এই শহরটার আসল রূপ দেখতে চান? রাত দশটার পর বেরিয়ে পড়ুন। সঙ্গে কিছু খুচরো পয়সা রাখতে পারেন। আর কিছু নয়। পথ হাঁটুন ইচ্ছেমতো। কিছু পাঁড় মাতাল আপনাকে হাত উঁচিয়ে ডাকবে অন্ধকার গলির দিকে। পাত্তা দেবেন না। ছিনতাইকারি এসে ভুলভাল ছুরি দেখালে একগাল হেসে পকেট দেখাবেন। দু’চারটে চড়ের শিল্প হয়তো জুটবে কপালে, সে কিছু নয়। মন খারাপ না করে হাঁটতে থাকুন। অনেক দেখার বাকি। কোন মহল্লার সিকিউরিটি গার্ডের বেমক্কা চিৎকারে থামবেন না। ঐ শালারা ঘুমের মধ্যেই মিছে বকে। হাঁটুন আপনি।
হাঁটতে থাকুন পীচের কালো পথে, ফুটপাথ জুড়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলো পাশ কাটিয়ে। মাথার ওপর যদি আস্ত অথবা অর্ধেকটা চাঁদও মেলে, বেশ তো! সেই চাঁদের আলোয় পথ চলুন, সাবধান চাঁদের দিকে তাকাবেন না। কোন ঘুমন্ত পথশিশুকে মাড়িয়ে যাবেন যে! আর তাছাড়া চাঁদ নয় এ শহরটাকেই চিনতে বেরিয়েছেন। রাস্তাগুলো রাতের নিস্তব্ধতায় অথবা নিয়ন আলোর রহস্যময়তায় ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। বদলে যাচ্ছে রঙ। হঠাৎ সাঁই সাঁই একটা-দুটো ট্রাক ছুটে গেলে হলদে আলোয় চমৎকার দেখবেন ধুলোর নৃত্য। সস্তা প্রসাধনি ও উৎকট লিপিস্টিক মাখা দু-একজন শীর্ণকায় গনিকা আপনাকে দেখতে পেয়ে খিলখিল হাসিতে ডাকবে। দেখেও দেখতে পাবেন না আপনি। সন্তের মতো পথ হাঁটুন।
মন থেকে মুছে ফেলুন বিগত দিনগুলোর হাসি-কান্নার সারৎসার। মুছে ফেলুন অসুস্থ বাবার তিলতিল অভিমানের নিরুপায় বিস্ফোরণ, পরশ্রীকাতর স্ত্রীর সামনে হাঁটুগেঁড়ে বসা নিজস্ব অক্ষমতার তীব্র অন্ধকার, স্কুলগামী বোনটির যাত্রাপথে ছড়িয়ে থাকা সামাজিক দুর্গন্ধের উৎকট যন্ত্রণা। মুছে ফেলুন রোদজ্বলা দিনের গল্প,সামাজিক মুখোশের অসহ্য রঙ, কর্মমুখর বেজন্মা সভ্যতার কটু গন্ধ, টায়ারের ঘষটানি, আটকে যাওয়া প্রমোশনের কষ্ট, সস্তা টিভি সিরিয়াল দেখে মেকি হেসে ওঠা মুখস্ত সন্ধ্যার স্মৃতি, নিজস্ব অবক্ষয়ের সাত-পাঁচ-নয়-ছয়। ওভারব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে দিগ্বিজয়ি সম্রাটের মতো গ্রহণ করুন দক্ষিণের সমুদ্র থেকে ছুটে আসা হাওয়ার অভিবাদন। বহুদিন আগে কেঁচোর মতো বেঁকে যাওয়া মেরুদন্ডকে আবার ইস্পাত হয়ে আকাশ স্পর্শ করতে দিন। ভাবুন আপনি অনাদি ও অকৃত্রিম। ভাবুন আপনি স্বনির্ভর এক স্বয়ম্ভূ সত্তা। ভাবুন ও বিশ্বাস করুন।
ভাবতে ভাবতে ধীর পায়ে চলে যান নদীর ধারে। কে না জানে, শহরের আরেকটা মানে তিরতির বয়ে যাওয়া দূষিত জলের স্রোত ও কৃতঘ্ন মানুষের কলওয়ালা নৌকোর বিষণ্ণ বিলাপ। লক্ষ্য করুন, আকাশ এর মধ্যেই লাল চাদরে ঢাকছে নিজেকে। চাঁদটা হারিয়ে গেছে অলক্ষ্যে, নিভে গেছে নিয়ন আলোরা। অবশ্য এসব কিছুই আপনার চূড়ান্ত দ্রষ্টব্য নয়। আপনি অনেকটা পথ হেঁটে এসে ক্লান্ত-অবসন্ন শরীরে এসে দাঁড়িয়েছেন নদীতীরে। শিমুল তুলোর মতো নরোম কুয়াশা জড়িয়ে ধরেছে আপনাকে। পাখিরা হঠাৎ হঠাৎ ডাকছে। জেগে উঠছে পৃথিবী। নদীর জলে তাকিয়ে দেখছেন আকাশটা কিরকম উবুড় হয়ে আছে। এবার আরো কাছে যান জলের, ভালো করে লক্ষ্য করুন। দেখুন তো, দেখতে পান কিনা নিজেকে আবিষ্কারের আনন্দে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠা কোন নিঃসঙ্গ ঈশ্বরের প্রতিবিম্বকে। বাঁ হাত দিয়ে ধীরে চোখের জলটুকু মুছুন, দেখতে থাকুন, যতক্ষণ না ঘুম
ভাঙা মানুষের ঢল নেমে আসে শহরের পথে...
২ জুলাই,২০১২