আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (চতুর্থাংশ)
আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (তৃতীয়াংশ)
আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (দ্বিতীয়াংশ)
আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (প্রথমাংশ)
চতুর্থ শ্রেণিতে সমাজবিজ্ঞান পড়াতেন হালিম স্যার। খুব বদরাগী স্বভাবের মানুষ ছিলেন তিনি। পড়া না পারলে বেদম পেটাতেন। এমন মার মারতেন যে, পিঠে দাগ পড়ে যেত। এক সপ্তাহ পর্যন্ত ব্যথা থাকত শরীরে।
প্রতিটা অধ্যায়ের নামে একটা করে ছন্দ মেলাতেন তিনি। যেমন কোনো এক অধ্যায়ে ছিল লালবাগ কেল্লা। হালিম স্যার বলতেন, “লালবাগের কেল্লা, যা করে আল্লাহ।” এ কথা দিয়ে তিনি বোঝাতে চাইতেন ক্লাসে পড়া না পারলে কারও আর রক্ষে নেই। উনার ভয়ে সবাই তটস্থ থাকতাম। আর কারও পড়া পারি আর নাই বা পারি, এই স্যারের পড়া সবার আগে পড়ে যেতাম।
পড়লেও যে সবসময় পড়া পারতাম, তা কিন্তু না। এত এত পড়া দেওয়া হতো যে, ছোটো মগজে এত ধরত না। নয়-দশ বছরের বাচ্চা কি এক মণ ধান মাথায় নিতে পারে?
পড়া না পারলেই মার আর মার। পিটিয়ে একদম তক্তা বানিয়ে ফেলা হতো। আমাদের তখন কিছু করার ছিল না। কোনো দোষ না করেও কতদিন যে মার খেতে হয়েছে, তার হিসেব নেই! যেদিন পড়া কম কম শেখা হতো, মনে মনে আশা করতাম স্যার যদি না আসতেন! ছোট্ট মন স্যারের মৃত্যুও কামনা করত।
ক্লাসের পড়ার পাশাপাশি পরীক্ষার খাতা যেদিন দেওয়া হতো, আমাদের জানে পানি থাকত না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত। আমরা সেদিন শোকদিবস পালন করতাম। স্যার প্রতিটা লাইন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। একটা-দুটো বানান ভুলের কারণেও আমাদের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যেত।
পঞ্চম শ্রেণিতে এই স্যার বাংলা নিলেন। ততদিনে আমি জড়তা কাটিয়ে ওঠেছি প্রায়। ভালো নম্বর পাই এই স্যারের পরীক্ষায়। হাতের লেখাও ঝরঝরে হয়ে গেছে। পঞ্চম শ্রেণি শেষ করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠলাম। ততদিনে আমার আরও উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আমার ভয় তখনও পুরোপুরি কাটেনি। মনে হতো এই বুঝি স্যার মারতে তেড়ে এলেন।
এক মেয়ে, খুব সম্ভব শিল্পী নাম; একদিন ক্লাসে পড়া পারেনি। ইংরেজি স্যার (দ্বিজেন) বললেন, যে কাল থেকে পড়া শিখে আসবে না, তাকে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হবে। সেই মেয়েকে আর কখনও স্কুলের আশপাশে দেখিনি। এই ঘটনার কয়েকবছর পর একবার তার সাথে দেখা হয়েছিল আমার। দেখি তার সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে শাখা। কোলে বাচ্চা নিয়ে কোথাও যাচ্ছে সে।
কয়েকটা ক্লাস বাদে বাকি ক্লাসগুলো আরামদায়ক ছিল অবশ্য। পরীক্ষায় নম্বরও ভালো আসত। আমরা উৎসব উৎসব অনুভূতি নিয়ে ক্লাস করতাম। আর টিফিন পিরিয়ডে খেলাধুলো করতাম।
ঝড়-বাদলের দিনে কাকভেজা হয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতাম। বইগুলো পলিথিনে মোড়ানো থাকত। কী যে আনন্দ হতো তখন! কখনও কখনও বাড়ি ফেরার পথে ছেলেরা সদলবলে পুকুরে সাঁতার কেটে গোসল সেরে নিতাম। একবার পুকুরে গোসলে নেমে প্রায় ডুবে যাচ্ছিলাম। পাশের বাড়ির এক ভাবি আমাকে টেনে পাড়ে তু্লেছিলেন।
ষষ্ঠ গেল, সপ্তম গেল। অষ্টম শ্রেণিতে উঠার পর একবার স্কুল থেকে বনভোজনে গেল। হাতে টাকা দিলেও মা আমাকে যেতে বারণ করলেন। উনি চাচ্ছিলেন না আমি এলাকার বাইরে কোথাও যাই। আমাকে নিয়ে ভয়ে থাকতেন। প্রচণ্ড মন খারাপ হলো আমার। তবে আশা পূর্ণ হয়েছিল দুই বছর পর; এসএসসির টেস্ট পরীক্ষার পর আমি অনেকের সাথে বনভোজনে গিয়েছিলাম। সেবার মা আর বাধা দেননি।
ভোরবেলা কয়েক কিলোমিটার পথ হেঁটে দ্বিজেন স্যারের কাছে ইংরেজি প্রাইভেট পড়তে যেতাম। আরও সহপাঠীরাও আসত। দ্বিজেন স্যারের পাশের বাড়িতে সজল স্যারের কাছে পড়তাম গণিত। পড়া শেষ করে ১৫-২০ জন ছেলেমেয়ের দল একসাথে স্কুলে পৌঁছতাম।
মনে পড়ে স্কুলে বোর্ডিং বাসের কথা। অষ্টম শ্রেণিতে উঠার পর পরীক্ষায় ভালো করার জন্য সবাইকে বোর্ডিংয়ে উঠতে হলো। জীবনের প্রথম রাত বারোটা-একটা পর্যন্ত পড়ালেখা করা শুরু করি। বড়ো ভাইদের সাথে রাতে-বিরাতে ঘোরাঘুরি করি। বৃহস্পতিবার হলেই গানের আসর বসে। নাটক মঞ্চস্থ হয়। আরও কত কী! দশম শ্রেণিতে উঠার পর আবারও বোর্ডিংয়ে উঠতে হয়। এবার আমরাই বড়ো ভাই। জুনিয়র ছেলেদের নিয়ে কত আনন্দ উদ্যাপন!
দশম শ্রেণিতে উঠার পর একবার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাই। টেস্ট পরীক্ষার মাসখানেক আগে আগে। তখন স্কুলে অনুপস্থিত হলে দশ টাকা করে জরিমানা দিতে হতো। আর মারধর তো আছেই। পরপর তিন দিন অনুপস্থিত ছিলাম আমি। আমি নিশ্চিত ত্রিশ টাকা জরিমানা দিতে হবে আর ন্যূনতম ত্রিশটা বেত্রাঘাত সহ্য করতে হবে।
কী করি, কী করি! টেস্ট পরীক্ষার তো আর বেশিদিন নেই। আপাতত বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করতে শুরু করি। এরপর একেবারে টেস্ট পরীক্ষার সময় স্কুলে গিয়েছিলাম।
কয়েকমাস কোচিং চলে। স্কুলের স্যারেরাই পড়ান। মাঝেমধ্যে পরীক্ষা নেওয়া হয়। এরপর একদিন স্কুলজীবন শেষ হয়ে যায়। আমরা মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি, উত্তীর্ণও হই। পেছনে পড়ে থাকে আনন্দ-বেদনার দিনগুলো।
চলবে...
ছবিঃ প্রতীকী
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:৩৪