somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (দ্বিতীয়াংশ)

৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (প্রথমাংশ)
আমি আর মেজো বোন শিউলি পিঠাপিঠি ছিলাম। আর আমি ছিলাম মেজো বোনের ন্যাওটা। ও যেখানে যেত আমিও সেখানেই যেতাম। ওর কাছে থাকলে মা একটু নির্ভার থাকতেন। আর আমার বোন আমাকে সর্বাবস্থায় সমর্থন দিয়ে গেছে।

যাহোক, মেজো বোন তখন স্থানীয় নারাঙ্গী স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। আমি তার সাথে প্রতিদিন স্কুলে যাই। এ অবস্থায় হঠাৎ একদিন আমাকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করানো হলো। আমি আনন্দের সাথে স্কুলে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কয়েকদিন পর থেকে আমার স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ একেবারে কমে গেল।

তোতলানো স্বভাব ছিল আমার। আমার মা ছাড়া অন্যরা তেমন কথা বুঝত না। কথা জড়িয়ে যেত। স্কুলে শিক্ষকগণ যে পড়া দিতেন, বোনের সহায়তায় মোটামুটি শিখে যেতাম বটে, তবে কাজ হতো না। বলতে পারতাম না। বললেও তারা বুঝতে পারতেন না। আমাকে বেধড়ক মার খেতে হতো।

একদিন গোসল করানোর সময় মা আবিষ্কার করলেন আমার পিঠে বেতের অসংখ্য দাগ। শরীরে কড় পড়ে গেছে। নরম শরীরে ছোপ ছোপ রক্ত জমে গেছে। একটা-দুটো থেকে পুঁজ বের হচ্ছিল।

যত যাই হোক, স্কুল তো আর কামাই করা যাবে না। একদিন আমি স্কুলে যাব না। স্কুলে যেতে একদম ভালো লাগে না আমার। আমি ঘরের পেছনে পালিয়ে ছিলাম। মা আমাকে প্যান্ট-শার্ট পরানোর জন্য খুঁজছেন। হঠাৎ আমাকে দেখে দৌড়ে ঝাপটে ধরতে যেতেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন।

জোরে জোরে কাঁদছিলাম আর তোতলাতে তোতলাতে বলছিলাম, “আমি স্কুলে যাব না, তাও পাঠাবে। পড়ে গেছে, উচিত বিচার হয়েছে।”

তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেছি তখন। মেজো বোন পঞ্চম শ্রেণিতে। নামতা না পারার কারণে আমাকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে নামিয়ে দেওয়া হলো। মেজো বোন কান্নাকাটি করল অনেক। তার কান্নায় শিক্ষকদের মন গলল। আমাকে তৃতীয় শ্রেণিতেই রাখল আবার। তবে শর্ত থাকল এর পর থেকে যেন নামতা ভুল না হয়।

বোন খুব চেষ্টা করল আমি যেন পড়ালেখায় ভালো করি। পরীক্ষায় আগের চেয়ে ভালো করতে লাগলাম। তবে ছোটোখাটো কারণে মারও খেতে হতো। প্রতিদিন মারের ভয়ে থাকতাম। সমাজবিজ্ঞান বইটা যিনি পড়াতেন, খুব নির্দয় ছিলেন তিনি। পিটিয়ে শরীর ফুলিয়ে ফেলতেন। মায়া-দয়া বলতে কিছু ছিল না উনার মনে।

দিন যেতে লাগল। একে একে কয়েকটা বছরও পেরোল। ঘরের পেছনে যে মেহগনি গাছটা, আমি প্রতিদিন সকালে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ছায়ার মাপ নিয়ে দেখি কতটুকু লম্বা হয়েছি। আগের চেয়ে ভালোই বড়ো দেখা যায়। দিন গুনতে লাগলাম কবে বড়ো হব।

তবে আমাদের অভাব কিন্তু কাটল না। আলুভর্তা আর ভাত আমাদের প্রতিদিনকার খাবার। মাঝেমধ্যে কচুশাক। বাবা বিদেশ থেকে টাকা পাঠাতেন বটে, ধারদেনা শোধ করতে করতে আমাদের অবশিষ্ট আর তেমন কিছু থাকত না।

খেলোয়াড়রা যে সাদা কেডস পরে খেলেন, আমার মায়ের কাছে আবদার করলাম আমাকে যেন সেগুলো একজোড়া কিনে দেন। মা বললেন, বাবা এলে কিনে দেবেন। এগুলো যে কেবলই সান্ত্বনা, তখন না বুঝলেও এখন ভালোমতো বুঝি। বয়স ২৬ হওয়ার পর নিজের উপার্জনের টাকায় একজোড়া কেডস কিনেছিলাম।

যাহোক, বাবার জন্য খুব মন খারাপ হতো। বাবা আমাকে অসম্ভব আদর করতেন। ভাতের সাথে দুধ মাখিয়ে খাওয়াতেন। দুধে কবজি না ডুবলে আমি ভাত খেতাম না। আমার মনে পড়ত বাবা স্থানীয় বাজারে নিয়ে গিয়ে মিষ্টি কিনে খাওয়াতেন। খেতে না পারলে টেবিলের নিচ দিয়ে ফেলে দিতাম। না খেলে বাবা রাগ করতেন যে। পরে অভাবের দিনে আমার খুব আফসোস হতো কেন ওগুলো ফেলে দিতাম? কেন পকেটে পুরে নিয়ে আসতাম না? আবার গেলে পাওয়া যাবে তো?

বাবা এলে আবার বাজারে গিয়ে পেটপুরে মিষ্টি খাব। বাবা আমাকে ভালো জামা কিনে দেবেন। মাকে বলেছিলাম একটা কালো শার্ট কিনে দিতে, কিনে দেননি তিনি। বলেছেন, খারাপ ছেলেরা কালো শার্ট পরে। বাবা নিশ্চয়ই কথা এমন বলবেন না? তিনি আমাকে টাকা দেবেন আর আমি স্কুলে গিয়ে টিফিন পিরিয়ডে অনেক মজা কিনে খাব।

সকাল ১০টায় প্রতিদিন স্কুলে যেতাম। বাড়িতে ফিরতে ফিরতে বিকেল ৪টা বেজে যেত। এরমাঝে কোনোকিছু খাওয়া হতো না। বাড়িতে এসেই একবারে ভাত খেতাম। এতটা ধকল ছোটো শরীর সইত না। কিন্তু কিছু করারও ছিল না।

একদিন ঘর থেকে একশো টাকার একটা কচকচে নোট কাউকে না বলে প্যান্টের পকেটে পুরলাম। স্কুলে গিয়ে টিফিনের সময় ইচ্ছেমতো মজা খেলাম। তারপর বাকি টাকা কয়েন করে বাড়ি এসে আমার মাটির ব্যাংকে রেখে দিলাম।

ওই সময়ে আমাদের মতো গরিব মানুষের কাছে একশো টাকাই অনেক টাকা। টাকাটা খোঁয়া যাওয়ার পর মায়ের তো প্রায় মাথাপাগল অবস্থা। তন্নতন্ন করে সারা ঘর খুঁজলেন। আমাকে জিগ্যেস করলেন আমি টাকা নিয়েছি কি না। আমি ভয়ে অস্বীকার করলাম। মনে হলো মা বিশ্বাস করলেন না। মেজো বোনকে আমার মাটির ব্যাংকটা ঝাঁকি দিতে বললেন। ঝনঝন করে শব্দ হতে লাগল। মা আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন।

চলবে....

ছবি: প্রতীকী
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৪
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভাবে মটরবাইকে স্বস্ত্রীক ট্যুর দেই

লিখেছেন অপলক , ৩০ শে মে, ২০২৫ বিকাল ৩:৫০



আসলে আমি ফ্রিডম পছন্দ করি। আদেশে নয়, অনুরোধে মন গলে আমার। শহুরে হট্টগলের চেয়ে প্রকৃতি ভাল লাগে। দল বেঁধে ট্যুর দেবার চেয়ে একাকি ট্যুর দিতে ভাল লাগে। বনের কুকুররা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের থেকে কতটুকু আলাদা তারা?

লিখেছেন শেহজাদ আমান, ৩০ শে মে, ২০২৫ বিকাল ৪:১২



তাদের দেখে মনে পড়ে যায় আওয়ামী লীগের চেতনা ব্যবসার কথা

(১)
আওয়ামী লীগ অন্তত সরকারিভাবে হলেও ১৯৭১-সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকায় ছিল। এরপর সেই ভূমিকার কারণে তারা দেখা গেল যে দেশটাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

"বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হবে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি".....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ৩০ শে মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:০৬

"বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হবে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি".....


বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হতে হবে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি। হতে হবে সকল প্রেরণার উৎস। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের এই দর্শনের নিহিত রয়েছে আত্মসামাজিক,... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঢাকায় শান্তিতে বসবাসের জায়গাগুলো

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩০ শে মে, ২০২৫ রাত ৯:৪৪






ঢাকায় শান্তিতে বসবাস করা যায় যেসব এলাকা: একটি বাস্তবভিত্তিক পর্যালোচনা

ঢাকা, বাংলাদেশের রাজধানী শহর, জনসংখ্যা ও যানজটের দিক থেকে অন্যতম ব্যস্ততম নগরী হলেও এখানকার কিছু কিছু এলাকা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে দলীয় সরকার কখনই জনগণের সরকার হয় না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩১ শে মে, ২০২৫ রাত ১২:২৫



সবাই মিলে দেশ স্বাধীন করলেও আওয়ামী লীগ সেটা স্বীকার করলো না। সেজন্য তারা বাকশাল নামে একদলীয় শাসন শুরু করে ছিল। কিন্তু সেনা বিদ্রোহে তাদের বাকশালী শাসনের অবসান ঘটে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×