কাল আরও তিনটি গাছ কেটে ফেলা হলো। অসংখ্য থেকে মাত্র পাঁচটি অবশিষ্ট ছিল,তাদের মাঝ থেকে কাল বিয়োগ হয়ে গেলো আরও তিনটি। “হাই রাইজ বিল্ডিং” হবে,ঝকমকে নতুন বিল্ডিং। কিছু পুরানো বৃক্ষের চাইতে একটি “হাই রাইজ বিল্ডিং” বোধহয় শহরের জন্যে অনেক বেশী জরুরী।বাড়ছে মানুষ,তাদেরকে থাকার জায়গা তো দিতে হবে!
কিন্তু যখনই এই এলাকার একটি গাছ কাটা হয়,আমার মনে হয় একজন আপনজন হারিয়ে গেলো আমার জীবন থেকে।কেননা এই প্রত্যেকটি গাছ আমার শৈশবের অংশ। ছোট বেলায় আমি যখন খুব নিঃসঙ্গ একটি শিশু ছিলাম,এই গাছ গুলোই ছিল আমার কথা বলার সঙ্গী-সাথী।
আমি জানি,অনেকেই আমার লেখা পড়ে হাসছেন।মনে মনে ভাবছেন,এই পৃথিবীতে মানুষের জীবনেরই কোনো মূল্য নেই।আর গাছ!! আসলে কি জানেন-এই পৃথিবীতে যখন আর প্রয়োজনীয় সংখ্যক গাছ অবশিষ্ট থাকবে না,তখন হার মানতে হবে মানুষকেও।না থাকবে গাছ,না থাকবে মানুষ। আমাদের জীবনের জন্যেই গাছেদের জীবন জরুরী।
আমাদের বাড়িটার পশ্চিম দিক জুড়ে ছিল শুধূ গাছ আর গাছ।ফাঁকে ফাঁকে ছিল কয়েকটি টিন শেড বাড়ি আরএকতলা একটি সুবিশাল পুরনো বাড়ি।সেই বাড়িটির একটি জিনিস আমার খুব পছন্দের ছিল-বাড়িটি যেখানে তৈরি করা হয়েছিল,সেই জায়গায় সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা নারিকেল গাছগুলোকে মালিক কতৃপক্ষ কাটেননি। বরং সেই বাড়ির একটি ঘরের ছাদে কংক্রিটের ঢালাই না দিয়ে টিনের ছাদ করে দেয়া হয়েছিল,যাতে ঘরে মাঝে পড়ে যাওয়া নারিকেল গাছটি কাটা না পড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে উচু করে।
আজ সেই বাড়িটি নেই,নেই অসংখ্য অসংখ্য বৃক্ষরাজির একটিও।তার পরিবর্তে দাঁড়িয়ে আছে আট-আটটি উচুঁ ইমারত।আর তাদের মাঝে শেষ দিন গুনছে অবশিষ্ট দুটি নারিকেল গাছ।ছোট বেলায় যখন করমচা পারতে যেতাম,লাঠি হাতে তেড়ে আসতেন পাড়ার এক নানু। নামটা শেফালী হলেও সবাই তাঁকে ডাকতো “পাগলী-নানু” বলে।কেননা এলাকায় একটি গাছ কাটা হলেই ভীষণ চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিতেন তিনি,শাপ শাপান্ত করতেন।নানুন কাছে তাড়া খেয়ে ফেরার সময় আমি প্রত্যেক দিন ভাবতাম-“দাঁড়াণ,একদিন আমিও বড় হবো।আর তখন আপনার সব গাছ কেটে সাফ করে ফেলবো!”
তাই-ই হয়েছে।পূরণ হয়েছে আমার মনোবাসনা(!!!)। এই এলাকাতে এখন সবুজে চিহ্নই খুঁজে পাওয়া ভার।গাছ তিনটি কাটা নিয়ে আজ বিস্তর ঝগড়া হয়েছে আমার ছোট মামার সাথে।পরিবারের কাছে তীব্র তিরস্কৃত হয়েছি,কারণ আমার কারণে পাড়ায় নাকি মান-সম্মান আর কিছু অবষিষ্ট রইলো না।কিন্তু না,লাভ হয়নি কোনো।প্রাণ দিতেই হয়েছে গাছগুলোকে, যদিও অনায়াসে তাদের জীবন না নিয়েও তৈরি করা যেতো বিল্ডিংটি।
আপনার যারা আমার লেখা পড়ে হাসছেন,তারাই আসলে ঠিক।এই পৃথিবীতে মানুষের জীবন নিতে আমরা কসুর করি না সেখানে গাছের জীবন তো কোনো ব্যপারই নয়।আবার আমাদের মধ্যে অনেকের মনে সদিচ্ছা থাকলেও হয়তো ইচ্ছাটার প্রতিফলন ঘটাতে পারি না।দরিদ্র এই বাংলাদেশে অনেক কিছুই আমাদের সাধ্যের মাঝে নয়।কিন্তু চেষ্টা তো করাই যেতে পারে,তাই না?তাতে তো ক্ষতি নেই কিছু!!
দৈনন্দিন জীবনে ছোট্ট কিছু পরিবর্তন দিয়ে শুরু করা যেতে পারে।উদাহরণ স্বরূপ-পলিথিনের ব্যাগ পুরোপুরি বর্জন করি আসুন।কেউ কেউ হয়তো বলবেন-“আমি একা বন্ধ করলে কি হবে?”কিন্তু আসলে কি জানেন,বিন্দু বিন্দু করেই তো সমুদ্র তৈরি হয়।নিজে যদি ব্যবহার না ছাড়েন,তবে অন্যকে ছাড়বার উপদেশ কি করে দিবেন?পরিবেশের জন্যে হুমকি স্বরূপ সবকিছুকে এই মুহুর্তে হয়তো আমরা বর্জন করতে পারবো না,কারণ বিকল্প আমাদের কাছে সহজলভ্য নয়।কিন্তু যেটুকু বর্জন করতে পারবো,সেটুকু করার চেষ্টা তো করাই যেতে পারে।
নিজেদেরকে সৃষ্টির সেরা জীব মনে করা আমরা মানুষেরা একটি কথা ভুলে গেছি.. .. .
আমরা ভুলে গেছি যে, যখন আমরা ছিলাম না তখনও পৃথিবী ছিল। আবার যখন আমরা থাকবো না,তখনও পৃথিবী থাকবে। আমাদের কারণে পৃথিবীর অস্তিত্ব নয়,পৃথিবী আছে বলেই আমরা আছি। পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার আমাদের সেবার জন্যে নয়,বরং সাহায্যের জন্যে। সকলেই আমরা নিজের বাড়িটিকে ভালোবাসি,তাতে একটু আঘাত এলে প্রতিহত করতে সব্বোর্চ লাগিয়ে দেই।
এই পৃথিবীটাও তো আমাদেরই বাড়ি-নয় কি?কি ক্ষতি হবে,যদি নিজেদের মাতৃগ্রহটির প্রতি আমরা প্রদর্শন করি কিছুটা সম্মান এবং মমতা?
যে গ্রহটি লক্ষ বছর যাবত আমাদের বুকে আগলে রেখেছে,সেই আমরাই আজ গ্রহটির জীবনের জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছি!!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০০৯ দুপুর ২:২৩