কলেজের ঠিক সামনেই মহাসড়ক। ওখান থেকে পশ্চিম দিকে বেঁকে গেছে রাস্তাটা। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা মোড়। কেউ বলে তিন রাস্তার মোড়, আবার কেউ বা বলে খালার মোড়। মোড়ে ভদ্র মহিলার (খালার) একচালা একটা দোকান আছে; সেখানে শিঙাড়া-সমুচা-পেঁয়াজি বিক্রি করা হয়।
বামপাশ দিয়ে এগিয়ে গেলেই সরকারি হাসপাতাল আর ডানদিক দিয়ে গেলে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়। নামঃ ভান্ডাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে একটা নির্মাণাধীন ভবন। গৃহস্থের অর্থনৈতিক দৈন্যদশার দরুণ নির্মাণ কাজ আপাতত স্থগিত আছে। পরীক্ষামূলকভাবে এখানে একটা কোচিং সেন্টার খোলা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণি থেকে পর্যায়ক্রমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। এই কোচিংয়ের মূল উদ্যোক্তা নাজমা নামের এক মহিলা, যিনি স্থানীয় এক মহিলা কলেজে চাকরি করেন। কোচিংয়ে তার সহকারী ঐ কলেজেরই একজন পার্টটাইম টিচার লুৎফর এবং তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু মৃণাল। মাঝেমাঝে ইমন নামের স্থানীয় একজন গণিত করান।
কোচিং ভালোই চলছিল। লুৎফর গণিত পড়ায় আর মৃণাল পড়ায় ইংরেজি। পাশে আরও একটা কোচিং থাকা সত্ত্বেও এই কোচিংটা বেশ চালু হয়ে গেল। এলাকার ছেলেমেয়েরা পড়ালেখায় মনোনিবেশ করল।
মাস যেতে না যেতেই হঠাৎ করে কোচিংয়ে ছন্দপতন শুরু হলো। লুৎফর আসা কমিয়ে দিল। কারণ, হিসেবে জানাল; এখান থেকে বেশি টাকা-পয়সা আসবে না। বাস্তবিকই টাকা-পয়সা ঠিকমতো আসেনি। নাজমা ম্যাডাম যে আশার কথা শুনিয়েছিলেন, সে আশার গুড়ে বালি! প্রত্যন্ত গ্রাম তো, এখানে প্রাইভেট-কোচিংয়ের প্রচলন খুব কম। অভিভাবকগণ পড়ালেখার পেছনে টাকা-পয়সা খরচ করতে কৃপণতা করেন।
কোচিংটা চালানো বেশ কঠিন হয়ে গেল। বেশিরভাগ সময় সবগুলো ক্লাস একাই করাতে হতো মৃণালকে। ফলে ক্লাসে বিশৃঙ্খলা দেখা দিত। ইমন তো মাঝেমাঝে আসত।
লুৎফরকে ধরে-বেঁধে আবারও কোচিংয়ে নিয়ে আসা হলো। সপ্তাহে একদিন, দু’দিন আসে। এভাবেই কোনোমতে দিন চলছিল। এর মধ্যে লুৎফর আরেক কাহিনী শুরু করল। অষ্টম শ্রেণির জান্নাত নামের একজনকে শুধু মনোযোগ সহকারে পড়ায়, আর নবম শ্রেণির চম্পাকে। ওরা সম্পর্কে ফুফু-ভাতিজি। বাকিদের প্রতি তার কোনো নজর নেই। আর সব ছেলেমেয়ে এ নিয়ে কানাঘুষা শুরু করল। বহুবার লুৎফরকে সতর্ক করা হলো, অথচ সে দিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই।
সপ্তাহে ছয় দিন মৃণাল কোচিংয়ে আসে। বিকেল থেকে রাত্রি ন’টা-দশটা পর্যন্ত থাকে। ছেলেমেয়েদের একাই সামলায়। জান বেরিয়ে যায়, তবু কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ করেও কি কোনো লাভ আছে?
কোনো কারণে একদিন কোচিংয়ে যেতে পারেনি মৃণাল। ওইদিন লুৎফর গিয়েছিল। পরদিন মৃণাল গিয়ে দেখল, পুরোনো অনেকেই আসেনি। কয়েকদিনের মধ্যে দেখা গেল, তারা কোচিংয়ে আসা একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে। এত কষ্ট করে দাঁড় করানো কোচিংয়ের এমন হাল হলো কেন বুঝতে পারল না মৃণাল ? পরে জানা গেল, চম্পারা ঠিক করেছে লুৎফরের কাছে প্রাইভেট পড়বে। এই কোচিংয়ে আর আসবে না।
পরিশিষ্টঃ চম্পারা পরে আর লুৎফরের কাছে প্রাইভেট পড়েনি। তারিখ দিতে থাকে আর পেছাতে থাকে। বান্ধবীরা মিলে একদিন পড়ে গিয়েছিল অবশ্য! পরে আর আসেনি। পড়ানোর জন্য লুৎফর আলাদা একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিল। এবার সে ফাঁপড়ে পড়ে। ইতোমধ্যে মৃণালের সাথেও তার ব্যবচ্ছেদ ঘটে যায়।
তারপরও শেষ পর্যন্ত মৃণাল কোচিং চালিয়ে যায়। নাজমা ম্যাডামের সাথে তার একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চুক্তি ছিল। অন্যদের সাথেও চুক্তি ছিল। কিন্তু কেউ সে কথা মনে রাখেনি। শুধু মৃণাল রেখেছিল। নামকরা একটা স্কুলে চাকরি হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও পাশাপাশি কোচিং ধরে রেখেছিল সে।
সংসারে শুধু অর্থবিত্তেরই প্রয়োজন হয় না; মায়া, ভালোবাসা, বিশ্বাস ও দায়িত্ববোধেরও প্রয়োজন হয়। ক্ষণিক এ জীবনে কারও সাথে প্রতারণা করে কী লাভ? মানুষ আর ক’দিন বাঁচে?
মৃণাল কারও বিশ্বাস ভাঙতে চায় নি। কোচিং ধরে রাখার পাশাপাশি উচ্চ মাধ্যমিকের দু’জন শিক্ষার্থীকে নামমাত্র টাকায় পড়িয়েছিল। যদিও নতুন স্কুলে ভালো টাকা-পয়সার সংস্থান হয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল, তবুও বিবেকের কাছে পরাজিত হতে চায়নি সে। তাছাড়া গ্রামের অবশিষ্ট দরিদ্র ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু করতে চেষ্টা করতে পারায় তার মধ্যে এক প্রকার স্বর্গীয় প্রশান্তিও ছিল।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০