কত অসম্ভব চিন্তা মানুষ করতে পারে। আমি হঠাৎ ভাবলাম একটা ব্যাঙ্গের পিঠে একটা প্রজাপতি বসে আছে। অথবা উল্টোটা, একটা বিশাল মথ তার পিঠে ছোট একটি ব্যাঙ নিয়ে উড়ে যাচ্ছে। কোন ধরণের যৌক্তিকতা ছাড়াই কল্পনা। বাস্তব দূর থাক; স্থান, পাত্রের কোন যৌক্তিক সম্মিলন ছাড়াই কল্পনা করতে পারলাম। কারণ মানুষের কল্পনা শক্তি অসীম। অবশ্য সমস্ত মহাবিশ্বের সসীম বস্তু দিয়েই তার কল্পনা অসীম। যা কিছু মহাবিশ্বে নেই তার বাইরে কিছুই আমরা কল্পনা করতে পারি না, আমাদের জ্ঞানের সীমা দেয়া আছে। এখন প্রশ্ন হল কম্পিউটার যদি মানুষের চেয়ে অধিক বুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে যায় সেক্ষেত্রে কি হবে ? এখানে একটা জিনিস আমার অসম্ভব মনে হয়।
কম্পিউটার মানুষের চেয়ে অধিক বুদ্ধিসম্পন্ন স্মৃতি ধরে রাখায়, জ্ঞান সঞ্চয় করায়, সুপার ফাস্ট গতিতে অংক কষায়, কোন বিষয়ে অজস্র সমাধানে মুহূর্তে সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত দিতে পারায় ইত্যাদি ইত্যাদি ক্ষেত্রে হতে পারে, কিন্তু অসীম কল্পনায় কি সে অধিক বুদ্ধিসম্পন্ন হতে পারবে ? কম্পিউটার তো সেট করা প্রোগ্রামের বাইরে কিছুই করতে বা ভাবতে পারে না। প্রশ্ন হতে পারে অবাস্তব, অহেতুক কল্পনা আমরা কেন করবো । কেন করবো তার অনেক কারণ আছে। সেই কারণ আলাদাভাবে বিস্তৃত লিখতে হবে। এইখানে যেটা উত্থাপন হল সেটার উত্তর কি? ন্যূনতম কোন ধরণের সংযোগ ছাড়া কি কম্পিউটার কিছু কল্পনা করতে পারবে ? হ্যাঁ, ধরা যাক, তার ভেতর পৃথিবীর সকল প্রাণীর তথ্য ও ছবি ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এমনকি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াসহ অতি আণুবীক্ষণিক সব। তারপর একটার সাথে আরেকটা মিলিয়ে কিম্ভূত প্রাণী বানানোর প্রোগ্রামও সেট করা দেয়া হয়েছে। এবার আপনি টাস্ক দিলেন সমস্ত প্রাণী একটার সাথে আরেকটা, প্রতিটার সাথে প্রতিটা মিলিয়ে প্রাণী বানাতে। সে বানিয়ে চললো। এটা কি আদৌ শেষ হবে আপনার মনে হয়। যত সে বানাবে তত নতুন প্রাণীর সাথে আরেকটা মেশানো যাবে। এটা একের সাথে এক যোগ করতে করতে যাওয়ার মত অসীম।
একটা খুবই সাধারণ ঘটনায় একশ জন মানুষের মাথায় একশ রকম ধারণা জন্ম নিল এবং একশটা নতুন ভাবনা এলো। কম্পিউটারে কি পৃথিবীর তাবৎ মানুষের ভাবনার সূত্র পুরে দেয়া সম্ভব ? মানুষ কিভাবে ভাবে, মানুষের মস্তিষ্ককে কি পুরোপুরি আবিষ্কার করতে পেরেছে বিজ্ঞান ? মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতা তথা ভাবনা প্রবাহিত হওয়ার সমস্ত সূত্র আবিষ্কৃত হলে পৃথিবী থেমে যাবে। কারণ তখন প্রতিটা মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। জলের মত স্বচ্ছ হয়ে যাবে প্রতিটা মানুষকে পড়তে পারা এবং তার ভাবনার রাস্তা ট্র্যাস করা। অর্থাৎ গণিতের মত হিসাব নিকাশ করা যাবে মানুষের ভাবনার ধারা। কিন্তু গণিতে একের সাথে এক যোগের মত একটা সাধারণ সমস্যারই অসীম ফল হয়। তাহলে মানুষের ভাবনার সূত্র তো সেই কল্পনার মতই অসীম।
কিন্তু হ্যাঁ, যারা খুব বেশী ভাবেনা অর্থাৎ বস্তুগত প্রয়োজনের বাইরে মস্তিষ্ককে খাটায় না, তাদের ভাবনার সীমাটা জাগতিকতার যৌক্তিক সীমায় আবিষ্কার করা যাবে। কিন্তু এখানে ফাঁকটা হচ্ছে মানুষ যেকোন সময়ই ভাবনা শুরু করে দিতে পারে। মানুষের এই ইচ্ছে বন্দী করার কোন রকম, কোন রকমেরই উপায় নেই। সেক্ষেত্র যারা নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তারা মৌল অনুভূতির ম্যানিপুলেশনের আশ্রয় নেয়। খাদ্য যেমন একটি মৌলিক চাহিদা, অর্থাৎ ক্ষুধার প্রয়োজন না মিটলে তথা শক্তি না পেলে মানুষের ভাবনা একসময় থেমে যাবেই, ঠিক তেমনি এমন কতগুলো প্রভাবক আছে যেগুলো দিয়ে মানুষের ভাবনার ম্যানিপুলেশন করা যায়। এগুলোর প্রভাবে মানুষ ভাবতে চাইবে না, ভাবতে ভয় পাবে এবং ভাবনার অবকাশই পাবে না। বর্তমানে পৃথিবীর সাতশ কোটি মানুষের মধ্যে হয়তো ছয়শ নিরানব্বই কোটি মানুষই ভাবনার ম্যানিপুলেশনের শিকার। মাত্র এক কোটি মানুষ পুরোপুরি ভাবনার নিয়ন্ত্রণমুক্ত আছে। এটা আমার একটা সাধারণ অনুমান। এখন কম্পিউটারে মানুষের ভাবনার সাধারণ এই সীমাটুকু ঢুকিয়ে দেয়া সম্ভব। তাহলে, এখন যতটা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে মানুষ তখন তার চেয়ে অনেক অনেক বেশীগুন, প্রকৃতপক্ষে প্রায় পুরোপুরিই নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
হাজার হাজার বছর ধরেই মানুষের ভাবনার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এবং নিয়ন্ত্রকরা সেভাবেই নিয়ন্ত্রণ করে শোষণ করে গেছেন। কিন্তু এখন ব্যাপকভাবে পৃথিবীর সমস্ত প্রান্ত থেকে মানুষের চিন্তার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে এক জায়গায় পুঞ্জিভূত করার কাজ শুরু হয়ে গেছে। কারণ সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে শিক্ষার ফলে মানুষ প্রয়োজনের চেয়ে বেশী ভাবতে শুরু করে দিয়েছে। তাই প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে বিগত কয়েক দশক ধরেই মানুষের ভাবনার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের এই প্রক্রিয়া চলছে। কম করে হলেও একশ বছরের অগ্রিম চিন্তা করে সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন প্রযুক্তি দুনিয়ার রাজা বাদশাহরা। দুইশ কোটিরও অধিক মানুষের ডাটা ইতিমধ্যেই তাদের ভাণ্ডারে আছে। ভাবনার নিয়ন্ত্রণহীন এক কোটির মধ্যে যারা নিয়ন্ত্রণের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তারা অহর্নিশি এসব ডাটার এনালাইসিস করে যাচ্ছে। মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে একেবারেই ভুলে যাবে অথবা বুঝবেই না যে তার সাথে অন্যায় হচ্ছে যখন তার চিন্তাশক্তি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়বে।
আমরা কি আমাদের চারপাশে দেখতে পাচ্ছি কিভাবে প্রযুক্তির দাসে পরিণত হয়েছে সবাই। প্রতিনিয়ত ইন্টারনেটের অসংখ্য জায়গায় মানুষ অজান্তে তার তথ্য দিয়ে দিচ্ছে। বিভিন্ন ধরণের বিনোদন এবং প্রয়োজনের আড়ালে চলছে এসব সংগ্রহ। একসময় সামন্তবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষ বন্দী ছিল, শোষিত হয়েছে। বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন পূর্বের তুলনায় স্তিমিত হলেও তার রাষ্ট্রব্যবস্থা পুঁজিবাদ দ্বারা শোষিত হচ্ছে মানুষ। আর ভবিষ্যতে প্রযুক্তির আগ্রাসনে মানুষ বন্দী হতে যাচ্ছে। ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে এই, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে বন্দী থাকলেও মানুষের ভাবতে পারার ক্ষমতা অনেকটাই মুক্ত ছিল, অর্থাৎ ম্যানিপুলেশনের চেষ্টা থাকলেও মানুষের চিন্তাশক্তি শোষকদের নিয়ন্ত্রণে খুব বেশী ছিল না, ফলে সময় সময়ই মানুষ বিদ্রোহ করেছে, শোষকরা পরাজিত হয়েছে। আবার নতুন বুদ্ধি বের করে ক্ষমতায় টিকেছে। কিন্তু এখন চিন্তাশক্তিকেই যখন নিয়ন্ত্রণ করা হবে তখন শোষণটাই তো শোষিতরা বুঝতে পারবে না। জোম্বির মত তারা জীবন পার করে দেবে আর জীবনের সবটুকু রস ও আনন্দ উপভোগ করবে নিয়ন্ত্রণকারীরা।
বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা থামানোর কোন প্রশ্ন ওঠে না, কিন্তু প্রযুক্তির আগ্রাসন থামানোর চেষ্টা বা বিকল্প বুদ্ধি অবশ্যই বের করতে হবে। এমন কিছু বুদ্ধি আছে যেগুলো প্রকাশও করা যাবে না। শুধু গোপনে কাজ করে যেতে হবে। যাঁরা মানুষকে নিয়ে ভাবেন, মানুষের কল্যাণের কথা ভাবেন, পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য চিন্তা করেন তাঁদের এই বিষয়টা নিয়ে অনেক গভীরভাবে ভাবতে হবে। দূরদর্শী হতে হবে, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর গতি প্রকৃতি বুঝতে হবে। এবং তাঁদের মধ্যে যাঁদের ক্ষমতা আছে তাঁদেরকে কমপক্ষে ১০০ বছরের, নিদেন পক্ষে ৫০ বছরের অগ্রিম পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আমার নিজের কিছু পরিকল্পনা আছে, কিন্তু আমার কোন ক্ষমতা নেই। আমি জানিনা, কোথায়, কিভাবে, কাদের সাথে এসব পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ ও কাজ শুরু করা যাবে। কিংবা আমার ভাবনা চিন্তাগুলো আদৌ কেউ বুঝবে কিনা, মূল্য দেবে কিনা।
মধ্যবিত্ত যারা ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখে অথবা যারা এখন ধনীদের খুব কদরদাতা নিজেদের সুদিনের আশায়, তারা জানেনা তারাও যে পুরোপুরি ম্যানিপুলেশনের শিকার হবে। তাদের ধনী বন্ধুরা কোনদিনই নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী বাড়তে দিতে চাইবে না। এবং নিজেদের বুদ্ধিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে এমন বুদ্ধির উত্থানকে তারা সর্বোতভাবেই রুখে দিতে চাইবে। সুতরাং এই শ্রেণীর মানুষরা গরীবের বন্ধু না হলেও, আপাতত নিজের যতটুকু আছে সেটা টিকিয়ে রাখার জন্য নিজেদের স্বার্থেই তাদেরকেও এই প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমে অংশ নিতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১৪