কন্ঠে মন্ত্রজপের সাথে সাথে অগ্নিসংযোগ করা হলো চিতায়;চিতার উপর একটি দেহ এবং একটি মৃতদেহ।দেহটি আচমকা আর্তনাদ করে উঠলো,কিছু বললও হয়তো ।কিন্তু সে যে দৈববাণী-কানে পৌঁছুলে ঘোর অমঙ্গল।তাই বিপুল উদ্যমে বাজানো ঢাকের আওয়াজ এবং চারিদিকে 'জয়,সতীর জয়' ধ্বনিতে শাস্ত্রের সুনিপুণ আচারে সে বাণীকে প্রতিহত করা হয়।কিন্তু মেয়েটা যে বড্ড বেশি চিৎকার করছে!লোকে বলে এ হলো পাপ পুড়বার আওয়াজ। মুখুজ্যে বাড়ির আপাত লক্ষীমন্ত বউটাকে দেখে আগে তো কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে নি সে এত পাপ করেছে জীবনভর।
বীভৎসতম দৃশ্যের অবতারণা হলো যখন পোড়া মৃতদেহের সঙ্গ ছেড়ে পোড়া দেহটা আরেকটু বেঁচে থাকবার আকুতিতে ঝলসানো হাতটাকে চিতার কাঠের বূহ্য ভেদ করে বাইরে বের করে আনলো।তা দেখে নবীন দর্শকদের হৃদস্পন্দন বাড়লো বৈ কি,কিন্তু সন্নিকটে তদারকি করতে থাকা অভিজ্ঞরা কায়দামত লাঠির কয়েক ঘা লাগিয়ে দিলো তৎক্ষনাৎ;তাতে পাপী হাতটা অন্তর্গত হলো না কি কয়লার মত খসে পড়লো,তা অবশ্য বুঝা গেল না।চারিদিকে ভিড় জমানো আত্মীয়-অনাত্মীয় আপামর জনতা বিপুল উৎসাহের সাথে সতীর সহমরণ শেষ অবধি দেখলো।
এগুলো 'বীভৎস রস'এ টইটুম্বুর কোন কল্পকাহিনী নয় মোটেও,এ হলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অন্ধবিশ্বাসকে পুঁজি করে ভারতবর্ষে প্রচলিত সতীদাহ বা সহমরণ প্রথার জীবন্ত খন্ডচিত্রের কোলাজ।এর শেষ বিশ শতকের প্রারম্ভে,কিন্তু শুরু বহুকাল আগে।কতকাল আগে তা অবশ্য স্থির করা যায় নি।তবে খ্রিস্টপূর্ব ৩১৬ সালে স্বপক্ষের ভারতীয় সৈন্যের মৃত্যুর পর দুই বিধবার সহমরণে সঙ্গী হবার পাল্লা দেখে মহাবীর আলেক্সান্ডারের হতবুদ্ধি হবার কথা অবশ্য জানা যায়।ইবনে বতুতা মুলতান থেকে দিল্লি যাবার পথে তিন নারীর সহমরণ প্রত্যক্ষ করেন।
ভাইয়ের সম্পত্তির সম্ভাব্য অংশীদার কমানো এবং খামোখা একটা প্রাণিকে আমৃত্যু ভরণপোষণের দায় এড়ানোর চিন্তাকে মনে ঠাঁই দেবার মতো পরিণত হয়ে উঠেনি,এহেন কিশোর দেবরের বিশুদ্ধ মনে হয়তোবা এরূপ অমানবিক ঘটনা আঁচড় কাটতো;কিন্তু সমাজের বিরুদ্ধে যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা?একজন অবশ্য নিজের প্রিয় বৌদিমণির সহমরণ মেনে নিতে না পেরে পণ করেছিলেন এ নির্মম প্রথাকে সমাজ থেকে চিরতরে মুছে ফেলবার-তিনি রাজা রামমোহন রায়। গোঁড়া সনাতন যাজকতন্ত্রের বিরুদ্ধে রীতিমতো বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন।তিনি 'প্রবর্তক ও নিবর্তক' প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে ভারতের য়ুরোপীয় শিক্ষার সংস্পর্শে আসা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাঝে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বড়লাটেরা বরাবরই সতীদাহপ্রথার ঘোর বিরোধী ছিলেন বটে। কিন্তু স্থানীয় স্থূলবুদ্ধি গোঁড়াদের চটাতে চাননি বিধায় কেউই একে আইন করে নিষিদ্ধ করার ঝুঁকি নেননি।অবশ্য লর্ড কর্নওয়ালিস,লর্ড ওয়েলেসলি,লর্ড মিন্টো ধাপে ধাপে সহমরণ প্রথাকে সীমিত করবার চেষ্টা চালান।অবশেষে যখন রাজা রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে স্থানীয় শিক্ষিত সমাজে সতীদাহপ্রথা বিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে,বড়লাট উইলিয়াম বেন্টিংক প্রথাটিকে আইনত নিষিদ্ধ করবার তোড়জোড় শুরু করলেন।প্রতিক্রিয়াশীল মহলও বসে রইলো না। তৈরি হলো দু'টি মেরু-সতীদাহ রদের বিপক্ষে 'ধর্মপক্ষ' এবং পক্ষে 'শীতলপক্ষ'। শেষ পর্যন্ত ১৮২৯ সালের ৭ ডিসেম্বর কলকাতা গেজেটে 'Regulation XVII of 1829' খ্যাত সতীদাহ রহিত বিষয়ক আইন জারি করা হয়।আইনত রামমোহন রায়দের বিজয় ঘটলেও বাস্তবে উনিশ শতকের শেষ অবধি এ ঘৃণ্য প্রথাটিকে সম্পূর্ণ নির্মূল করা যায় নি।
৪৭ পরবর্তী ভারতে সতীদাহ প্রথাকে বিলুপ্তই মনে করা হয়েছিল। কিন্তু বিস্ময়করভাবে ১৯৮৭ সালে যখন রাজস্থানে রূপ কানোয়ারের সহমরণের সংবাদ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে চাউর হলো,ভারতের সচেতন সমাজ নড়েচড়ে বসলো।এমনকি ১৯৯৯ সালেও অনুরূপ ঘটনার অভিযোগ পাওয়া গেলেও একে 'আত্মহত্যা' আখ্যা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে শিউরে উঠতেই হয় একথা ভেবে যে এরূপ অবিশ্বাস্য রকমের অমানবিক প্রথাকে আমাদের অতীত সমাজ সহস্রাব্দ ধরে লালন করে এসেছে।এ কি কেবলই অন্ধবিশ্বাসের ফল?সন্দেহ নেই,অন্ধবিশ্বাসই মূল কারণ ছিল।তার সাথে যোগ করুন সম্পত্তি করায়ত্ত এবং ভরণপোষণের দায় থেকে মুক্তি।
সত্যিকার অর্থে সনাতন ধর্মশাস্ত্র যে সহমরণকে সমর্থন করে না,তা আজ সর্বজনস্বীকৃত।মহাভারতে পান্ডুর মৃত্যুর পরে মাদ্রীর 'আত্মহত্যা' কোনভাবেই সহমরণের উদাহরণ হতে পারে না;নতুবা নিজের দুই পুত্র কর্ণ-অর্জুনের লড়াই দেখবার জন্য পান্ডুর অপর স্ত্রী কুন্তি বেঁচে থাকেন কিভাবে?(ভাবুন তো,কুন্তিও তখন দেহত্যাগ করলে মহাভারতের কাহিনীতে কি একটা টুইস্ট আসতো!)।আর সতীদাহের পক্ষে শাস্ত্রীয় রেফারেন্সগুলোর ভিত্তি এবং বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন খোদ হিন্দু সমাজ থেকেই উঠেছিল।ঋগ্বেদে 'যৌনীম অগ্নে'(অগ্নিগৃহে) বনাম 'যোনীম অগ্রে'(অগ্রে গৃহে) বিকৃতি তো শ্লোকটির অর্থে রীতিমতো আকাশ-পাতাল পার্থক্য গড়ে দিয়েছিল।(আকাশ-পাতাল নয়,একদম জন্ম-মৃত্যু ফারাক!)
মানা গেল যে বদ্ধমূল অন্ধবিশ্বাসেই না হয় প্রথাটি সমাজনিষ্ঠতা অর্জন করেছিল।কিন্তু এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠতে কেন এতটা বিলম্ব হলো? খ্রিস্টের জন্মের বহু আগে থেকে প্রচলিত কুপ্রথাটি কেন ব্রিটিশ বড়লাটদের আমলেও বলবৎ রইলো?তুর্কী ও মুঘল শাসকদের অনেকে এবং ব্রিটিশ লাট সাহেবরা এর বিরুদ্ধাচারণ করলেও 'ধর্মীয় অনুভূতি'তে আঘাত হেনে বিদ্রোহ ডেকে আনতে চাননি।প্রতিবাদের শুরুটা তাই হিন্দু সমাজ থেকেই হওয়া আবশ্যক ছিল।তাহলে এ সুদীর্ঘ কাল ব্যাপ্তিতে কেন কোন রামমোহন এলেন না?সত্যিই কি আসেন নি?হয়তো এসেছিলেন,কিন্তু বৃহত্তর সমাজের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন।বীভৎস নির্মমতাকে ধর্মের দোহাই দিয়ে মেনে নেওয়ার এ মানসিকতা তাই আমাদের পূর্বপুরুষেরা যুগ যুগ ধরে লালন করেছেন।
আজকে আমরা হয়তো অন্যায়ের প্রতি নিজেদের সহনশীলতা এবং নির্লিপ্ততা দেখে নিজেদের ধিক্কার জানাই।চাক্ষুস মানবহত্যা 'উপভোগ' করি,এবং তা ভিডিও করে অন্যদের 'উপভোগ'এর সুযোগ করে দেই!অবশ্য খেল খতমের পর সোফায় গা এলিয়ে চায়ের আড্ডায় রাজা-উজিরও মারি।ধরামন্ডলের যাবতীয় দায় ওপরওয়ালার,আর দেশের যাবতীয় দায় সরকারের।আমরা কেবল চুপচাপ দেখব,অন্যকে দেখাব,পরিশেষে গা বাঁচিয়ে চম্পট দিব। কিন্তু এ ভয়ানক মানসিক বিকৃতি কি আমাদের সমাজের ডিএনএ-তে আধুনিক যুগের আমদানি?নাকি যুগের পর যুগ ধরে ভারতবর্ষের সমাজ ডিএনএ-তে এ জিনকে লালন করে আসছে?আমাদের উপমহাদেশের অতীত কি সত্যিই গৌরবান্বিত?ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসন ব্যতিরেকে ভারতীয় সমাজ কি খুব সহজে এ সকল অন্ধবিশ্বাস এবং কুপ্রথার নিগড় থেকে মুক্তি পেত?
যদি গলদটা উপমহাদেশের সমাজব্যবস্থার ডিএনএ-তেই থেকে থাকে,তবে বলতেই হয় বর্তমান সমাজের বিবর্তিত অসংগতিগুলোও রাতারাতি উধাও হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।পশ্চিমা কায়দায় শিক্ষিত হয়ে জাতে উঠেও তাই আমাদের মন থেকে প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় বর্বরতা মুছে যায়নি,কেবল আত্মপ্রকাশের ধরণ এবং অজুহাত বদলেছে(কিম্বা বিবর্তিত হয়েছে)। ডিএনএ কে উপেক্ষা করা কি এতটাই সহজ?
তথ্যঋণঃ
উইকিপিডিয়া;
বাংলায় নবচেতনার ইতিহাস -স্বপন বসু;
এবং আমার পরলোকগত কালাচান কাকু।