২০৫০ সাল। পৃথিবীর সব ভাষা থেকে, সব ডিকশনারি থেকে 'বিশ্বাস' শব্দটি তুলে দেয়া হয়েছে। প্রযুক্তির এত চরম উৎকর্ষের সময় ‘বিশ্বাস’ নামক শব্দটি থাকতে পারে না। সবকিছুই এখন তথ্য প্রমাণ নির্ভর। প্রমাণ ছাড়া মানুষ কিছুই গ্রহণ করে না। পৃথিবীর মানুষের অহেতুক ফালতু আবেগও আর নেই। একেবারে ২+২=৪ গণিতের মত কংক্রিট প্রামাণিক সমাজ ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে মানুষ। তাই বিশ্ব মোড়লদের এই সিদ্ধান্ত সবাই বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছে। তো এই সিদ্ধান্ত নেয়ার সপ্তাহখানেক পরে বাংলাদেশের একটি আধুনিক গ্রামে সরকারি রিলিফ দিতে অত্যন্ত সৎ একজন মানুষ এসেছেন ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে। তিনি অত্যন্ত বিজ্ঞান মনস্ক এবং যুক্তি সম্মত মানুষ। সঠিক তথ্য প্রমাণ ছাড়া একদম কিছু করেন না। সেখানে রিলিফ নিতে আসা লোকজন সারিবেধে দাঁড়িয়ে ছিল। একজন ঢুকলো অফিসে।
-তোমার নাম কি ?
-রবিউল ইসলাম।
-তোমার নাম যে এটা তার প্রমাণ কি?
-এই যে আমার জন্মসনদ।
-জন্মসনদ তো ভুয়া বানানো যায়।
-তাহলে চলেন স্যার, এই যে পাশেই আমার বাড়ি, আমার মা বাবাকে জিজ্ঞেস করবেন।
-তোমার মা বাবা সত্য বলবেন তার নিশ্চয়তা কি? তাছাড়া তুমি যে তাদের সন্তান তারই বা প্রমাণ কি?
-কি যে বলেন, আমাদের আশেপাশের সব প্রতিবেশীকে জিজ্ঞেস কইরা দেখেন।
-তুমি যে সব প্রতিবেশীকে হাত করে রাখোনি তার নিশ্চয়তা কি? আর প্রতিবেশীরা কিভাবে প্রমাণ দেবে যে তুমি তাদেরই সন্তান।
-আশ্চর্য! আপনার যখন এত সন্দেহ হইতেছে তখন চলেন ডিএনএ টেস্ট করাই। এরপর তো আপনার আর সন্দেহ থাকবে না।
-ডিএনএ টেস্ট যে ডক্টর করবেন তিনি যে সত্য রিপোর্ট দেবেন তার প্রমাণ কি? তুমি তো তাকে হাত করে রাখতে পারো। আবার নতুন মেশিন কেনার টাকা খেয়ে নষ্ট মেশিন দিয়েই তারা রিপোর্ট দিয়ে দেয় কিনা তারও তো নিশ্চয়তা নেই।
-এমন কেন ভাবছেন, মেশিন নষ্ট না ভালো তা প্রমাণ করা যাবে। আপনি নিজেও টেস্ট করতে পারবেন।
-ধরো আমি নিজেই করলাম, তাতেও তো এটা প্রমাণ হয় না যে তোমার নাম ‘রবিউল’ রাখা হয়েছিল।
রবিউল আর ভেবে পেলো না কিভাবে সে প্রমাণ করবে তার নাম যে রবিউল। একইরকম সন্দিহানে সেখানে উপস্থিত আর কারো পরিচয়ই প্রমাণ করা গেলো না। এমন হতবিহবল ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে তারা কোনদিন ভাবেইনি। রবিউলের ছেলে সজীব মাঠে খেলছিল। সে এসে জিজ্ঞেস করলো, আব্বা বাড়িত যাইবা কখন? রবিউল ছেলের দিকে তাকালো এবং জিজ্ঞেস করলো, আমি যে তোর আব্বা এইডার প্রমাণ কি? সজীব ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো। সে যেন বুঝতেই পারছে না প্রশ্নটার মানে কি? আশেপাশের সবাই এই প্রশ্ন শুনে এগিয়ে এলো। এক ঝলক একে অপরের মুখের পানে চাইলো তারা, মুহূর্তেই যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো সবার মাথায়। সমস্বরে সবাই চেঁচিয়ে উঠলো ‘পৃথিবীতে সবকিছু প্রমাণ করা যায় না, সবকিছুর ১০০ভাগ নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। মানুষের উপর বিশ্বাস রাখতেই হবে। যে ‘বিশ্বাস’ শব্দটিকে ভাষা থেকে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে তা ফিরিয়ে আনা হোক। সবকিছু প্রমাণ করতে করতে একটা সময় বিশ্বাসে এসে আমাদের থামতেই হবে, বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরতেই হবে। এর ওপাশে যাওয়ার আর কোন সুযোগ নেই। তা নাহলে আমাদের জীবন স্থবির হয়ে পড়বে। সমাজ সৃষ্টিই হয়েছিলো মানুষের একে অপরকে বিশ্বাসের উপর। যতই উন্নতি হোক, তথ্যপ্রমাণ, যুক্তি ও প্রযুক্তির সম্ভার বাড়ুক তবুও দাঁড়িয়ে থাকতে হবে বিশ্বাসের উপরেই। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক যৌক্তিক, গাণিতিক, প্রাযুক্তিক নয়, মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক আবেগিক ও মানবিক’। সরকারি অফিসার একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ দেশের সুপ্রিম পর্যায়ে বার্তাটি পাঠিয়ে দিলেন। এদিকে লোকজন সবাই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘটনাটি জানিয়ে দিলো। খুব দ্রুতই ভাইরাল হয়ে গেলো সেটি। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই বিশ্ব মোড়লরা আবার আলোচনায় বসতে বাধ্য হলেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ১০:০৩