অনার্সের শেষ আর মাস্টার্সের শুরু। ভালুকা ডিগ্রি কলেজের উত্তর পার্শ্বে বাচ্চাদের যে স্কুলটা আছে (রোজ বাড কিন্ডারগার্টেন), সেখানে মাত্র যোগদান করেছি। ইংরেজি-ধর্ম ক্লাস করাই। কয়েকদিনে বেশ পরিচিতি এসে গেল আমার।
স্কুল থেকে আমাকে বলা হলো বাচ্চাদের জন্য শিট তৈরি করে দিতে হবে। প্রিন্সিপাল মহাশয় বাচ্চাদের পড়ালেখার মানোন্নয়নে বিরাট তোড়জোড় শুরু করেছেন। কয়েকদিন খাটাখাটি করে শিট তৈরি করে বাচ্চাদের দিয়ে দিলাম। এরমধ্যে আমার মাস্টার্সের একটা মিডটার্মের তারিখ এসে গেল। স্বাধীন, ভালুকায় এসে যার সাথে মোটামুটি একটা সখ্য তৈরি হয়েছে; তাকে বললাম আমার হয়ে একদিন ক্লাস করাতে। আরও বললাম শিটের কিছু টাকা কয়েকজনের কাছে পাওনা আছে। সে যেন টাকাগুলো তোলে। কাউকে কিছু বলতে হবে না। আমিই বলে এসেছি তারা যেন স্বাধীনের কাছে টাকা দিয়ে দেয়।
বিকেলে স্বাধীনের সাথে দেখা হলো। জিগ্যেস করলাম টাকা তুলেছে কি না। সে জানাল বেশিরভাগই টাকা দেয়নি। আমার বেশ খটকা লাগল। এমন তো হওয়ার কথা না। টাকা তো দিয়ে দেওয়ার কথা।
পরদিন ক্লাসে গিয়ে জিগ্যেস করলাম তারা টাকা দিয়েছে কি না। সবাই জানাল দিয়ে দিয়েছে। স্বাধীনকে ধরলাম। সে স্বীকার করল। আমি তাকে বললাম, আমার শিক্ষার্থীরা কখনোই মিথ্যে বলবে না। তুমি যে মাত্র ক’টা টাকার জন্য মিথ্যে কথা বললে, এখন তোমাকে আর বিশ্বাস করা যাবে? সে চুপ।
বললাম, বাটপারি যদি করতেই হয়, এমনভাবে করতে হবে যেন ধরা পড়ার সুযোগ না থাকে। তুমি এমন জায়গায় বাটপারিটা করলে যে, হাতেনাতে ধরা খেয়ে গেলে।
২
বছর দুই আগে এক গ্যাঁড়াকলে পড়ে আমার কিছু টাকা আটকে গেল। বাসা ভাড়া দিতে পারছি না, খাবারের টাকা দিতে পারছি না, এছাড়া কিছু টাকা দেনা পড়ে গেছে; সেটা শোধ করতে পারছি না। এ বিষয়গুলো জেনে এক ভদ্রলোক আমাকে মেইল করলেন, ফোনও দিলেন। জানালেন, আমাকে তিনি সহযোগিতা করতে চান।
আমি বললাম, কীভাবে নিশ্চিত হলেন আমি সত্যিই সমস্যায় আছি? এমনও তো হতে পারে আমি মিথ্যে বলছি। লোকে চিকিৎসার কথা বলে, এই সমস্যার কথা বলে, ওই সমস্যার কথা বলে কত প্রতারণা করে। আমিও তো ওই প্রতারক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হতে পারি।
ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন, কাউকে না কাউকে তো বিশ্বাস করতেই হয়। তাছাড়া আপনাকে আমার কখনও মিথ্যুক মনে হয়নি। আপনার সম্পর্কে আট বছর ধরে জানি।
ভদ্রলোক আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন। তাও আমি বলি কাউকে এত সহজে বিশ্বাস করা উচিত না। সমাজে সৎ লোকের চেয়ে অসৎ লোক বেশি। এরা কিডনির সমস্যার কথা বলে, এমনকি মা-বাবার নামে টাকা তুলেও প্রতারণা করে। যদি কাউকে সহযোগিতা করতেই হয়, শতভাগ নিশ্চিত হয়ে নেওয়াই ভালো।
অনেকে অবশ্য বিপদে পড়ে প্রতারণার আশ্রয় নেয়। ভালোভাবে বললে হয়তো কারও দৃষ্টি আকর্ষণ সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে কী করা উচিত বা অনুচিত দাতা ব্যক্তিই ভালো জানেন।
৩
মূল কাজের পাশাপাশি বাড়তি উপার্জনের আশায় আমি একটা কাজ করতাম। মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা ছিল। প্রতিদিন কাজে যাই, কিন্তু আমার কাজ (লেখা) কাজে লাগানো হচ্ছে না। আমি হতাশ হয়ে পড়লাম।
মাস শেষে সবার মতো আমাকেও বেতন দেওয়া হলো। কিন্তু আমি নিতে অস্বীকৃতি জানালাম। আমার মনে হলো টাকাটা আমার প্রাপ্য না। যদিও টাকাটা আমার অনেক দরকার ছিল। আমি মাস শেষ হওয়ার অনেক আগে থেকেই আশায় বসে আছি কবে টাকাটা পাব। কিন্তু বিষয়টা তো আমার স্বভাববিরুদ্ধ। কাজ করিনি, তো টাকা নেব কেন?
টাকা পেয়েছিলাম অবশ্য। আমাকে বলা হয়েছিল আপনি এখানে আছেন, এতেই আমরা খুশি। তাছাড়া আপনার কাজ রেখে দেওয়া হচ্ছে। পরে কাজে লাগানো হবে। যদিও পরবর্তীতে কাজটা আর করিনি।
৪
অসততা আর লোভ মানুষের সবচেয়ে বদভ্যাসের মধ্যে অন্যতম। আমি অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত মানুষকে দেখেছি চরম অসৎ আর লোভী। যদিও সে পর্যায়ে যাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। তাদের বিষয়ে কিছু বলা ধৃষ্টতা। তবে এটা মানি সততার পাশাপাশি দক্ষতারও দরকার। শুধু সততায় কাজ হয় না।
মনে পড়ে ছোটোবেলায় অন্যের গাছে ঢিল ছুড়ে আম বা বরই পাড়তাম। পাশের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় নিজের মনে করে লেবু নিয়ে আসতাম। বড়ো হতে হতে বদভ্যাসগুলো বদলে গেল। এখন কোটি কোটি টাকা দেখলেও লোভ হয় না। সৎ থাকার চেষ্টা করেছি সবসময়। মনে হয় মোটামুটি সচ্ছল একটা জীবনযাপন করতে পারলেই হলো।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৩:০৯