মাস্টার্সে অধ্যয়নরত অবস্থায় ইশকুলে ঢোকা; প্রতিষ্ঠানটার নাম “রোজবাড প্রি-ক্যাডেট স্কুল”। এরপর নানান ঘটনা পরিক্রমায় কেটে যায় ছয় মাস। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ আসত প্রতিনিয়ত। অভিযোগগুলোর মধ্যে ছিলো: তার পাঠদান পদ্ধতি ভিন্ন; বাচ্চারা এমন কি খোদ অভিভাবকগণও পড়ানোর ধরণ বুঝতে পারেন না, অত্যাধিক শাসনে রাখে বাচ্চাদের, পাঠ্যক্রম বহির্ভূত পড়ালেখা করায়, ক্লাসে গল্প-গুজব, গান-বাজনা করায় ইত্যাদি। মুখস্ত বিদ্যার মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের মগজ পূর্ণ করা হচ্ছে; এর বিপরীতে সৃজনশীল পড়ানো কি দোষের? জীবনে কি শৃঙ্খলার কিংবা বাহ্যিক জ্ঞানের প্রয়োজন নেই? সবসময়ই কি বাচ্চাদের পড়ালেখা ভালো লাগবে? মাঝেমাঝে তো চিত্তবিনোদনের প্রয়োজন! কে কাকে বোঝাবে এসব?
এখনকার অভিযোগ আরও ভয়াবহ! শাসন তো বটেই, তার কারণে ছেলেমেয়েরা বখে যাচ্ছে; সে একটা নাস্তিক, বেয়াদব ইত্যাদি।
ইশকুলে বিচার বসেছে। পরিচালনা পর্ষদের সকল সদস্য, শিক্ষকবৃন্দ সকলে উপস্থিত। বিচারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো তাকে ইশকুল থেকে বের করে দেওয়া হবে। কেউ তার পক্ষে কথা বলল না; এহেন সিদ্ধান্তের কেউ প্রতিবাদ করল না! সবাই মূর্তির মতো বসে রইল!
এর মধ্যে একটা করুণ ঘটনাও ঘটেছে। জনৈক অভিভাবক তার সাথে অসদাচরণ করেন। তার দোষ ছিল এই, ছেলেমেয়েরা ক্লাসে অত্যাধিক গন্ডগোল করছিল; ক্লাস নিয়ন্ত্রণে আনতে সে তাদের কয়েকজনকে প্রহার করে। উত্তম-মধ্যমের মাত্রাটা বোধহয় একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। তাতে কী? শিক্ষক কি শিক্ষার্থীকে শাসন করতে পারেন না?
অভিমান করে সে ইশকুল ছেড়ে দেয়, কিন্তু অধ্যক্ষের অনুরোধে পুনরায় ফিরতে হয়েছিল। ফিরে এসে আরও প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হতে হলো! যারা তাকে চায়নি, তারা বেজার! তাকে তাড়াতে তারা উঠেপড়ে লাগল! অবাক করা ব্যাপার হলো, যাদের সে নিকটজন ভাবত, তারাও তার বিরুদ্ধে।
তার আগে জন্মদিন নিয়ে একটা ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটে যায়। জুনের চার তারিখে ছিল তার জন্মদিন। সে উদ্যাপন করতে চায় নি; তাতে আগ্রহও ছিল না! কিন্তু ছেলেমেয়েদের জোরাজুরিতে করতে বাধ্য হয়েছিল। “মান্থস অব দ্যা ইয়ার” কবিতা পড়ানোর সময় ঘটনাক্রমে জন্ম তারিখের বিষয়টা প্রকাশ্যে আসে। পালন না করলে ছেলেমেয়েরা তার সম্পর্কে বিরুপ ধারণা পোষণ করত। একটা কেক কিনতে আর কয় টাকা লাগে? ছেলেমেয়েদের চাওয়া-পাওয়ার তো একটা দাম আছে, না? এটা পালন করতে গিয়ে যে এমন অঘটন ঘটবে কে জানত?
মিটিংয়ে আরও অভিযোগ ছিলো: ছেলেমেয়েদের রোজা রাখতে দেওয়া হয় না, নামাজ পড়তে দেওয়া হয় না, যারা জন্মদিনে আসেনি, তাদেরকেই নাকি মারা হয়েছে। দশটা-বারোটার সময় ছেলেমেয়েরা হাঁপিয়ে ওঠে, নামাজ পড়তে গিয়ে রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করে; ওদের যদি পড়ালেখায় মনোনিবেশ করানো হয়; এটা কি দোষের কিছু? খোদা কি এত নিষ্ঠুর এসব দুধের বাচ্চার এবাদতের জন্য মুখিয়ে থাকবেন?
অভিযোগ শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ও বুঝতেই পারেনি ওর বিরুদ্ধে আরও গভীর ষড়যন্ত্র দাঁনা বেঁধে ওঠেছিল। ও থাকলে অনেকেরই সমস্যা! টিউশন বাড়ছিল ক্রমশ ওর। পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস দেওয়ার কথা ভাবছিলেন অধ্যক্ষ। এর আগে শুধু তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে ক্লাস নিত। ইংরেজি পড়াত সে। মাঝেমাঝে ধর্ম। এক ধর্ম পড়াতে গিয়ে অন্য ধর্ম চলে এলে কেউ কেউ নাক সিটকাত। বাচ্চাদের মধ্যেও উগ্রতার বীজ কে বপন করেছে? আরেক জনের অগ্রগতি কি বাঙালি সইতে পারে?
নাস্তিক হলে কার কী? পরমতসহিষ্ণুতা বোঝানো কি দোষের? পৃথিবীতে তো আরও ধর্মাবলম্বী আছে, তাদের অস্বীকার করা সম্ভব? সে বুঝতে পারে নি বেয়াদবি কোথায় করল? দেখা হলে বড়োদের আদাব-সালাম তো সবসময়ই দিয়েছে। নিজেদের ভাগে কম পড়বে, তাই কি তাকে সরানো?
ছেলেমেয়েরা তাকে অপছন্দ করে; এমন প্রমাণও নেই। সে চলে আসায় অনেকেই চোখের জল ফেলেছে। একটা বিষয় অবাক করা; যাদের বেশি আদর করা হয়েছে, তারা কমই কেঁদেছে; কেঁদেছে তারা, যাদের বেশি মারধর করা হয়েছে। দুনিয়া বড় অদ্ভূত!
মাঝে মাঝে মনে মনে ভাবে সে উলুবনে মুক্তা ছড়িয়েছে। তার বাসায় অনেক ছেলেমেয়ে দেখা করতে এসেছে। এখনও রাস্তায় দেখা হলে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদে; এসব দেখে কারও কি মনে হবে সে অপছন্দের কেউ? জন্মদিনে কাউকে আসতে বলা হয়নি; যার মন চেয়েছে, সে-ই এসেছে। কোনো উপহারও গ্রহণ করা হয়নি। তাহলে কেন এত হইচই? মফিজ স্যার কী করে ছেলেমেয়েদের হুমকি দিলেন এ বলে যে, জন্মদিনে যারা আসবে, তাদের পিটুনি দেওয়া হবে?
জন্মদিন পালন করায় পাপের কী? ছেলেমেয়েদের শুধুমাত্র কেক খাওয়ানো হয়েছে। অভিভাবকগণ জন্মদিন নিয়ে কোনো কথা বলার কথা নয়, কারণ, যারা আসবে, তারা কেউ রোজা রাখার অবস্থানে নেই।
মোস্তফা স্যার, হারিস স্যার শুরু থেকেই ওর বিরুদ্ধে লেগেছিলেন। এমন নোংরা হয় কেন মানুষ? ওর কি বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে স্নেহ-ভালোবাসা পাওয়ার কথা ছিল না? মাঝে মাঝে শিক্ষকদের সমালোচনা করেছে; তারা কি সমালোচনার ঊর্ধ্বে? তারা তো এমন অনেক কাজ করেছেন, যা তাদের বয়সের সাথে যায় না।
ইশকুল ছেড়ে দিয়ে এক হিসেবে ভালোই হয়েছে তার। ইগোতে আঘাত লাগলে কেউ টিকতে পারে? মান-সম্মানের একটা ব্যাপার তো আছে নিশ্চয়ই। তার হাতে এখন অফুরন্ত সময়! কোনো প্রকার জঞ্জালতা নেই। কেউ কোনো বিষয়ে চাপ দেয় না। এখন সে যেখানে পড়ায়, সেখানে বেতন দেয় ভালো; সম্মানও আছে, স্বাধীনতাও আছে। টাকা-পয়সা ঠিকমতো পেলে কিছু অভিযোগ হয়তো সহ্য করা যায়। টাকাও কম, আবার প্রতিনিয়ত অভিযোগও; সেটা কি সহনীয়? টিউশনি করেই যদি টাকা কামাতে হয়, তাহলে ইশকুল কেন?
বাসাটা সে পরিবর্তন করে ফেলবে ভাবছে। এ পরিবেশে থেকে দম বন্ধ হয়ে আসে। একটু নিস্তার প্রয়োজন। কিন্তু ছাড়তেও মন চায় না! মায়া জন্মে গেছে যে! যাদের সাথে এতদিন ছিল, সে ছেলেমেয়েদের জন্য এখনও তার পরান পোড়ে; চোখে অশ্রু ঝরে!
২৭ শ্রাবণ ১৪২৪ বঙ্গাব্দ
ভালুকা, ময়মনসিংহ।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০২৪ সকাল ১০:৪৬