প্রাইমরোজ পর্ব
সময়টা ছিল ঝঞ্চাবিক্ষুব্ধ। কী করব, না করব বুঝতে পারছিলাম না। সবকিছু ছেড়ে হয়তো বাড়িতেই চলে যেতে হতো। কারণ, গাজীপুরে থেকে চলার মতো সামর্থ্য ছিল না আমার। কয়েক জায়গায় সিভি জমা দিয়েছিলাম, দুটো ইন্টারভিউও দিয়েছিলাম। দুঃখজনকভাবে কোনো ডাক পাইনি।
হঠাৎই ‘শাইনিং পাথ হাইস্কুল’ থেকে সাবেক সহকর্মী ইসমাইল স্যার ফোন দিলেন। কুশলাদি বিনিময়ের পর জিগ্যেস করলেন, “বর্তমানে কী করছেন?” “কিছু না” বলতেই বললেন, “শিমুল নামে আমার এক বন্ধু ‘প্রাইমরোজ’ নামে একটা স্কুলে পড়ায়, ওখানে একটা পোস্ট খালি আছে। আপনি চাইলে দেখা করতে পারেন।” এমতাবস্থায় খুব খুশি হলাম। বললাম, “উনার মোবাইল নম্বরটা দিন।”
ইসমাইল স্যার স্কুলের অবস্থান বললেন, শিমুল স্যারের মোবাইল নম্বরও দিলেন। শিমুল স্যারকে ফোন দিলাম। উনি পরদিন দশটায় স্কুলে যেতে বললেন।
পরদিন দশটার আগে আগে স্কুলে গেলাম। “শিমুল স্যার কোথায়?” জিগ্যেস করতেই একজন বললেন, “উনি ক্লাসে আছেন।”
প্রধান শিক্ষক বসে ছিলেন। উনার সাথে পরিচিত হলাম। অমায়িক লোক। ১৭ বছর হলো স্কুলটা প্রতিষ্ঠা করেছেন। উনি অন্য জায়গায় চাকরি করতেন। তার অবর্তমানে আরেকজন প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। দূর থেকে স্কুল পরিচালনায় সমস্যা দেখা দেওয়ায় তিনি নিজেই এখন স্কুলে বসেছেন।
কিছুক্ষণ পর শিমুল স্যার এলেন। উনার সাথে বেতন সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে কথা হলো। বেতন অনেক কম। কিন্তু কিছু করার নেই। একেবারে ঝরে পড়ার চেয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকাটাও কিন্তু কম কথা নয়। তাছাড়া এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে বেতন তুলনামূলকভাবে কমই থাকে। সুপারিশ থাকায় আমাকে তাও অন্যদের চেয়ে বেশি বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলো, ৮ম এর চল্লিশ মিনিটের কোচিংও দেওয়া হলো।
সেপ্টেম্বরের ২৪ তারিখ, ২০১৮ সাল। চাকরি শুরু করলাম ‘প্রাইমরোজ’ স্কুলে। সাধারণত আমি ইংরেজি পড়াই। ইংরেজি শিক্ষক থাকায় চলে যাওয়া শিক্ষকের ক্লাস করতে হবে আপাতত। এক মাসের জন্য ক্লাসের সময়সূচি পরিবর্তন করা হচ্ছে না। নভেম্বরে তো বার্ষিক পরীক্ষাই।
প্রথমে ক্লাস করতে গেলাম ৭ম শ্রেণিতে। মোটামুটি কুড়ি জনের মতো শিক্ষার্থী। তারপর ৮ম শ্রেণিতে, তারপর আবার ৮ম শ্রেণি। পর্যায়ক্রমে ৬ষ্ঠ ও ৪র্থ শ্রেণিতে। সব ক্লাসেই মোটামুটি বাংলা পড়াতে হতো। ৮ম ও ৪র্থ শ্রেণিতে সাথে তথ্য ও বিজ্ঞান।
৮ম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ১০ জনের মতো। নিয়মিত পাঁচ-ছয় জন। পাঁচ-ছয় জনের মধ্যে দু’জন বাদে সবাই ক্লাসে অমনোযোগী। এদের পড়াতে কী যে কষ্ট করতে হলো! বিরক্তিতে মেহেদী নামের একজনকে খুব মারধরও করলাম। আরিয়ান নামের একজন ক্লাসটা অতিষ্ঠ করে রাখত। রোমান নামের একজন ছিল; সেও ছিল অস্থির টাইপ।
মিতু, শামিম ছিল ভদ্রগোছের। হাবিবা আর অন্তরা ছাত্রী হিসেবে ভালোই ছিল, কিন্তু এদের ভদ্রতার বালাই ছিল না।
৬ষ্ঠ শ্রেণিতে প্রায় ১৪ জনের মতো শিক্ষার্থী ছিল। এদের মধ্যে মিতু, রিফা, তামান্না, প্রিয়াঙ্কা, জান্নাত, সাজ্জাদ, সুদীপ, রোপমের কথা মনে পড়ছে। পড়ালেখা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে এরা প্রায় সবাই ভালো ছিল।
৪র্থ শ্রেণিতে পড়ানো অবশ্য একটু কষ্টকর ছিল। শিক্ষার্থী বেশি থাকায় খুব হৈ-হুল্লা হতো। তাছাড়া এদের ক্লাসটা শেষে হওয়ায় কে কার আগে বেরোবে সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকত। এই ক্লাসের কয়েকজনের নাম মনে পড়ছে। এরা হলো- সিয়াম, জিহাদ, মোস্তাকিম, নিলয়, জুহান, ইভা, জিমিয়া, তন্নি, ফাতিমা ও তৃষা।
৫ম শ্রেণিতে কম ক্লাস নিয়েছি। এ ক্লাসের সবাই প্রায় মেধাবী ছিল। তার স্বাক্ষরও রেখেছে। এ বছর ২৯ জনের ১৮ জনই এ+ পেয়েছে। বাকিদের নম্বর প্লাসের কাছাকাছি। এখানে কয়েকজনের নাম বলছি। এরা হলো- নবনীতা রায় পাপড়ি, পুষ্পি, এ্যানি ও অপর্ণা।
৮ম শ্রেণির রেজাল্ট খুব একটা ভালো হয়নি। তবে সবাই পাশ করেছে। ফেলের ছাত্ররা পাশ করাই বড় কথা- এটাই আপাতত সান্ত্বনা।
ডিসেম্বরে ক্লাস পরীক্ষা সব শেষ হয়ে যাওয়ায় স্কুলটা আমার কাছে বিরানভূমি মনে হলো। এমনিতে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত, শিক্ষার্থী কম; তার ওপর স্কুলের বয়োজ্যেষ্ঠ কয়েকজন শিক্ষক ‘গাজীপুর পাইলট’ নামে একটা স্কুল শুরু করলেন। ‘প্রাইমরোজ’ এর শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার তীব্র আশঙ্কা দেখা দিল।
‘শাইনিং পাথ’ এ অনেক শিক্ষার্থী ছিল। এখানে এত কম শিক্ষার্থীর মাঝে মন টিকল না। প্রধান শিক্ষককে জানিয়ে দিলাম, “আমি আর এখানে থাকছি না।” উনি আরও কিছুদিন থাকতে অনুরোধ করলেন। আমি অপারগতা প্রকাশ করলাম।
আরও দুয়েক জায়গায় কথা হয়েছিল। কোনো এক জায়গায় ঢুকে যাব বলে মনস্থির করে ফেলেছিলাম। ডিসেম্বরের শেষদিন পর্যন্তও জানতাম না অবশ্য কোথায় ঢুকব। তবে ‘নজরুল বিদ্যানিকেতন ও হাইস্কুল’ নামে একটা প্রতিষ্ঠানে মোটামুটি পাকা কথা হয়েছিল।
‘প্রাইমরোজ’ ছাড়ার পেছনে আরও কারণ ছিল। বেতন কম হওয়ায় এখানে থাকতে হলে টিউশনির ওপর নির্ভর করতে হতো। এটা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর সবসময় ইংরেজি পড়ানোতে অভ্যস্ত; এখানে ইংরেজি শিক্ষক থাকায় আমার কাছে মনে হয়েছিল আমি না থাকলেও চলবে।
স্কুলটা এমনিতেই প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে, তার ওপর আমি চলে আসায় প্রধান শিক্ষক খুব মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। আমার পরিচিত একজনকে বলেছিলেন, “উনি যদি ভালো কোথাও যেতেন, তাহলে তো সমস্যা ছিল না; উনি তো আরেকটা স্কুলেই ঢুকেছেন।”
আমি জানি না উনি কোথা থেকে জেনেছেন আমি আরেকটা স্কুলে ঢুকেছি। আমি উনাকে বলেছিলাম অন্য একটা ভালো চাকরিতে ঢুকব হয়তো। পরিশ্রম বেশি হওয়ায় আর ঢোকার চেষ্টা করিনি। উনি হয়তো ভেবেছেন, আমি উনাকে মিথ্যে বলেছি। ভাবাটাও দোষের কিছু নয়; এ প্রতিষ্ঠানের পুরোনো দু’জন শিক্ষিকা উনার সাথে প্রতারণা করে অন্য স্কুলে ঢুকেছেন।
ঠিক প্রতারণা হয়তো বলা যাবে না। এখানে সুবিধে করতে পারেননি, অন্যত্র তো যাবেনই। আমি খুব বিস্মিত হয়েছিলাম এটা জেনে যে, আমার বেতন একটু বেশি ধরায় উনারা ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন; হওয়ারই কথা অবশ্য। আমি উড়ে এসে জুড়ে বসে বেতনে বেশি ভাগ বসাচ্ছি আর উনারা বছরের পর বছর থেকে কম বেতনে চাকরি করবেন?
১ জানুয়ারি ২০১৯ ছিল বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের তারিখ আর বই উৎসব। আর ঐ দিনই ছিল ‘প্রাইমরোজ’ এ আমার ৩ মাস চাকরির শেষদিন।
৫ মাঘ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ
গাজীপুর।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০২৪ রাত ১১:১৮