আমার কিছুই ছিলো না; নিতান্ত স্বপ্নহীন যুবকের মতো হাঁটছিলাম
এই বাংলার চির সবুজ মোহময় পথ ধরে... এক লাজুক কিশোরীর
সমুদ্রে ডুবসাঁতার কেটে হয়ে উঠছিলাম স্বপ্নগ্রস্ত। কিন্তু এইসব স্বপ্নের
অলীক মোহে খুব দীর্ঘকাল হতে পারলাম না স্থির ! যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল
এক ভীষণ যুদ্ধ... নিঃশ্বাস ফেলবার সময়টুকুও ছিলো না আমার।
কাশফুলের মতো মসৃণ কাঁধে লাফিয়ে উঠলো রাইফেল... ভারতে
শিখলাম যুদ্ধের কৌশল; কিন্তু এটাও জানি - যুদ্ধের আসল অস্ত্র হলো
হৃৎপিণ্ড। শুধু প্রয়োজন সেটার সঠিক ব্যবহার... এক প্রবল ঘৃণা।
শুধু ঘৃণাই দুমড়ে-মুচড়ে বিনাশ করে দিতে পারে শকুনের ঝাঁক !
মনে পড়ে, সেই যুদ্ধের অবেলায় রক্তলোভী হায়েনারা ধ'রে নিয়ে
গিয়েছিলো, সদ্য স্কুল পড়ুয়া কিশোরীটিকে... আমি নপুংসকের মতো
কেবল দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, ভীত চোখে, চোখে সুরমা দেয়া, মাথায়
টুপি পরা কয়েকজন বিষম রাক্ষস লোলুপ দৃষ্টিতে দর-কষাকষি করছিলো
সেই কিশোরীর কচি ধানের মতো স্বচ্ছ শরীর বেয়ে আজ রক্তের বন্যা
বইয়ে দেয়া হবে; সঙ্গমলিপ্সু প্রাচীন পাকিস্তানি কুকুরের দল ছিঁড়ে
ছিঁড়ে খাবে কিশোরীর রক্ত-মাংস ! আমি কিছু্ করতে পারি নি; না...
আমি কিছুই বুঝতে পারি নি। তবে বুঝে উঠছিলাম কেবল... সেই
২৫ মার্চের রাতেই স্থির হয়ে গিয়েছিলো; জল-কাদা-বৃষ্টির সবুজ গ্রাম
ছেড়ে পাড়ি দিলাম রণক্ষেত্রে। একটা ময়লা লুঙ্গি, হাফ-হাতা সবুজ সার্ট
আহা ! কতবার যে ছিঁড়ে গিয়েছে; নাকের 'পর দিয়ে চলে গেছে তীরের
মতো ছুটে আসা শত্রুর বুলেট... হিসেব নেই। মনে পড়ে, কামানের
গোলা বৃষ্টির মতো ছুঁড়ে হত্যা করা হয়েছিলো এক নবীন সহযোদ্ধাকে।
আমি ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম, মরি নি, মৃত্যুভয় ফুলের পাঁপড়ির মতো
ছিঁড়ে গিয়েছিলো। খুব কাছাকাছি এসেও কিছু করতে পারিনি, কিছুই করতে পারিনি... সশস্ত্র এক মুক্তির যোদ্ধা হয়েও আমাকে ডুকরে কাঁদতে
হয়েছিলো। সঙ্গীর বিমর্ষ লাশের ওপর সারি সারি লাল পিঁপড়ের দল উদভ্রান্তের মতো হাঁটছে, হেঁটেই যাচ্ছে, কোনো ক্ষোভ নেই, ক্লান্তি নেই, মৃত্যু নেই, স্বপ্ন আছে ! দেশকে স্বাধীন করতে হবে, রক্তলোভী পশুদের হাত থেকে কেড়ে নিতে হবে সবুজ-লাল পতাকা, এই স্বপ্ন বুকে বেঁধে আবারো অস্ত্র তুলে নেই, পরের দিন, সাথে তিনজন সহযোদ্ধা, আছে প্রাইমারি স্কুল পড়ুয়া এক কিশোর, যে গোপন খড়ের গাদায় লুকিয়ে দেখেছে- বোনের শ্লীলতাহানি, মায়ের আর্তচিৎকার, ধর্ষণ... ধর্ষণ কেবল... ঘৃণা আসে, মুখ ভর্তি ঘৃণা... দেশমাতার বুকের ওপর দাঁড়িয়ে পিশাচগুলোকে কেবলই ধর্ষণ করতে দেখি, আরো এক লুক্কায়িত ক্রোধ ঝিলিক দিয়ে ওঠে আমার গোপন অভ্যন্তরে, বুকের খুব ভেতরে...
(চলবে)
ছবিটা ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।