আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (দ্বিতীয়াংশ)
আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (প্রথমাংশ)
আমাদের বাড়ি থেকে কয়েক বাড়ি পুবে সরকার বাড়ি। সে বাড়ির নাজমুল সরকারকে (যাকে কাকা বলে ডাকতাম) একদিন মা বললেন, আমার মেজো বোন শিউলি আর আমাকে যেন পড়ান। পরদিন থেকে উনি আমাদের পড়ানো শুরু করলেন। অনেকদিন পর্যন্ত পড়িয়েছেন। সম্ভবত উনিই আমাদের প্রথম গৃহশিক্ষক। আমাদের ওই দীনহীন অবস্থায় গৃহশিক্ষক রাখার মতো দুঃসাহস বিবেচনা করায় বোঝা যায় মা আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কতটা চিন্তিত ছিলেন।
নাজমুল কাকার পর লিটন নামে একজন কিছুদিন পড়িয়েছেন। তারপর পড়িয়েছেন খবির নামে একজন। তারও পর পড়িয়েছেন নজরুল নামে একজন। তিনিও সরকার বাড়ির। কাকা সম্বোধন করতাম। বলতে হয় প্রাথমিক আর মাধ্যমিক জীবনে তাঁরাই আমার শিক্ষার ভিত শক্ত করে দিয়েছিলেন। চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণিতে উঠার পর আমার তোতলানোর সমস্যা কিছুটা কমতে থাকল। একটু-আধটু সমস্যা থাকলেও পড়ালেখা নিয়ে আমার আগ্রহ আর প্রচেষ্টা দেখে শিক্ষকগণ ‘সম্ভাবনাময়’ বলতেন।
সেসময় পড়ালেখায় বেশ সিরিয়াস হয়ে পড়লাম আর পরীক্ষাগুলোয় মোটামুটি ভালো নম্বর পেতে শুরু করলাম। পড়ালেখায় এতই সিরিয়াস ছিলাম যে, ঝড়-বাদলও আমাকে দমিয়ে রাখতে পারল না। গ্রীষ্ম-বর্ষায় যেকোনো পরিস্থিতিতেই বুকে বই নিয়ে দৌড়ে স্কুলে হাজির হয়ে যেতাম। আর সামনের বেঞ্চে গিয়ে বসতাম। পড়ালেখায় ভালো করলেও মাঝেমধ্যে হোমওয়ার্ক নিতে মিস হয়ে যেত। নির্ঘাত শাস্তি বেত্রাঘাত কিংবা নীলডাউন হওয়া।
অনেকের কাছে হয়তো মনে হতে পারে যে, শুধু পড়ালেখার টানেই স্কুল কামাই করতাম না। অনেকাংশে সত্যি হলেও এর বাইরে আরও কারণ লুকায়িত ছিল। বিশেষ করে টিফিন পিরিয়ডে ফুটবল খেলাটা কখনও মিস করতে চাইতাম না। বলতে হয় সহপাঠী আর বড়োদের সাথে খেলার লোভও আমাকে স্কুলে যেতে প্রলুব্ধ করত। যদিও কোনো অজুহাতে বাড়িতে থাকারও সুযোগ ছিল না। মা বেঁধে-ধরে হলেও স্কুলে পাঠাতেন।
যাহোক, স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে এসে ভাত খেয়ে দৌড়ে মাঠে চলে যেতাম ফুটবল খেলতে। স্কুলে ফুটবল থাকলেও বাড়িতে এসে আর সে সুযোগ ছিল না। তাই আমরা পাড়ার ছেলেরা পলিথিন দিয়ে খড় গোল করে বেঁধে বল বানিয়ে খেলতাম। কারও বাড়িতে জাম্বুরা থাকলে নিয়ে আসত; সেটাকেই বল বানানো হতো।
সবসময় যে ফুটবল খেলতাম, তা কিন্তু নয়। এক্কাদোক্কা, ডাংগুলি, কাবাডি, দাঁড়িয়াবান্ধা, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, চোর-পুলিশ, লাটিম ঘোরানো, ঘুড়ি ওড়ানোসহ আরও কত যে লোকজ খেলা আমাদের শৈশব-কৈশোরকে রাঙিয়ে রেখেছিল, তার ইয়াত্তা নেই।
কট বা নুই নামে এক ধরনের খেলা ছিল। হাঁড়ির ভাঙা অংশ ছুড়ে মেরে খেলতে হতো। ঠিকমতো খেলতে পারলে দেশলাইয়ের খোল পাওয়া যেত আর না পারলে খুয়াতে হতো। এটাই ছিল আমাদের বিনিময় মাধ্যম। টোনাপাতির (বাচ্চাদের ঘর-সংসার খেলা) পরবর্তী ধাপ বলা যায়। টোনাপাতিতে বিনিময় মাধ্যম থাকত গাছের পাতা আর কট বা নুই খেলায় দেশলাইয়ের খোল। আমি আর রতন বেশি একটা পারতাম না। তবে রুবেল নামে আমার এক বন্ধু খুব ভালো পারত।
‘রুবেল ভালো আছি ভালো থেকো’ গানটা দারুণ গাইত। ওর খালি গলায় গাওয়া এ গানটা স্বয়ং এন্ডু কিশোরকে ছাড়িয়ে যেত বলে আমার ধারণা। রুবেলের কণ্ঠে বহু বছর গানটা শোনা হয় না। সে আমার প্রতিবেশী। বাড়িতে গেলে ওর সাথে দেখা-সাক্ষাৎও হয়। এটা-ওটা নিয়ে কথা হয়। কিন্তু কখনও বলা হয়নি যে তার কণ্ঠে এই গানটা আমার দারুণ লাগত। এখনও খুব শুনতে ইচ্ছে করে।
আমরা মার্বেলও খেলেছি। মার্বেল আর কট বা নুই খেলা ভয়াবহ রকমের আসক্তিতে চলে গিয়েছিল আমাদের। এরপর আসে ক্যারাম খেলা। এমন হয়েছে স্কুল বাদ দিয়ে সারাদিন স্থানীয় বাজারে ক্যারাম খেলেছি।
এরও পর একসময় ক্রিকেটের ঝোঁক চাপল আমাদের মাথায়। ছোটো ছোটো জাম্বুরাকে বল বানিয়ে আর তালের ডাগ্গা দিয়ে ব্যাট বানিয়ে খেলতাম। দশ টাকা করে এক ধরনের বল পাওয়া যেত তখন, সেটা দিয়ে খেলতাম মাঝেমধ্যে। বল ফেটে গেলে কিংবা হারিয়ে গেলে ছোটো জাম্বুরাই সই। অনেক সময় স্কচটেপ দিয়ে কাগজে মুড়িয়ে গোল করে বল বানিয়ে খেলতাম।
সে সময় মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার উত্থান হচ্ছিল। যখন টি-শার্টের কলার উঁচিয়ে বল নিয়ে জোরে দৌড় দিতেন, আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতাম। অনেকের মতো আমিও টি-শার্টের কলার উঁচিয়ে তার অনুকরণে বল করার চেষ্টা করতাম। আর ব্যাটিংয়ে অনুসরণ করতাম মোহাম্মদ রফিককে। রফিক এমন একজন ব্যাটার ছিলেন, যিনি প্রতিটা বল মারতে চেষ্ট করতেন। যতক্ষণ ক্রিজে থাকতেন, রান হতোই। তবে বেশিক্ষণ টিকতে পারতেন না।
মোহাম্মদ রফিক বাঁহাতি ছিলেন। আমি ডানহাতি হলেও বামহাতে ব্যাট করতাম মাঝেমধ্যে। যেহেতু আমি তাকে অনুসরণ করতাম, আমিও প্রতিটা বল জোরে জোরে পেটাতে চাইতাম। পারতাম বটে, তবে বেশিক্ষণ টিকতে পারতাম না। সোহেল নামে একজন ভালো পারত।
দেশীয় ক্রিকেটারের বাইরে পছন্দ করতাম পাকিস্তানি কিংবদন্তি ওয়াসিম আকরামকে। এছাড়া ছিলেন ভারতীয় সৌরভ গাঙুলী-শচীন টেন্ডুলকার। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্রায়ান লারা, দক্ষিণ আফ্রিকার শন পোলক-জ্যাক ক্যালিস, নিউজিল্যান্ডের শেন বন্ড-ডেল স্টেইন, ইংল্যান্ডের ফ্লিনটপ-মাইকেল ভন, শ্রীলংকার মাহেলা জয়াবর্ধনে-কুমার সাঙ্গাকারা-জয়সুরিয়া প্রমুখ আমাদের চোখে আদর্শ ক্রিকেটার ছিলেন।
খেলাধুলার বাইরে গল্পের বই পড়া আর সিনেমা দেখাও আমার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। যখন আমাদের বাসায় টেলিভিশন ছিল না, শুক্রবার হলে রতনকে সাথে নিয়ে দূর-দূরান্তে যার বাড়ি টেলিভিশন ছিল, তার বাড়ি চলে যেতাম। তখন তো ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ ছিল না, ব্যাটারি দিয়ে চালাতে হতো। দেখা গেছে টেলিভিশন আছে এমন কোনো বাড়ি নেই, যেখানে আমি আর রতন যাইনি।
কারও বাড়িতে ভিসিআর বা পরবর্তীতে সিডি ভাড়া করে আনা হলে আমি আর রতন জানতে পারলে কখনও মিস করতাম না। তবে ছোটো হওয়ায় আমাদের বিড়ম্বনায় পড়তে হতো মাঝেমধ্যে। সব জায়গায় প্রবেশাধিকার ছিল না। অচেনা কারও বাড়িতে গেলে অনেকসময় ঘর থেকে বের করে দিত।
যত যাই করতাম না কেন, সন্ধ্যে হলে ঠিকই বাড়িতে ফিরে আসতে হতো। নাহলে মায়ের বকুনি শুনতে হতো। আর লাঠি-ঝাঁটার বাড়ি তো ফ্রি থাকতই। মেজো বোনের সাথে বসে স্কুল আর গৃহশিক্ষকের পড়া রেডি করতাম।
চলবে....
ছবি: প্রতীকি
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩