১)
রান্নাঘরে অযথাই জিনিসপত্র আছড়ে ফেলে লাবনী,লাভ হয় না কোনো। যার দৃষ্টি আর্কষন করতে চায়,সেই সাহেব মহা আরামে আয়নার সামনে তৈরি হচ্ছেন।যদিও মুরাদের চোখমুখ বিষন্ন,তবু লাবণী জানে যে মনে মনে আনন্দে গড়াগড়ি দিচ্ছে তার স্বামী।
দিবেই তো!
এত কষ্টে জমানো টাকা নিয়ে ফরিদপুরে নিজের মতো ফুর্তি করে এসেছে পাঁচদিন। একবার কি ভেবেছে নিজের বউ-ছেলের কথা?ভাবলে তো টাকাটা ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে হলেও জমিয়ে রাখতে পারতো।
বিয়ে পর থেকে দেখছে প্রতি বছর এই বিশেষ সময়ে ফরিদপুর যায় মুরাদ। কই যায়,কেন যায়-তার ব্যাখ্যা দেবার প্রয়োজন মনে করে না বউকে। কিন্তু এইবার রের্কড। না বলে কয়ে পাঁচটা দিন পড়ে ছিল ফরিদপুরে। ফিরেছে ঘন্টা খানেকও হয়নি,আবার বেরিয়ে যাচ্ছে এখন।
‘তুমি আমারে বইলে দ্যাও।আমারে ভালো না লাগলে বইলে দ্যাও.. ..আমি আব্বার কাছে চইলে যাই। এইভাবে তোমার সাথে ঘর করবো না আমি।’
স্ত্রীর উত্তপ্ত কণ্ঠস্বরে বিচলিত হয় না মুরাদ,‘বছরে একটা বারই তো!
এইরকম করো ক্যান?’
‘করবো না ক্যান?বলো,করবো না ক্যান?’এবার মনে জমে থাকা ক্ষোভ গুলোকে চিৎকার বানিয়ে বের করে দিতে থাকে লাবনী।‘ফরিদপুরে কোন বউ আছে তোমার,কার কাছে যায়ে পাঁচ দিন থাইকে আসছো তুমি?নিজের কোনো দোষ নাই,খালি আমি জিজ্ঞেস করলে দোষ!’
‘রাগ করো ক্যান।তোমারে তো বলছি,আমার একটা বন্ধুর কবর আছে ফরিদপুরে।প্রত্যেক বছর তার কবর দেখতে যাই আমি।’
‘মরা বন্ধুর কবর দেখতে যায়ে জমা টাকা গুলি এইভাবে নষ্ট করবা তুমি?ভাব দেইখে মনে হয় দুনিয়াতে তার আর কেউ ছিল না,ছিলা কেবল তুমি একা।সব দ্বায়িত্ব তোমার একলার।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুরাদ,‘সত্যি তার কেউ ছিল না দুনিয়াতে। মা ভাগছিল এক লোকের সাথে আমেরিকায়,বাপে অন্য মেয়ে মানুষ নিয়ে থাকতো.. ..বাদ দাও ওই সব,মানুষের নামে গীবত করতে নাই।’
কথা আর বাড়ায় না,চলে যায় মুরাদ স্ত্রীকে ফেলে। এবং করার মতো কিছু না পেয়ে কাঁদতে শুরু করে লাবনী।আল্লাহ তাকে এমন স্বামী কেন দিলো যার কাছে সংসারের চাইতে বন্ধু আপন?
প্রত্যেক বর্ষাকালে এখন পানি পড়ে ছাদ থেকে,মেরামত না করালে আর একটি বর্ষাও পার হবে না।ছেলে স্কুলে যাওয়া শুরু করবে সামনের বছর থেকে,ইচ্ছা আছে ভালো একটা স্কুলে পড়াবার।বিছানার তোষকটা একদম ঝরঝরে হয়ে গেছে,তার পরনের শাড়িগুলো হযে গেছে মলিন আর বিবর্ণ।
.. .. ..এইসব কেন চোখে পড়ে না মানুষটার?কেন চোখে পড়ে না?
২)
টুংটাং শব্দে রিকশা যায়,মাঝে মাঝে একটা দুটো গাড়ি। তাও জোরে নয় খুব বেশী,হর্নও বাজায় না। এজন্যই মনে হয় ভার্সিটি এলাকাতে পাখির ডাক শুনতে পাওয়া যায় কখনও-সখনও।
পাশাপাশি বসে থাকি আমরা তিনজন,কথা বলি না বিশেষ। বাদাম খাওয়া হচ্ছে। এবং আমি নিশ্চিত,বাদাম শেষ হওয়া মাত্র উঠে চলে যাবে শুভ। মাত্র বি.বি.এ শেষ করেছে সে,তার এখন অনেক কাজ। আমাদের সাথে বসে থাকার মত ফালতু সময় নেই।
মুরাদ ভাই অবশ্য বুড়িয়ে গেছেন অনেক। মাথার চুল কমে গেছে,ভুড়ি হয়েছে বেশ বড়সড় একটা। কোথায় যেন একটা মোবাইল ফোনের দোকানে কাজ করেন আজকাল,আমরা ঠিক জানি না। তিনি বলেননি,আমি বা শুভও জানতে চাইনি।
বছরে একটা দিনের জন্যে যাদের দেখা হয়,তাদের এত সামাজিক আলাপের প্রয়োজন পড়ে না। তবে শুনেছি বিয়ে করেছেন মুরাদ ভাই,একটা ছেলেও হয়েছে। ছেলের নাম ইমন।
অবশ্য বয়স হলেও মানুষটা আছেন কিন্তু সেই আগের মতোই। আজই ফিরেছেন ফরিদপুর থেকে,এসেই আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছেন। উনার বুক পকেটে রাখা একটা ছবি,যেটা দেখার ব্যাপারে আমাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। কিন্তু মনে হচ্ছে ছবিটা না দেখা মাত্র আমাদের আজ নিস্তার দেবেন না কোনো ভাবেই।
‘তোরা তাইলে দেখবি-ই না?? টুমপা.. ..তুই-ও না?’
শক্ত চেহারায় ঘাড় নাড়ি আমি,‘দেখবো না।’
‘ফালতু প্যাচাল বাদ দ্যান তো,মুরাদ ভাই।’ চরম বিরক্ত শুভ।‘এইরকম করলে আপনার সাথে দেখা করতে আসবো না।’
‘এই রকম করিস ক্যান?একটা ছবিই তো!’
‘আপনার ছবি আপনার কাছেই রাখেন।’
এরপর আর কেউ কোনো কথা বলে না। আমিও না। একদিন আমরা চারজন ছিলাম। চারজন থেকে বিয়োগ হয়ে তিনজন হয়েছি। একদিন দুজন হবো,তারপর হয়তো এক।
সব গ্র“পেই একজন সুপার গ্লু থাকে,যে জোড়া দিয়ে রাখে সবাইকে পরষ্পরের সাথে। যে মানুষটা প্রথমে চলে গেছে,আজকাল মনে হয় সে-ই ছিল আমাদের গ্র“পটার সুপার গ্লু। সে নেই,গ্রুপও নেই। বছরে একদিনের আনুষ্ঠানিকতা আছে শুধু।
‘শুনলাম আপনার ছেলে হইছে,মুরাদ ভাই।’
‘হু.. ..’
‘ছেলের নাম নাকি ইমন রাখছেন?’
‘হু.. ..’
‘ব্যপারটা বেশী নাটকীয় হইলো না?’মনে হয় আবার েেপ যাচ্ছে শুভ।‘এইরকম ফাইজলামির মানে কি? যে গেসে,সে গেসেই। তার নিয়ে অত আহলাদ কিসের?’
‘তোর কাছে ফাইজলামি মনে হচ্ছে,কারণ বেশী কাবিল হয়ে গেছোস তেরা!’ একটু যেন উষ্ণ মুরাদ ভাই।‘আমি অত কাবিল হই নাই,আমার তাই ফাইজলামিও মনে হয় না।’
‘মনে হয় না বইলেই তো বুক পকেটে ছবি নিয়ে ঘুরেন।’
‘তোদের দেখানোর জন্যে আনছি। রাগ করিস ক্যান,পাগলা?’
মুরাদ ভাইয়ের নরম কণ্ঠস্বরে বোধহয় আরও রাগ করে শুভ।‘আমার সাথে বেশী খাতির দেখাইতে আইসেন না। বুড়া হচ্ছেন,আর ভিমরতী বাড়তেছে।’
বুক পকেট থেকে ছবিটা বের করে শুভর দিকে বাড়িয়ে দ্যান তিনি,‘ছবিটা একবার দ্যাখ না। খুব সুন্দর হইছে.. .. ..পুরাটা সাদা টাইলসে.. ..’
‘মরা মানুষের কবর নিয়ে আহলাদ করার মত টাইম আমার নাই। সাত-আট বছর হওয়ার পথে,আর কতদিন এইরকম আহলাদ করবেন?’ছবিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাঁটা ধরে শুভ। হেঁটে চলে সোজা,ফিরে তাকায় না একবারের ভুলেও।
আমি অবশ্য নজর ফেরাতে পারি না। কেননা ছবিটা এসে পড়ে আমার আমার কাছাকাছি। সাদা টাইলসে বাঁধানো একটা কবর,রোদের আলোয় চকমক করছে.. .. ..
আমাদের হারিয়ে যাওয়া “সুপার গ্লু” এর কবর এটা। আমাদের হারিয়ে যাওয়া সেই মানুষটার কবর,সেই বন্ধুর-ইমন ছিল যার নাম। সাতটা বছর আগে আজকের দিনে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল সে অনেক অনেক দূরে। এবং সেই দিনটির পর থেকে বছরে মাত্র একবার দেখা করি আমরা.. .. ..
তার মৃত্যু দিবসে দেখা করি!!
কথাও বলি না বিশেষ। এমনকি যে চলে গেছে,তার কথাও নয়। শুধু পাশাপাশি বসে থাকি কিছুটা সময়,আর তারপর হারিয়ে যাই যার যার গন্তব্যে। পরবর্তী একটি বছরের জন্য।
আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে সাত বছরে এই প্রথম চোখ মোছেন মুরাদ ভাই। ‘কবরটা বান্ধানো একদম ইমনের ইচ্ছা মতন হইছে.. .. ..সাদা টাইলসের কবর,যেই রকম ওর পছন্দ ছিল.. ..’
বসে বসে ছেলেমানুষের মতন কাঁদেন তিনি। তবু আমি নিশ্চুপই থাকি। কারণ আমি জানি,ইমনের কবরটা তিনিই বাঁধিয়েছেন। একটা দোকানের সাধারণ কর্মচারী মুরাদ ভাইকে সেই খরচ যোগাতে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে,তা-ও আমি আন্দাজ করতে পারি।
আর পারি বলেই চুপ করে থাকি র্স্বাথপরের মতন।
বেঁেচও তো আছি স্বার্থপরের মতনই।
পরিশিষ্ট ঃ
বাড়িটা এত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে! একবার তাকালে তাকিয়েই থাকতে মন করে। আলোকসজ্জার সোনালি বাতি গুলো জ্বলছে-নিভছে, যেন দূর আকাশের তারা গুলো সোনালি হয়ে গেছে কোনো ভাবে।
এষা আপাদের বাড়ি এটা!
সেই এষা আপা,যে মেয়েটাকে পাগলের মত ভালোবাসতেন ইমন ভাই। এবং যে হৃদয়হীন মেয়েটা খুব নিষ্ঠুরের মত ছিন্ন করেছিল ইমন ভাইর সাথে দীর্ঘ সম্পর্কের বন্ধন।
এবং আজ এষা আপার বিয়ে!
দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথম বিয়েটা হয়েছিল গোপনে,ইমন ভাইয়ের সাথে। মাঝে মাঝে মনে হয় ইমন ভাইয়ের মৃত্যুতে বোধহয় খুশিই হয়েছিল এষা আপা। কেননা ডিভোর্সের পরেও বেহায়ার মতন এসে ইমন ভাই দাঁড়িয়ে থাকতেন বাড়ির সামনে। রোজ। অনুনয়-বিনয় করতেন না ঠিকই,কিন্তু তার সেই দাঁড়িয়ে থাকার মাঝে প্রকাশ পেতো অদ্ভভুত একরকম তীব্র আবেগ।
আজ রাতে তাহলে কি করতেন ইমন ভাই??
দাঁড়িয়ে থাকতেন,বরাবরের মতোই-জানে শুভ। আর তাই সে-ও দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়। ঠিক যেভাবে প্রায়ই এসে সে দাঁড়িয়ে থাকে এই বাড়িটির সামনে।এষা আপার কঠোরতম দৃষ্টি উপো করে দাঁড়িয়ে থাকে।
এই গল্পের হৃদয়হীণ অংশটা হচ্ছে-এষা আপা বেছে বেছে ঠিক আজকের দিনটিতেই বিয়ে করছেন।
ঠিক আজকের দিনটিতেই.. .. ..
যেই দিনে মারা গেছেন ইমন ভাই!