সাদা চাদরে ঢাকা আমার নগ্ন শরীর , মাথার উপর সাদা সিলিং শুয়ে শুয়ে নিজের হৃৎপিন্ডের উলুধ্বনি শুনতে পাচ্ছি । একটু পর জীবনের খুব বাজে একটা খবর শুনতে পাবো । ঘড়ির কাটার টিক টিক শব্দ শুনতে পাচ্ছি, বেশীক্ষন শুয়ে নেই তবু যেন মনে হয় যুগ যুগ ধরে আমি বিচানায় শুয়ে আছি। আমার হাত-পা; চোখ-কান, জিহ্বা সব সচল কিনত্ত নিজেকে মৃত মনে হচ্ছে ।নিজের শরীরটা হাসপাতালের বেডে রেখে মনটা ছটফট করে ডানা মেলে উড়ে বেরাচ্ছে হাসপাতালের করিডোরে, এই সিঙ্গল রুম টায়, নার্সদের বসার জায়গায়, সামনের লবিতে । লবিতে বসা একজন পুরুষ কাঁদছে, কি জানি তার কি কস্ট ? কি যন্ত্রনা !
করিডোরে নার্সদের বসার জায়গা এক পাসে , কয়েকজন মনোযোগ দিয়ে মনিটরে কি যেন দেখছে, দূরে ৬০৩৯ রুমে একজন নার্স দৌড়ে গেলো মুমূর্ষু রুগীর অবস্হা হুট করে খারাপ হয়েছে দেখবার জন্য , আমার মত লারে লাপ্পা টাইপ রুগী নয়। পুরুষ এটেনডেন্ট একজন খাবারের ট্রলি টানতে টানতে লিফটের দিকে যাচ্ছে । নাহ্ ক্লান্ত হয়ে গেছি উড়তে উড়তে যাই ফিরে ৬০০৮ নম্বরের সেই কেবিনে যেখানে পড়ে আছে আমার জীবিত দেহ ।
আমি আনুসকা , বাবা রাশিয়ায় পড়তে গিয়েছিলেন সেখানে এই নামের মেয়ের সাথে তার বেশ মাখো মাখো টাইপ বন্ধুত্ব হয়েছিলো।
দেশে ফিরে বিয়ে অবশ্য আমার মাকেই করেছিলেন। কিন্ত্ত আনুশকা নামটি ভুলে যেতে চাননি । আমাকে ডেকে হয়তো পুরোনো দিন গুলো মনে করতেন জানি না জিজ্ঞেস করা হয়নি কখোনো। আমি গতকাল এই নামডাক ওয়ালা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি । হুমম আমার আসাটা ছিলো রাজকীয়, হাসপাতালের সদ্যকেনা দামী এম্বুলেন্স চড়ে তবে এসেছি । তিন বছর ধরেই আমার বুকের বা দিকে হঠাৎ হঠাৎ ব্যাথা ।
একদিন অফিসে বা হাতে শেলফের উপর থেকে ফাইল নামাতে গিয়ে ব্যাথায় কুঁকরে উঠলাম । সেই প্রথম এমনতর ব্যাথা, এর পর প্রায়ই এমন হতে থাকল । শেষ পর্যন্ত না থাকতে পেরে সনামধন্য হাসপাতালে দেখাতে গেলাম। নানা টেস্ট, নানা ঔষধ, নানা রকম রিপোর্ট নিয়ে একের পর এক ডাক্তারের কাছে দৌড়া দৌড়ি লেগেই আছে ।
যেদিন প্রথম বিশেষজ্ঞ ডাক্তার গম্ভীর মুখ করে আমাকে বললেন, আজকাল এসব অসুখ কোনো ব্যাপারি না, আপনার স্তন ক্যানসার
উপযুক্ত চিকিৎসা নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি কেবল শক্ত হন আর একটু কোপারেট করুন । বিশ্বাস করুন আমার এমন হাসি পেল, মনে হচ্ছিল বাংলা সিনেমা দেখছি । সিনেমায় যেমন নায়ক নায়িকার ক্যান্সার হয়, কেমন একটা মন খারাপ করা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজে । আমার তেমন কিছুই মনে হয়নি, কেবল চোখের সামনে আমার সন্তানের কচি মুখ টা মনে পড়ছিল। আমি না থাকলে
ও অনেক কষ্ট পাবে । আমার নিজের মা নেই তাই আমার সন্তান মা হারা হোক আমি তা কোনোদিন চাই নি । কিন্তু যে বিরাট শিশু খেলিছে এ বিশ্ব লয়ে আনমনে উনি তো আর আমার মনের ইচ্ছা
অনিচ্ছার থোরাই কেয়ার করেন !
গত তিনটি বছর স্তন ক্যানসারের সাথে লড়াই করছি নিরবে , খুব কাছের কিছু মানুষ ছাড়া তেমন কাউকে বলিনি । নিজেকে আমার আজকাল এন্জেলিনা জোলির মত লাগে, হা হা হা হা.........।
আমি এই হাসপাতালের বেডে শুয়ে অপেক্ষা করছি আমার কেমোর
সময় হয়েছে কিনা , হলে কেমোর দিন ক্ষন ঠিক করবার জন্য ।
আমার শীত শীত লাগছে , ভয়ে ঘেমে যাচ্ছি,বার বার মনে হচ্ছে আমায় যেন কেমো দিতে না হয় । বেড এ শুয়ে শুয়ে ভাবছি কেন ডাক্তার আসছে না । প্রতীক্ষার প্রহর যেন কাটেনা ।
আমি আমার ছোট্ট সোনামানিক কে কি বলবো ? মা মনি আর থাকবেনা, আর কেউ কোলে নিয়ে গান গাইবেনা তোমাকে, স্কুল থেকে ফিরে দৌড়ে আর কারো গলা জরিয়ে ধরবে না তুমি । আমার ওড়না নিয়ে শাড়ী পড়ে তুমি আর বলবে না মামনি টিপ দিয়ে দাও ।
আমার হাতে গোনা কটা মাস এর মধ্যেই সব গুছিয়ে নিতে হবে যাতে আমার মা মনি বড় হয়ে বুঝে আমি ওকে ছেড়ে যেতে অনেক কষ্ট পেয়েছি । ডিভোর্সের পর আমার একমাত্র সন্তানই আমার সব সুখ আমার সবটুকু । ওকে ওর বাবার কাছেই থাকতে হবে আমি না থাকলে । বাবার কাছে থাকতে যেন কোনো আর্থিক কষ্ট না হয় সেটুকু আমি করতে পারবো কিন্তু এর বেশি তো আমি কিছু করতে পারবো না। হে ঈশ্বর আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে কেন ?? আর তো পারি না ...........