বুকে বিপ্লবের মন্ত্র, পকেটে চট্টগ্রাম বন্দরের চাকরির নিয়োগপত্র আর ঘরে তরুণী স্ত্রী-দেড় বছরের সন্তান এবং স্ত্রীর গর্ভে অনাগত সন্তান কোনটি বেঁছে নিবেন তিনি। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় জনগণের অংশিদারিত্বের জন্য জাসদ রাজনীতি আর তাদের গোপন সংগঠন গণবাহিনীর আহবানেই সাড়া দিলেন মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার নজীর আহম্মদ। জাসদ রাজনীতির কারণে নোয়াখালী থেকে শুরু করে ঢাকা পর্যন্ত অনেকের ভাগ্যের রাতারাতি পরিবর্তন এমনকি আওয়ামীলীগের সাথে চরম বৈরীতা দিয়ে যাত্রা শুরু করা জাসদের প্রথম সারির নেতৃত্বও আওয়ামীলীগের আঁচলের নিচে ঠাঁই নিলেন (!) ক্ষমতা আর হালুয়া রুটির ভাগাভাগির জন্য। কিন্তু অনেকের মতো কেন্দ্রীয় নেতাদের শেখানো বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথিত আদর্শকে বুকে আলগে রাখতে গিয়ে ১৯৭৫’র ১০ জুলাই রক্ষীবাহিনীর গুলিতে নিহত হন নোয়াখালীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রিয়মুখ মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার নজীর আহম্মদ।
নোয়াখালীর মুক্তিযোদ্ধা তে বটেই তখনকার সময়ে নোয়াখালীসহ সারাদেশে যারা জাসদ রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন এমন লোক খুবই কম পাওয়া যাবে যারা ইঞ্জিনিয়ার নজীরের নাম অন্তত একবারও শুনেননি। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার সেই অনাগত সন্তান আজ যুবক, তরুনী স্ত্রীও আজ বৃদ্ধ প্রায়। যেই আদর্শে কিংবা বিপ্লবের জন্য ইঞ্জিনিয়ার নজীর মুক্তিযুদ্ধের পর লোভনীয় সরকারি চাকরী যোগ না দিয়ে ঘর ছেড়েছেন সেই বিপ্লব কিংবা বিপ্লবে উদ্বুদ্ধকারী নেতাদের আজকের চরিত্র দেখে হিসাব মেলাতে পারেনা এই মুক্তিযোদ্ধার স্ত্র-সন্তানেরা। টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে কাটানো ৩৬ বছরের পুরানো স্মৃতি এখন তাদের কাছে এমন নিত্য নুতন প্রশ্নের উদ্রেক করে...
এক.
১৯৭৫’র ১০ জুলাইয়ের পর ৩৪ বছর কেটেছে কোন দিন স্বামীর মৃত্য কিংবা হত্যাকান্ড নিয়ে কোন প্রশ্ন শোনা যায়নি মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার নজীরের স্ত্রীর কন্ঠে। নিজের সুখ পায়ে ঠেলে বুকে পাথর চাপা দিয়ে সন্তানদের আগলে রেখেছেন তিনি। ২০০৯’র ১৯ নভেম্বর মহামান্য সুপ্রীম কোর্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে ঘটনায় হাইকোর্টের রায় বহাল রাখার ঐতিহাসিক রায় ঘোষণার পর সেই পাথর কিছুটা যেনো নড়ে চড়ে উঠে।
ঝাপসা হয়ে আসা একটি চিঠি হাতে নিয়ে অঝোরে কেঁদে চলেছেন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা নজীরের স্ত্রী। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে এই চিঠিটি লিখেছিলেন নজীর আহম্মদ। স্ত্রীকে লিখা সেই চিঠির একটি অংশ হচ্ছে ‘‘ হয়তো উপলব্ধি করতে পারছো ; অন্যায়ের বিরুদ্ধে শুধু দু’টা কথা বলাতে আজ আমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা। চৌকিদার, দফাদার, কয়েকজন আওয়ামীলীগার আমাকে ধরে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগছে। পুলিশ সব সময় পিছু ধাওয়া করছে। অনেক চেষ্টা করেও মার সাথে একটু দেখা করতে পারিনা। মা- তোমাদের জন্য কান্নাকাটি করেন। বহুদিন থেকে বাজারে এবং রাস্তাঘাটে উঠতে পারি না। তুমি- জিনিসের জন্য বলেছ, সময় পেলেই পাঠিয়ে দেব”। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার নজীর আর ফিরেননি।
৭৫’র অনাগত সন্তানটি আজ সাংবাদিক। তাই ৩৫ বছর পর সেদিন কান্নারত অবস্থায়ই ছোট ছেলেকে উদ্দেশ্য করে ইঞ্জিনিয়ার নজীরের স্ত্রীর প্রশ্ন ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদেরতো এতদিন পর বিচার হলো, তাহলে তোর বাবার হত্যাকান্ডের বিচার হবে না ? ”। ছেলে কিছু না বুঝে ওঠার আগেই মাকে সান্তানা দিতে এক কথায় উত্তর দেয় ‘বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের জন্য তাঁর সন্তান শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হতে হয়ছে, তোমার ছেলে প্রধামন্ত্রী হবে না, আর তোমার স্বামীর হত্যার বিচারও হবে না” মা এই উত্তরে আপাতত সান্তনা পেলেও তাঁর মনে থেকে যায় গভীর ক্ষত।
কারণ চট্টগ্রাম বন্দরসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ইঞ্জিনিয়ার নজীরের চাকরীর সুযোগ অবারিত থাকলেও আবেগপূর্ণ রাজনীতি তাঁকে নিয়ে গেছে মৃত্যু দুয়ারে। সদ্য স্বাধীন দেশে কথিত বিপ্লব করতে গিয়ে যদি মেধাবী মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার নজীরের মৃত্যু না হতো তাহলে হয়তো এলাজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী কিংবা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর মতো মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে হয়তো দুই বছর বেশী চাকরীর সুযোগ পেতেন। অনিশ্চিত জীবনে পা বাড়াতে হতো না তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের। আর চরম অবহেলার শিকার হতে হতো না জাসদ নেতৃত্বের।
দুই.
মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার নজীরের সেই অনাগত সন্তান আমি। ২০০৩ সালের ৩০ এপ্রিল নোয়াখালী থেকে আমার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক চলমান নোয়াখালী প্রকাশিত হবার পর। উদ্বোধনী সংখ্যার একটি কপি হাতে পেয়ে প্রতিক্রীয়া জানাতে ক’দিন পর আমাকে চিঠি লিখেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রক্টর, সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. গাজী সালেহ উদ্দিন। সেই চিঠির একটি অংশে তিনি লিখেন ‘‘বেশ কয়েকদিন পূর্বে চট্রগ্রাম থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে বাংলাদেশের কিংবদন্তী রাজনৈতিক নেতা সিরাজুল আলম খানের সাথে পরিচয় হয়েছিলো। ব্যক্তিগতভাবে পূর্ব পরিচয় ছিলনা। চট্রগ্রাম রেলওয়ে ষ্টেশনে তাঁর অনুসারীদের মাধ্যমে পরিচয় ঘটলো। স্বাভাবিকভাবে যাত্রাপথে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি, জাসদের গণবাহিনী ইত্যাদি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করছিলাম। গণবাহিনী গঠন তাদের কার্যক্রম বিশেষ করে তোমার বাবা নজীর ভাই এর মৃত্যু, তোমার পরিবারের অবস্থা ইত্যাদি নিয়ে। এব্যাপারে আমার ভূমিকা ছিল কিছুটা আক্রমনাত্মক, কারণ নজীর ভাই শুধুমাত্র আমার আত্মীয় নন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো তাঁর সান্যিধ্যে আসার। তাঁর চিন্তা চেতনা ভাবনা সমগ্র দেশে খেটে খাওয়া আপামর জনগণের উন্নয়ন কল্যাণকে নিয়ে আবর্তিত হতো। তার মত সাহসী মুক্তিযোদ্ধা খুবই কম দেখেছি। আমার বক্তব্য ছিল একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রে মেধাবী ছাত্র যুবককে একত্রিত করে স্বল্প ট্রেনিং প্রাপ্ত গণবাহিনী গঠন নিয়ে নিয়মিত সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে সন্মুখ যুদ্ধ করাটা কতটা যৌক্তিক। সিরাজুল আলম খানের বক্তব্য ছিল- সকল বিপ্লব সফল হয়না তবে বিপ্লব করতে গেলে কিছুটা রক্ত ঝরবেই ”
রক্ত সিরাজুল আলম খানের ঝরেনি, ঝরেনি আ স ম রব কিংবা হাসানুল হক ইনুদের। অগণিত জাসদ নেতাকর্মীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে বিপ্লব নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা কতটুকু যৌক্তিক ? মনে হয় সময় এসেছে বিপ্লব তত্ত্বের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনারও। যেভাবে চলতি বছরের শুরুর দিকে আমাদের গণমাধ্যম এবং বিচারালয়ের মাধ্যমে কর্ণেল তাহের হত্যা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্কের অবসান হয়েছে।
কারণ আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দমন পীড়ন করেন কিংবা জনগণের অধিকার নিয়ে কথা বলেন তখন ক্ষতিগ্রস্থ সাধারণ নেতাকর্মীদের কথা মনে রাখেন না। যারা স্বজন হারায় তারাই বুঝে এর মূল্য কতটুকু।
শেষ.
লেখার এক পর্যায়ে উল্লেখ করেছিলাম ৭৫’র এ যারা জাসদ রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন নোয়াখালী থেকে শুরু করে সারাদেশে তাদের প্রায় নেতাকর্মীই ইঞ্জিনিয়ার নজীরের নাম জানতেন। কেউ ব্যক্তিগতভাবে ছিনতেন। কিন্তু কথা রাখেননি জাসদ নেতৃবৃন্দ।
কোনমতে শিক্ষাজীবনের পাঠ চুকিয়ে যখন আমি আর আমার ভাই ছুটে গিয়েছিলাম জাসদ অফিসে তখন দুঃখ করতে দেখেছি কেউ এগিয়ে আসেননি সহযোগীতা নিয়ে। একটি চাকরীর জন্য ঐক্যমত সরকারের মন্ত্রী আ স ম আব্দুর রবের কাছে দেখা করতে গেলে তিনি কথা বলা সময়ও পাননি। তখন জাসদ ঐক্যবদ্ধ।
তখন বার বার মনে হয়েছে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামে নিহত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পরিবারের অবস্থাও নিশ্চয় একই রকম।
২০১০ সালের ১০ জুলাই সকালে আমার মুঠোফোনে হঠাৎ করে একটি ফোন আসে। অপরিচিত নাম্বার। অপর প্রান্ত থেকে নারী কন্ঠে বলছেন ‘রুদ্র আমি ঢাকা থেকে শিরিন আক্তার... কোন জাবাব পেয়ে তিনি বলেই চলেছেন আমি শিরিন ফুপু... তোমার শিরিন ফুফু...। কয়েকবার বলার পর বিশ্বাস হচ্ছিলো এখনো আমাদের কেউ খবর রাখে ! । যখন বলছিলাম আসলেই কেউ আমাদের খবর রাখেনিতো এতো বছর তাই বিশ্বাস হচ্ছিলোনা। অপর প্রান্ত থেকে জাসদ নেত্রী শিরিন আক্তার দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আমাদের কি করার আছে। আমরা তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি.....
জন্মের আগেই বাবাকে হারিয়েছি। বেড়ে ওঠার প্রতিটি পদে পদে মানুষের কাছে শুনেছি মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী নানা কীর্তির কথা। যে রাজনীতি বাবাকে দেখার সুযোগ থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছে সেই রাজনীতি কখনো টানতে পারেনি আমাদের দুই ভাইকে। তবে; আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আচরণ এবং নেতাকর্মীদের প্রতি দায়বোধ কষ্ট দেয় প্রতিটি মুহুর্তে। ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ডে স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড নিয়ে শেখ হাসিনা কিংবা ১/১১’র পরবর্তী সময়ে রিমান্ডে নির্যাতনে অসুস্থ তারেক রহমানকে পিজি হাসাতালে দেখতে গিয়ে খালেদা জিয়া যে অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন তা দেখে কিছুটা বিস্ময় জাগে মনের ভেতর। কারণ নিজেদের স্বজন নিয়ে তাঁদের যেই কান্না, ১৫ কোটি মানুষের জন্য তাদের এমন কাঁদতে দেখা যায় না।
কষ্ট লাগে যে পাকিস্তানীরা মুক্তিযোদ্ধা নজীরকে ঘায়েল করতে পারেনি অস্ত্র দিয়ে সেই নজীর আহম্মদ মারা গেলে স্বাধীন দেশের মাটিতে। হয়তো ৭৫’র ১০ জুলাই রক্ষীবাহিনীর যে সদস্য তাঁকে গুলি করেছে তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কষ্ট লাগে যেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ঝান্ডা উড়াতে গিয়ে আমার বাবার নির্মম মৃত্যু হলো সেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের বেহাল দশা দেখেও। আশাকরি আমাদের নেতৃবৃন্দ জনগণের সামনে তত্ত্ব তুলে ধরার ক্ষেত্রে তা শুধু এক্সপেরিমেন্টের জন্য নয় কল্যাণের দিকটি বিবেচনায় রাখবেন আগামি সময়ে।
বাবার মৃত্যু দিনে তাই বাবাকে না দেখা এই সন্তানের শ্রদ্ধাঞ্জলী।
লেখক-
রুদ্র মাসুদ
সম্পাদক, সাপ্তাহিক চলমান নোয়াখালী।
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১১ বিকাল ৩:০৮