আজ তার মৃত্যু দিবস।
যে মানুষটা আমাকে শেখানোর চেষ্টা করতো-".. ..শোন পান্ডু, মানুষে মানুষে কোনো দিন ভেদাভেদ করনি না। (করলে একটা চড় খাবি!).. .. ..কালো হোক-সাদা হোক, ছেলে হোক-মেয়ে হোক, ধনী হোক-গরীব হোক, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্ঠান এমনকি ঘোর নাস্তিক হোক.. .. তাও কোনোদিন ভাগ করবি না। দুনিয়ার মানুষ সবাই সমান,সবাইকে মানুষ মনে করবি। মানুষ হিসাবে সম্মান দিবি (না দিলে শিওর একটা চড় খাবি!),বদলে তুই-ও মানুষ হিসাবে সম্মান পাবি। মানুষের শরীরে জন্ম নিলেই কেউ মানুষ হয়ে যায় না। মানুষ হওয়ার জন্যে সাধনা করতে হয়,বুঝলি বেকুব?.. .. .."
আমাকে লেখা শেষ চিঠিটাতে এমনই লিখেছিল সে। ৮ই মার্চ,২০০৯.. ..যার ৭ম মৃত্যু দিবস।
নিয়ম করে আমাকে প্রত্যেক সপ্তাহে একটা চিঠি লিখতো সে। যদিও আমাদের দেখা হতো রোজই,তবুও । মা চলে গেছিলো অন্য পুরুষের হাত ধরে, বাবা ব্যস্ত তরুনী প্রেমিকাদের সাথে। আর লেখাপড়া ছেড়ে বাউন্ডুলে হয়েছিল সে। সারাদিন পথে পথে ঘুরতো তার সাতাশ বছরের তরুণ বিষন্ন মনটা,আর দিন শেষে গিয়ে ঘুমাতো "বাড়ি" তকমা আঁটা সেই চার দেয়ালের খাঁচায়।
রাজ হচ্ছে গুরূ(ওর পুরো নাম ছিল রাজীব হাসান ইমন),আর আমি শিষ্য। ছায়া হয়ে ঘুরতাম আমি ওর সাথে সাথে। যে মেয়েটির প্রতারণায় ভেঙেছিল ওর হৃদয়,দিনে একবার সেই মেয়েটির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমরা দুজন। এক ঠোঙা বাদাম খেয়ে শেষ করতে করতে যতটা সময় দাঁড়িয়ে থাকা যায়।
যেদিন মারা গিয়েছিল সে,সেই মেয়েটির বাড়ির সামনে থেকেই ফিরছিলাম আমরা। আমি,রাজ,মুরাদ ভাই আর শুভ। কোচিং শেষ করে বের হয়েছি, চোখমুখ হয়তো কান্তিতে শুকিয়ে গেছিলো। হাসতে হাসতে রাস্তা পার হচ্ছিল সে,মনটা কেন যেন সেদিন খুব ভালো ছিল তার-"এই পান্ডার বাচ্চাটাকে এখন আমি আইসক্রিম খাওয়াবো.. .."
এরপর যে কি হয়েছিল,সেটা মনে করতে অস্বীকৃতি জানায় এখন আমার মন। শুধু মনে পড়ে স্কুটারের মাঝে আমি আর মুরাদ ভাই দুপাশ থেকে শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম ওকে,ওর রক্তে ভিজে ভিজে যাচ্ছিল আমাদের শরীর। মুরাদ ভাই বারবার বলছিলেন-"চোখ বন্ধ করিস না.. ..চোখ বন্ধ করিস না..."
কিন্তু চোখ বন্ধই করেছিল সে। চিরকালের জন্য।
ঠোঁটের কোণে আশ্চর্য একটা হাসি নিয়ে!
ওকে “ভাই” বলে ডাকতাম আমি-কেবলই ভাই,আগে পিছে অণ্য কিছু নেই। আর সে আমাকে অদ্ভভুত একটা নাম দিয়েছিল-“পান্ডু”। পান্ডু মানে নাকি পান্ডার বাচ্চা।
এস.এস.সি পরীক্ষার সময়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো সে আমার হলের বাইরে। কলেজে ভর্তি হবার পর রোজ সকালে কলেজে পৌছে দিয়ে আসতো,আবার ছুটির সময়ে নিয়ে আসতেও ভুলতো না কোনোদিন। কাসের পড়া পড়াতো আমাকে,চুলে বেণী করে দিতো। বেকুব-সেকুব আমাকে দিনরাত শেখানোর চেষ্ট করতো-
বিনয়ী হবি,পান্ডু। বিনয়ের কোনো বিকল্প নাই।
মানুষ হওয়ার চেষ্টা করবি,জাস্ট একটা মেয়ে-মানুষ হবি না।
অহংকার করবি না কখনও। কাউকে ছোট ভাববি না। কারও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আঘাত করবি না,কটু কথা বলবি না কাউকে। মন দিয়ে লেখাপড়া করবি .. .. ..ইত্যাদি কত কিছু যে আমাকে শেখানোর চেষ্টা করতো!
এই আহাম্মক আমি তোর কাছ থেকে কিছুই শিখতে পারিনি রে, ভাই। মন দিয়ে লেখাপড়া করিনি,তুই চলে যাওয়ার পর একটা বর্ষ বিরতী দিয়ে ফেলেছি একাডেমিক জীবনে। তোর একটা গুনেও গুনান্বিত হতে পারিনি-বিনয়ী হতে পারিনি,নিরহংকারী হতে পারিনি। তুই যেভাবে মানুষকে ভালোবাসতি,সেই ভাবে ভালোবাসার গুনটাও আয়ত্ত করে উঠতে পারিনি।
তুই বেঁচে থাকলে নিশ্চই খুব নিরাশ হতি আমাকে দেখে! কেননা বিগত সাতটা বছরে একটা দিনও বাড়েনি আমার বয়স। আটকে আছে সেই ৮ই মার্চের বিকালে।
আমি এখনও সেই বোকাসোকা বালিকাই রয়ে গেছি-যে আইসক্রীম দেখলে খুশিতে সবগুলো দাঁত বের করে ফেলে,ধমক খেয়েও ফিকফিক করে হাসে,রাস্তা পার হতে হাঁটু কাঁপে যার।
তোর গল্প আমি খুব কাছের কিছু মানুষকে বলি প্রায়ই। শুধু গল্পের শেষ অংশটুকু ছেড়ে দিয়ে। খুব প্রিয় একটু মানুষ আছে আমার,যাকে সম্বোধন করি “ভাই” বলে। তাকেও কখনও বলা হয়ে ওঠেনি তোর “নেই” হয়ে যাওয়ার গল্প।
তোকে নিয়ে কখনও একটা গল্প লিখতে পারিনি,বারবার চেষ্টা করেও একটা বই উৎসর্গ করতে পারিনি তোকে। কেন জানি মনে হয় এসব করা মানে স্বীকার করে নেয়া তোর মৃত্যুটাকে। তোর জন্যে কাঁদা মানে অশ্রু বিন্দুর সাথে সাথে বইয়ে দেয়া বুকের মাঝে জমাট বাঁধা শোককে-তাই কাঁদিও নি আমি কখনও।
আজও কাঁদছি না আমি ভাই।
বিশ্বাস কর,আমি কাঁদছি না। পান্ডার বাচ্চা কি কাঁদতে পারে বল??