সেদিন সন্ধ্যের পর সেনবাড়ি রোড ধরে মেসে ফিরছিল অনিকেত। যথারীতি তার কাঁধে ঝোলানো ছিল একটা থলে। তার থলে সবসময়ই বিভিন্ন প্রকার বইয়ে পরিপূর্ণ থাকে। আজও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সার্কিট হাউজ মাঠে একটা বিশেষ কাজে গিয়েছিল। ওটা সারতে সারতে বেলা গড়িয়ে যায়। অবশ্য মাঝে মাঝেই সে সার্কিট হাউজ, কিংবা পার্কে যায়। বিশেষত শুক্রবার দিন পার্কে যাওয়া তার নিত্য-নৈমিত্যিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশাখী মঞ্চের পাশে কতিপয় সাহিত্যিকদের খোলামেলা আড্ডা হয়। সে-ও তাদের সাথে শরিক হয়।
সেনবাড়ি রোডে হঠাৎ কী কাজে দাঁড়িয়েছে অনিকেত! আচমকা রাস্তার ওপাশে নজর গেল। এ যে অধরা! দেখতে আগের চেয়ে সুন্দরী হয়েছে। তার সাথে আরও একজন, বান্ধবী হবে হয়তো। অধরা বোধহয় অনিকেতকে দেখেনি। মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছে। আবার এমনও হতে পারে, দেখেও না দেখার ভান করছে।
অনিকেত আর অধরা একই কলেজে পড়ত। সুন্দরী থাকায় কলেজে অধরার বেশ পরিচিতি ছিল, নামডাক ছিল। কলেজের ছেলেরা ওর পেছনে লেগেই থাকত। টগর নামের একটা ছেলে তো পড়ালেখাই ছেড়ে দিল। অধরা কাউকে পাত্তা দিত না।
অনিকেত রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান। নারীর প্রতি কখনোই তার কোনো আকর্ষণ ছিল না। থাকলেও তা প্রকাশ পেত না। মেঘে ঢাকা চাঁদের মত ছিলো তার যৌবন। মনের আকাশ হতে সে মেঘ সরাতে পারেনি কখনও।
সহপাঠীরা অনিকেতকে নানা আর অধরাকে নানি বলে ডাকত। এমন কী একজন শিক্ষকও অধরাকে নানি ডাকতেন। সে শুধু হাসত। প্রথম প্রথম খুব বিব্রত হতো অনিকেত। ধীরে ধীরে সয়ে গিয়েছিল সব। মনের মাঝে কী একটা অদ্ভুত অনুভুতি দাঁনা বাঁধতে লাগল ধীরে ধীরে; যা একসময় মহীরুহে পরিণত হয়।
অধরার পায়ে একটা সমস্যা ছিল। হাঁটার সময় বাঁ পা একটু বেঁকে যেত। প্রবাল ব্যাপারটা প্রথমে লক্ষ্য করেছিল। যারে ভালো লাগে, তার ছোটখাটো সমস্যাও ভালো লাগে।
অনিকেত আর তুহিন প্রতিদিন টেম্পুযোগে কলেজে আসত। তুহিন অনিকেতের কলেজের বন্ধু। কলেজে বেশির ভাগ সময় তারা এক সাথে-ই কাটাত। ফেরার পথে টেম্পু স্ট্যান্ডে অধরার অপেক্ষায় তারা কত সময় যে কাটিয়েছে, আজ ভাবলে খুব হাসি পায় অনিকেতের।
চৌরাস্তা হতে উঠত তুহিন আর বাজার হতে উঠত অনিকেত। অধরা আসত বনকুয়া হতে। প্রায়ই তাদের দেখা হয়ে যেত। কেউ কোনো কথা বলত না। সকলের মাঝে এক প্রকার দ্বিধা কাজ করত। কেন যে দ্বিধা কাজ করত, আজও আবিষ্কার করতে পারেনি অনিকেত।
অধরা একটা ছেলেকে ভালবাসত। সে নানান মুখরোচক কথাবার্তা বলত অনিকেতের সাথে। অনিকেত বিশ্বাস করত না কোনোকিছুই। কিন্তু একসময় বিশ্বাস হলো, যখন সেই ছেলে কিছু আপত্তিকর খুদেবার্তা দেখাল। বুকের মাঝে কেমন যেন একটু ব্যথা লাগল অনিকেতের।
সবকিছু জানার পরও অধরাকে খুব ভালো লাগত অনিকেতের। তাকে নিয়ে কত কবিতা লিখেছে, না ঘুমিয়ে কত রাত কাটিয়ে দিয়েছে। কেন এমন হয়, সে তখনও কিছু বোঝেনি। এখন অবশ্য সবই বোঝে। এখন বোঝে তো কোনো ফায়দা নেই। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে দু’জন দুই কোচিং সেন্টারে ভর্তি হলো। পরস্পরের দেখা হয়নি অনেকদিন। একদিন এক ছেলের সাথে রিকশার হুড তুলে কোথাও যাচ্ছিল অধরা। অনিকেতকে দেখে সে মুখ ঢেকে রেখেছিল। অনিকেত পরে জেনেছিল অধরা ঐ ছেলেকে ভালোবাসে; ছেলেটার নাম রানা। কিছুদিন পর অনিকেত জানতে পারল, রানা অধরাকে বাসে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেছে।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর দীর্ঘদিন অধরার সঙ্গে দেখা হয়নি অনিকেতের। শুনেছিল রানার সাথে অধরার সম্পর্ক ভেঙে গেছে। পারিবারিক কারণে অধরার পড়ালেখা একবছর বন্ধ ছিল।
অনিকেত আর অধরা এখন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। অধরা অনিকেতের এক ক্লাস জুনিয়র। পরস্পরের কদাচিৎ দেখাও হয়েছে, কথাও হয়েছে কয়েকবার। অধরা এখন আবার নতুন প্রেম কাহিনী শুরু করেছে। মাঝে মাঝে তাকে প্রেমিকের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে দেখা যায় অন্তরঙ্গ অবস্থায়।
১২ ভাদ্র ১৪২১ বঙ্গাব্দ
সেনবাড়ি রোড, ময়মনসিংহ।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০২৪ সকাল ৯:৫৭