ভালুকা ডিগ্রি কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ ১০-১১ বছর বয়সি এক ছেলে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে সে বলল, “আমাকে চিনতে পারছেন না, স্যার? আমি সাজিদ। আপনার ছাত্র ছিলাম।”
চিনতে পারলাম তাকে। কুশলাদি বিনিময় করে তার খোঁজ-খবর নিলাম।
এখানেই একটা স্কুলে, রোজবাড নাম, পড়াতাম ’১৬ সালের শেষ থেকে ’১৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। ৩য়-৪র্থ শ্রেণির বাচ্চাদের ইংরেজি পড়াতাম। সাজিদ এখানকারই একটা শাখায় ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ত। ছাত্র হিসেবে খুব দুর্বল ছিল। তারচেয়ে বড় সমস্যা, সে অতিমাত্রায় অমনোযোগী ছিল।
কিন্ডারগার্টেন স্কুল। আমার ওপর চাপ ছিল যেভাবেই হোক ছেলেমেয়েদের ইংরেজিতে ভালো করাতে হবে। ভালো বলতে শুধু পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া নয়, এরা যেন ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলতে পারে- এমন অবস্থা যেন তৈরি করা যায়। আমি নিজে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে উঠে গ্রামার পড়তে শুরু করি, অথচ এ স্কুলে ২য় শ্রেণি থেকেই পড়াতে হতো। যাহোক, অনেকে ভালো করা শুরু করছিল। আমার জনপ্রিয়তাও তৈরি হতে লাগল। বাড়তে লাগল টিউশনির সংখ্যাও। একসময়ের অভাবী আমি, টাকার মুখ দেখতে লাগলাম; সেই সঙ্গে সম্মানও বাড়ল।
এই যে ভালো ছাত্রদের ভিড়ে কয়েকজন ছিল অত্যাধিক অমনোযোগী, সাজিদ তাদেরই একজন। বকাঝকা, মাঝেমধ্যে মারধরও করতাম। অবস্থার উন্নতি হতে সময় লাগল। স্কুল ছেড়ে দেওয়ার বছর খানেক পর ছেলেটা যখন রাস্তায় এভাবে জড়িয়ে ধরল, নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। আহা বাছা! কত বকাঝকাই না করেছি, তবুও আমাকে মনে রেখেছে।
২
ডিগ্রি কলেজের পাশেই আমার এক কাজিনের বাসা। তাড়াহুড়ো ছিল, তাই বাসায় যেতে পারিনি। সে তার মেয়েকে নিয়ে কলেজ মাঠে আমার সাথে দেখা করতে আসবে। তাদের জন্য অপেক্ষা করছি; এমন সময় দেখি আমার পাশেই এক ছেলে বসা। সে আমাকে দেখেই হেসে দিল। বলল, “এতদিন কোথায় ছিলেন, স্যার?”
“গাজীপুর থাকি।” আমি বললাম।
এই ছেলেটাও ৪র্থ শ্রেণির ছিল। মারাত্মক দুষ্টু! এত বকাঝকা করতাম, তাও পিছু ছাড়ত না। জুন মাসে আমার জন্মদিন ছিল। আমার নিজেরই তেমন আগ্রহ ছিল না। টিউশনির ছাত্রছাত্রীরা জোর করল আয়োজন করবে। তারা কোনো খরচ করবে না, উপহার আনবে না- এমন শর্তে আয়োজনে সম্মতি দিলাম। তো এই ছেলেটা বলল, “স্যার, আমিও কিন্তু আসব।”
এর যন্ত্রণায় ক্লাস ঠিকমতো করাতে পারি না। এ যদি জন্মদিনে আসে ঝামেলা করবে। আমি বলে দিলাম, “তুমি এলে হাত-পা ভেঙে দেব।” পরদিন দেখা গেল এই ছেলেটাই সবার আগে সবচেয়ে দামি উপহার নিয়ে হাজির। অন্যদিনের চেয়ে বেশ ধীরস্থির মনে হলো তাকে। কোনো ঝামেলা করল না। বকা দেব কী, আমি আবেগপ্রবণ হয়ে গেলাম এটা ভেবে যে, আমি ছেলেটাকে এমনিতেই বকাবকি করি, আসতে বারণও করেছি; অথচ ভালোবাসার টানে ঠিকই চলে এসেছে।
৩
আমার এক ছাত্রী ভালো গান গায়। তার মায়ের সাথে আমার পাশের ঘরেই থাকে। মাঝেমধ্যে এসে আমার কাছে পড়ে যায়। পড়া ছাড়াও সবসময় আমার কাছে এসে বসে থাকে। ওর মা বলে, “স্যার সবসময় ব্যস্ত থাকেন। বিরক্ত করিস কেন?”
ও বলে, “স্যার, আপনি কি বিরক্ত হন?”
আমি বলি, “মোটেই না।”
ও সকালে গানের রেওয়াজ করে। ওর মা বলে, “আস্তে কর। স্যারের সমস্যা হয়।”
আমি বলি, “সমস্যা হয় না। গান-রেওয়াজ এসব আমার ভালো লাগে।”
ওর মাও ভালো গান গায়। ওদের ছোট বাচ্চাটাও গায়। আমাকে দেখলে অবশ্য থেমে যায়। আমি ছাত্রীকে মাঝেমধ্যে বলি, “মা, গান শোনাও।” ‘ও আমার দেশের মাটি’ এত সুন্দর গায়', পাষাণেরও বুক ফেটে যাবে।
আমি যখন গাজীপুর চলে আসব, মেয়েটা এমনভাবে জড়িয়ে ধরে কান্না করা শুরু করল যে, মনে হলো যেন মেয়েটার বাবা দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে। সে জন্য সে কাঁদছে।
৪
আমার এক ছাত্র’র নাম শাকিক। একদিন জিগ্যেস করল, “স্যার, আপনার বাড়ি কই?”
বললাম, “বাড়ি-ঘর নেই। জঙ্গলে থাকি।”
“আপনার বাবার নাম কী?”
বললাম, “শাকিক!”
সে হেসে কুটিকুটি। বললাম, “সত্যি কিন্তু।”
আমি শিক্ষক মানুষ মিথ্যে বলার কথা না। সে এটা জানে। আমার কথায় সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল। যদিও ততদিনে বুঝতে পেরেছে আমি বাচ্চাদের নিজের সন্তানের মতো করে ভালোবাসি। যাহোক, এরপর থেকে সে আমার জন্য এটা-সেটা নিয়ে আসত। একবার নিয়ে এলো শীতের পিঠে।
একবার ক্লাসের সময় সে জানালা বেয়ে উপরে উঠছিল। এমন মার দিলাম যে, ওর হাসিমুখটা কালো হয়ে গেল। ওর বাপ ওই স্কুলেরই প্রধান। উনি কিছু বললেন না যদিও, তাও নিজের অনুশোচনা হলো এটা ভেবে, এত মারলাম তাও আমার নামে কোনো অভিযোগ নেই ছেলেটার।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০২৪ সকাল ৮:৩৮