কারবালার মাঠে একে-একে যখন সবাই শাহাদাত বরন করছেন এবং হজরত ইমাম হোসাইন(রঃ) যখন কেবল একা দাড়িয়ে ছিলেন, তখন তার শেষ কয়টি কথার কিছু অংশের অনুবাদ ঃ "কেন আমাকে হত্যা করতে চাও? আমি কি কোন পাপ অথবা অপরাধ করেছি?" এজিদের সৈন্য বাহিনী বোবার মত দাড়িয়ে রইল। পুনরায় ইমাম হোসাইন(রঃ) বললেন, "আমাকে হত্যা করলে আল্লাহ্র কাছে কি জবাব দেবে? কি জবাব দেবে বিচার দিবসে মহানবীর কাছে?" এজিদের সৈন্য বাহিনী পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে। আবার ইমাম হোসাইন(রঃ) বললেন, 'হাল্ মিন্ নাস্রিন ইয়ানসুরুনা?" 'আমাদের সাহায্য করার মত কি তোমাদের মাঝে একজনও নাই?' তারপরের আহ্বানটি সাংঘাতিক মারাত্বক। ঐতিহাসিকদের মতে এটাই ইমাম হোসাইন(রঃ) শেষ আহ্ববান। "আলাম্ তাস্মাও? আলাইসা ফিকুম্ মুসলিমু?" 'আমার কথা কি শুনতে পাও না? তোমাদের মাঝে কি মাত্র একটি মুসলমানও নাই?'
ইমাম হোসাইন(রঃ)-এর শেষ ভাষনটি মাত্র একটি ছোট্র বাক্য। তবে এর ব্যাখ্যা যদি কাঁচ ভাঙ্গার মত টুকরো-টুকরো করে দেখাতে চাই তাহলে সেই বাক্যটি হবে খুবই বেদনা দায়ক। তাই বেশি কিছু না বলে শেষ বাক্যটির সামান্য ব্যাখ্যা দিয়ে শেষ করতে চাই। খাজা বাবা যেমন বলেছেন, 'ইমাম হোসাইন আসল এবং নকলের ভাগটা পরিস্কার করে দেখিয়ে গেলেন' সে রকমই অর্থ বহন করছে ইমাম হোসাইন(রঃ) শেষ ভাষনটিতে। কারন, এজিদের সৈন্য বাহিনীতে একজন হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রিস্টান অথবা অন্য কোন ধর্মের কেউ ছিল না। সবাই ছিল মুসলমান। অথচ কি সাংঘাতিক এবং ভয়ংকর ভাষন-''তোমাদের মাঝে কি একটি মুসলমানও নাই?'' এজিদের সৈন্যবাহিনীর সবাই মুসলমান এটা আমি অধমের কথা নয় বরং যে কোন বিজ্ঞ আলেমকে প্রশ্ন করে দেখুন। অথচ ইমাম হোসাইন(রঃ) একি তাক লাগানো কথা বলছেন? "তোমাদের মাঝে কি একটি মাত্রও মুসলমান নাই?" না, একটিও সত্যিকার আসল মুসলমান ছিল না বলেই ইমাম হোসাইন(রঃ) এই আহ্বান জানিয়ে পৃথিবীকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। তিনি বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন যে, যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা সবাই নকল মুসলমান। বাজারের চালু আসল মালকে নকল করে যেমন জনতাকে ধোঁকা দেয়, সে রকম এরা নকল মুসলমান হয়ে জনতাকে ধোঁকা দিয়ে যায় এবং এই ধোকার ফাদে অনেক বিজ্ঞজনও মনের অজান্তে পা-খানা বাড়িয়ে দেন। বাজারে গিয়ে অনেক বিজ্ঞজনও নকল মাল কেনার ফাঁদে পড়ে যান, সে রকম অবস্থার শিকারও বলতে পারেন। আসল আর নকল চেনবার বিদ্যা রপ্ত করতে হয়, যদিও বিদ্যার প্রশ্নে তা সামান্য। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সবচাইতে বড় অধ্যাপককে জায়গাজমি কেনার দলিল লিখতে বললে অক্ষমতা প্রকাশ করবেন, অথচ সেই দলিল লিখছে অল্প শিক্ষিত দলিল-লিখক। তাই আসল আর নকল কে চিনতে হলে একটি বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন হয় অনেক ক্ষেত্রে। তবে সবার জন্য অবশ্যই নয়।
এখন মূল বিষয়টির দিকে ফিরে আসছি। সেই বিষয়টি হলো, হজরত ওয়ায়েস করনি কিন্তু মহানবীকে কোন প্রকার সাহায্য সহযোগিতা করা তো দূরে থাক, জীবনে একবার জাহিরি চোখে দেখার ভাগ্যও হয়নি। তাই তাকে সাহাবার খেতাব থেকে বাদ দেওয়া হয়, অথচ কোন কারন নেই, কোন যুক্তি নেই, কোন প্রশ্ন আর সংশয়ের বালাই নেই, কেবল মাত্র মহানবীর প্রতি ভালবাসার দরুন তিনি একে একে সব কটি দাঁত পাথরের আঘাতে ভেঙ্গে ফেললেন। কেন ভাঙলেন এই প্রশ্নের উত্তর খোজা বৃথা। কারন যুক্তির ব্যাখ্যা দেওয়া যায়, কিন্তু ভালোবাসা আর বিশ্বাসের ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। এবং এর ব্যাখ্যা নেই। হজরত ওয়ায়েস করনির মনপ্রান জুড়ে মহানবীর প্রতি কতটুকু ভালোবাসা থাকলে দাঁত ভেঙ্গে রক্ত ঝরাতে পারেন। হয়তো যুক্তি তর্কের মানদন্ডে এই ভালোবাসার মুল্যায়ন কতটুকু বলতে পারবো না তবে, এটুকু অন্তত বলতে চাই যে, ভালোবাসাকে ভালোবাসা দিয়েই মাপতে হয়। অনেকে হয়ত বলতে চাইবেন যে, এ রকম দাঁত ভেঙ্গে ফেলার ভালোবাসার কি মুল্য থাকতে পারে ? এর উত্তর দিতে চাই না এজন্যই যে, এ রকম কিছু প্রশ্ন তোলার মানুষ না থাকলে ভালোবাসার রূপটি একঘেয়েমিতে পরিনত হয়। বিচিত্রতার ঝাকুনি থাকে না। তাই মহানবী তাঁর নিজের জুব্বা মোবারক দিয়ে এই ভালোবাসার মুল্যয়ন করেছেন। এখন আরেকটি বিরাট প্রশ্ন তুলতে চাই যে, মহানবী যে ইমাম হোসাইনকে কতটুকু ভালোবাসতেন তা অনেকেই জানেন, তবু একটি কথা মনে করিয়ে দিতে চাই যে, মহানবী বলেছেন যে, বেহেস্তের দুইজন সরদার হলেন "হাসান এবং হোসাইন" এবং তিনি অন্য আরেকটি হাদিসে বলেছেন, হোসাইনকে যারা ভালোবাসে, তারা হোসাইনের সঙ্গে থাকবে তথা বেহেস্তে থাকবে। একটি প্রশ্ন আসতে পারে তা হলো, ইমাম হোসেনের কারবালার মাঠে সবচেয়ে বেদনাদায়ক শাহাদাত বরনের শোকে ইমাম হোসেনের জন্য শোকের মাতম তুলে, বুক চাপড়িয়ে, ছোট ছোট চাকুর ছড়া দিয়ে পিঠে আঘাত করে 'হায় হোসেন' 'হায় হোসেন' করে রক্ত ঝরায়, তাহলে ইমাম হোসাইন এই ভালোবাসার জন্য কি কিছুই দেবেন না? কারন নিরেট ভালোবাসা এবং এই ভালোবাসার ব্যাখ্যা ও যুক্তি উভয়ই সম্পূর্নরূপে বেকার। ইমাম হোসাইনের ভালোবাসায় কেউ মাতম না করলেও বলার কিছু থাকে না। কারন এটা ব্যাক্তিগত ব্যাপার তা ছাড়া ভালোবাসা তৈরি করা যায় না। আর যারা ইমাম হোসাইনের ভালোবাসায় মাতম করে, রক্ত ঝরায় তাদেরকেও বলার কিছুই থাকে না। কারন যুক্তি ও ব্যাখ্যার যেখানে কবর বা শেষ, ভালোবাসা সেখান থেকেই আরম্ভ হয়। এটা হৃদয় দিয়ে বুঝতে হয় মাথা দিয়ে নয়। যুগে যুগে সব সময় এক শ্রেনীর মানুষ বুঝে মাথা দিয়ে, আর একশ্রেনী বুঝে হৃদয় দিয়ে। কাউকেই তুচ্ছ করা যায় না। কারন এই দ্বান্দ্বিক পদ্বতিতেই সব কিছুর রহস্য লুকিয়ে আছে। কেউ বুঝে কেউ বুঝে না। তাই কাউকেই দোষারোপ না করে এটা যার যার তকদিরের লিখন বললেই সুন্দর মানায়।
নফ্স ও রূহের পার্থক্য (পর্ব-১)
নফ্স ও রূহের পার্থক্য (পর্ব-২)
নফ্স ও রূহের পার্থক্য (পর্ব-৩)
নফ্স ও রূহের পার্থক্য (পর্ব-৪)