ঢাকা-ময়মনসিংহ রোড থেকে নেমে পশ্চিম দিকে বারবৈকার দিকে একটা সড়ক এগিয়েছে। গাজীপুরের ওদিকেই থাকতাম আমি। নতুন বাসা। মোড়ে একটা বিউটি পার্লার পড়ে। তার একপাশে কসমেটিকসের দোকান। দিনের বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে। খোলা হয় সন্ধ্যের দিকে।
সেদিন ওই পথ দিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। দেখি সুন্দর একটা মেয়ে মুখ ভারি করে বসে আছে। এত সুন্দর একটা মেয়ে মুখ ভার করে বসে থাকবে; এটা কেমন কথা। জিগ্যেস করলাম, “মন খারাপ?”
সে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেল। অচেনা একজন লোক তাকে এমন কিছু জিগ্যেস করবে; সে হয়তো ভাবতে পারেনি। আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল।
আমার বাসাটা চার তলায়। এক সাবেক সহকর্মী আমার রুমমেট। পাশের রুমে আরও কয়েকজন থাকেন। বাসাটা আমার নতুন কর্মস্থলের কাছেই। হেঁটে যেতে সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট লাগে।
আগের বাসাটা রাস্তার ওপাশে ছিল। ছয় মাসের মতো ছিলাম সেখানে। প্রাণসংশয়ের কারণে ছাড়তে বাধ্য হই। অবশ্য সেখানে থেকে বিশেষ লাভও হতো না। কারণ, আমার চাকরিটা ছিল না।
চাকরি চলে যাওয়ার প্রেক্ষাপটটা বলি। সময়টা ২০১৮ সালের শেষাশেষি। গাজীপুরের নগপাড়া এলাকায় একটা স্কুলে ইংলিশ পড়াতাম। শিক্ষার্থীরা নানান প্রশ্ন করত। এদের বেশিরভাগ বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট। তবে বিব্রতকর ব্যাপার হলো, বিজ্ঞানের মধ্যে ধর্ম টেনে নিয়ে আসত সর্বাবস্থায়। ধর্মগুরুরা বড়ো বিজ্ঞানী ছিলেন; এইসেই।
ইংলিশ পড়াতাম যেহেতু, বিজ্ঞান নিয়ে আলোকপাত করার অবকাশ থাকত না। গ্রামার আর লিটারেচার নিয়েই সময় যেত। একদিন ধর্ম-বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা হলো। বিজ্ঞানী এবং ধর্মগুরুদের নিয়েও কথা হলো। বুঝলাম, আমার নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি কয়েকজনের পছন্দ হয়নি। প্রধান শিক্ষক বরাবর অভিযোগ করা হলো।
প্রধান শিক্ষক আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, “আপনাকে কি বিজ্ঞান পড়াতে রাখা হয়েছে?”
আমার বোঝা উচিত ছিল, যে দেশে যে ভাও গুণ বুঝে নৌকা বাও। চাকরি ছেড়ে দিলাম। অবশ্য যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, ক্ষমা না চাইলে রাখতও না। কিন্তু আমি তো ক্ষমা চাব না।
চাকরি ছেড়ে চলে এলেও স্বস্তি মিলছিল না। পুরো এলাকা আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপে গেছে। কয়েকজন সহকর্মী আমার বিরুদ্ধে এমন সব অপবাদ দিচ্ছিলেন, আমি যারপরনাই অবাক হচ্ছিলাম। এদের সঙ্গে সখ্য ছিল আমার। অথচ এরা যে আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেন, কখনও মনেই হয়নি। আমাকে যেসব শিক্ষার্থী অত্যাধিক পছন্দ করত, এদের প্ররোচনায় দেখা গেল তারাও আমার বিপক্ষে চলে গেল।
স্কুলের পাশের মাদ্রাসার হুজুররা আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলেন। আমাকে ক্ষমা চাইতে হবে। মাদ্রাসার ছেলেরা পুরো এলাকা চষে বেড়াচ্ছে আমার খোঁজ পেতে। আমি তখন গৃহবন্দী।
আমি যেখানে থাকতাম, এর পাশে আরেকটা স্কুলের প্রধানশিক্ষক আমার আগের স্কুলের প্রধানশিক্ষকের বন্ধু। উনি ছাত্র পাঠালেন আমাকে ধরে নিতে। ভাগ্যক্রমে তখন আমি ময়মনসিংহে ছিলাম। যার বাসায় থাকতাম, তার মেয়ের জামাই আমাকে চিনতেন। উনি ব্যাপারটা সামলানোর চেষ্টা করেছিলেন।
স্কুলে আমার বন্ধুস্থানীয় এক সহকর্মী ছিলেন। আপডেট দিচ্ছিলেন তিনি। আত্মগোপনে যাওয়ার বুদ্ধিও দিলেন। কিন্তু সেটা যে করব, তার উপায়ও ছিল না। একে তো চাকরি নেই, তার ওপর হাত একেবারে খালি। ধার করার মতো অবস্থাও নেই। একজন ব্লগার ওই সময় হাজার পাঁচেক টাকা পাঠিয়েছিলেন। খুব কাজে দিয়েছিল।
শারীরিক অবস্থা এমনিতেই খারাপ। তার ওপর খাওয়া-ঘুমের নেই ঠিক। দুশ্চিন্তায় ভেঙে পড়ছিলাম। ব্লগে তেমন একটিভ ছিলাম না তখন। একজন ব্লগার ওধুধ কোম্পানিতে এমপিও পোস্টে একটা চাকরির প্রস্তাব রেখেছিলেন। অফিসিয়াল কিছু পাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে প্রস্তাবটা তখন নাকচ করেছিলাম। কারণ, ওই চাকরি করার মতো শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ছিল না আমার।
২
এমন পরিস্থিতি যে এবারই প্রথম, তা কিন্তু না। ২০১৫ সালের শেষ অথবা ১৬ সালের শুরু। তখন ব্লগে বেশ সক্রিয় আমি। ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক বিষয়ে পোস্ট বা মন্তব্য চালাচালি নিয়ে হরহামেশাই অনেকের সঙ্গে বাবানুবাদ হতো। আমি নব উদ্যমে পোস্ট করতাম বা মন্তব্য করতাম। একসময় দেখা গেল আমার বিরোধী একটা শ্রেণি তৈরি হয়ে গেছে। আমার নিরীহ পোস্টেও কেউ কেউ অহেতুক গালমন্দ করে। একজন অস্ট্রেলিয়া থেকে হুমকি দিয়ে বসল।
ওই সময়টায় কয়েকজন ব্লগারকে ইতিমধ্যে হত্যা করা হয়েছে। ব্লগ সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক প্রচারণা। আমি উপলব্ধি করলাম, বড়ো ধরনের ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছি। ব্লগে যে হত্যার হুমকি দিয়েছিল, সে ফেসবুকেও হাজির। আমি মেসেজ রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করিনি। আমার পোস্ট তখন পাবলিক করা ছিল। বেছে বেছে আমার বন্ধুদের মেসেজ দিতে লাগল। তারা যেন আমার মোবাইল নম্বরটা দেয়, সেই অনুরোধও করতে লাগল।
আমার বন্ধুরা জানত আমার লেখালেখি সম্পর্কে। তারা নম্বর দিতে অস্বীকৃতি জানাল। আমি যখন ঘটনাটা শেয়ার করে আমার নম্বরটা যেন কাউকে না দেওয়া হয় মর্মে অনুরোধ জানালাম, কয়েকজন আইডি ডিঅ্যাকটটিভ করে রাখার পরামর্শ দিল।
৩
করোনার সময় তখন। একজন নামকরা ধর্মগুরু মৃত্যুবরণ করলেন। জানাজায় বহু লোক সমবেত। দেশবাসী উৎকণ্ঠিত এই বুঝি করোনায় লাখে লাখে মানুষ মরে! আমিও পোস্ট দিলাম আরেকজন ব্যক্তিত্ব মারা গেলে তো অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাবে।
জানি না মন্তব্যটায় কী এমন ছিল, যা কারও মনোবেদনার কারণ হতে পারে! হাটহাজারি থেকে হুমকি আসতে লাগল। মজার ব্যাপার হলো, হুমকিদাতাদের প্রধান একজন নারী। আমাকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করা হবে। আরও নানা ধরনের হুমকি দিতে লাগল। বুঝতে পারছিলাম না কী এমন বলেছি।
আগে একাধিকবার ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, তাই ভয়টা আরও বেশি ছিল। তবুও মনকে সান্ত্বনা দিতাম এটা ভেবে যে, আমি তো ভুল কিছু বলিনি। একজন মানুষ কি ভালোমন্দ কিছু বলতে পারে না? মতের বিপক্ষে গেলেই কি তাকে হত্যা করতে হবে?
সক্রেটিসকে নাকি বলা হয়েছিল চুপচাপ থাকলে মাফ করে দেওয়া হবে। সক্রেটিস বলেছিলেন, “আমার বয়স হয়ে গেছে। যে ক’দিন বাঁচি, কথা বলেই বাঁচতে চাই। বোবার মতো বাঁচার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়।” ব্রুনোও তো মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিলেন।
মানুষ কথা বলা ছাড়া বাঁচতে পারে না। খাওয়া, পরার মতো কথা বলার স্বাধীনতাও দরকার। তাই বলে কাউকে হত্যা করা সভ্য মানুষের কাজ হতে পারে না। অথচ দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কথা বলতে গিয়েও রাজনৈতিক অথবা ধর্মীয় কারণে অনেককেই মরতে হয়
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০২৪ বিকাল ৪:২৭