ছবির এই মহিলাটিকে খুন করতে হবে।
ছবির মানুষটি শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রি।।
ওরা চাইছে আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রিকে খুন করি!!!
কেন ওরা প্রধানমন্ত্রিকে খুন করতে চায়? কারনটা আমার কাছে এখনও পরিষ্কার না। স্টিভেনসনের কথাগুলো আমার মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। একটি বাক্যের আগে আরেকটি বাক্য চলে আসছে। আমি বার বার বাক্যগুলোকে পর পর সাজিয়ে একটা বোধগম্য অর্থ দ্বার করানোর চেষ্টা করছি। লাভ হচ্ছে না। স্মৃতি বারবার প্রতারনা করে চলেছে।
“Believe it or not, it is for the best interest of your country... and of us all..”
এই একটি কথা স্টিভেনসন একাধিক বার বলেছেন। প্রতিবার বলার সময় গলার স্বরের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে আগেরবারের চেয়েও অধিক গুরুত্ব আরোপের চেষ্টা করেছেন। আর কি কি বলেছিলেন তিনি? ওয়্যার ক্রিমিন্যাল প্রসিকিউশন নিয়ে কি যেন বলেছিলেন? আমি মনে করতে পারছি না। আমার স্মৃতি অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর কারন কি? এটা কি আমার রক্ত কণিকায় ক্রমবর্ধমান পচনের প্রভাব? নাকি এর জন্যে দায়ি আমার চোখের সামনে এই মুহুর্তে আবর্তিত দৃশ্যাবলী? আমি জানি না। দ্বিতিয়টি হবার সম্ভাবনাই বেশি। এই মুহুর্তে আমি চোখের সামনে যা দেখছি তাতে যে কোন মানুষের বিবেক বুদ্ধি লোপ পাওয়া স্বাভাবিক।
আমি দাঁড়িয়ে আছি মতিঝিল সেনাকল্যান ভবনের ছাদের কিনারায়। আমার মাথার উপরে সুবিস্তৃত নক্ষত্রখচিত রাতের আকাশ। আমার দৃষ্টি বহু নিচের সুবিস্তৃত উত্তপ্ত নরকের দিকে। এখানটা থেকে বহু দূর পর্যন্ত দেখা যায়। ওই তো মালিবাগের মোড়ে একটা দোতলা বাসে আগুন জ্বলছে। বাসটিকে ঘিরে উন্মত্ত অস্ফালন করছে কিছু কুকুর। কাছেই আরামবাগে একদল টুপি পড়া কুকুর বিস্ময়কর নির্মম উল্লাসের সাথে প্রায় একশ গাড়ি পিটিয়ে ভেঙে ফেলছে। চারপাশে ভীত মানুষ ছুটে পালাচ্ছে। একটু দূরে শাহবাগের মোড়ের কাছে গর্জনরত একপাল কুকুর হাতে লোহার রড ও ধারালো অস্ত্র হাতে মার্চ করে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের বাঁধা দিতে সামনেই দেয়ালের মত দাঁড়িয়ে আছে ইউনিফর্ম আর হেলমেট পরিহিত প্রশিক্ষিত কুকুরের একটি বাহিনি। টিয়ার গ্যস আর ব্যটন হাতে বাহিনিটি তাদের ইউনিফর্মের নিচে ঘেমে নেয়ে যাচ্ছে। তাদের তল পেটে একটু একটু করে চাপ বাড়ছে। কুকুরের দল তাদের ঘামের গন্ধ পেয়ে গেছে। তাদের আক্রোশ বেড়ে আচ্ছে। তারা এগিয়ে আসছে হুঙ্কার ছেরে। তাদের হুঙ্কারে শহর কেঁপে উঠছে।
ঢাকা শহর আজ রাতে কুকুরে ভরে গেছে।
আজ দেশের একজন ওয়্যার ক্রিমিন্যালের রায় ঘোষণা হয়েছে। এই রায় নিয়ে কি যেন বলেছিলেন স্টিভেনসন? রায় কি হবে সেটা তিনি আগে থেকেই জানতেন। স্টিভেনসন সরাসরি না বললে আন্দাজ করা যায় সে CIA এর লোক। টেক্সাসের বায়োইঞ্জিনিয়ারিং ল্যব ক্রুজ রেইস গোপনে ইউ এস সরকারের জন্যে বায়োলজিক্যাল উইপনের উপর রিসার্চ করে থাকে। এমন একটি প্রতিষ্ঠানের অন্দরমহলে CIA এর কিছু ফেউ থাকাই স্বাভাবিক। CIA জানত ওয়্যার ক্রিমিনালদের ভাগ্যে কি আছে। রায় ঠিক করা হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। তারা এতোদিন শুধু প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এখন আঘাত করার সময় হয়েছে। আর আঘাত করার জন্যে তারা অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে আমাকে। কেন প্রধানমন্ত্রিকে টার্গেট করা হল? স্টিভেনসন ব্যখ্যা করেছিলেন কিন্তু আমার আর এখন মনে পড়ছে না। আমার বমি পাচ্ছে। পাকস্থলী উল্টে আসছে। আমার চোখে রক্ত জমছে। একটা জীবন্মৃতের মত আমি হেঁটে চলেছি। কখন আমি সুউচ্চ সেনা কল্যানের ছাদ থেকে পথে নেমে এসেছে আমি জানি না। তবে আমি জানি আমি কোথায় যাচ্ছি। আজও রাতে আমাকে কি করতে হবে আমি জেনে গেছি। তবে কাজে নামার আগে একজনের সাথে দেখা করা খুব দরকার।
ক্লাবের তিন তলার কোনার ঘরটি সিনথিয়ার। পর্দা ঢাকা জানালার ওপাশে আলো জ্বলছে। সিনথিয়ার ঘরে খদ্দের আছে। কে হতে পারে? কোন উঠতি ব্যবসায়ি? অর্থের জোরে যে বঙ্গোপসাগরটাও কিনে নিতে পারে? কোন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ? যার ছায়ার উত্তাপেও পদ্মার পানি শুকিয়ে যায়? নাকি কোন হোপলেস ব্যর্থ কবি? গাঁজার পুরিয়ায় কবিতা খুঁজে না পেয়ে যে এখন এসেছে পতিতার ঊরুর ভাজে ভেঙে যাওয়া পুরুষাঙ্গের ঝাল মেটাতে?
আমি পরোয়া করি না। সিনথিয়ার সাথে আমার দেখা করা দরকার। এখনি।।
আমি কোন ডেলিকেসির ধার ধারি না। জানালা খোলাই ছিল। আমি পাল্লা ঠেলে আলতো পায়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ি। বৈচিত্রহিন সাদামাটা একটি ঘর। সস্তা আসবাবপত্রে সাজানো। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা বিছানা। তাতে সাদা চাদর বেছানো। বিছানায় আদিম কামে মত্ত দুটি শরীর। আমাকে আগে দেখতে পেল সিনথিয়া। দেখার সাথে সাথে ওর পেলব শরীরটা পাথরের মত স্থির হয়ে গেল। তার শূন্য দৃষ্টি আমার উপর নিবদ্ধ। সিনথিয়া কোন প্রশ্ন করল না। আমিও কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করলাম না। সিন্থিয়ার উপরে শায়িত নগ্ন পুরুষ দেহটি তখনো নিজ কর্মে ব্যস্ত। আমার উপস্থিতি টের পায়নি। আমি তার চুল খামচে ধরে টেনে সিনথিয়ার শরীর থেকে নামিয়ে আনলাম। ভয়ে মানুষটার মুখ সাদা হয়ে গেল। মানুষটি রুমন। ভার্সিটিতে আমার একমাত্র বন্ধু। যার মাধ্যমে সিনথিয়ার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল। রুমন বুয়েটের বামদলের সক্রিয় কর্মি। আজ রাতে তাকে পাওয়া গেল পতিতার ঘরে। সে অবশ্য আমাকে এই রুপে চিনতে পারল না। বহু কস্টে কন্ঠে শক্তি সঞ্চয় করে বলল, “তু...তু... তুমি কে?”
“আমি নিশাচর”
আমার কন্ঠে কি ছিল কে জানে। যা কিনা মনে হল রুমনের ভেতর থেকে শেষ পান শক্তিটুকুও শুষে নিল। হাঁটু ভেঙে সে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। দুই হাতে মুখ ঢেকে শিশুর মত ফুপিয়ে উঠল, “প্লিজ...প্লিজ...ডোন্ট হার্ট মি।” আমার বন্ধু, উদিয়মান বামনেতা ও বুয়েটের সম্ভাবনাময় ছাত্র রুমন হেচকি তুলে প্রান ভিক্ষা চাইছে। আমার আর তাকিয়ে থাকতে রুচি হল না। আমি সিনথিয়ার কাছে গেলাম।
“জামা কাপড় কিছু একটা পড়”
“কেন? এভাবে দেখতে কষ্ট হচ্ছে?” সিনথিয়ার কন্ঠ ডিস্টার্বিংলি ইমোশনলেস।
“আমি হয়তো আর তোমার কাছে আসব না?”
“তাই নাকি? আরো ভালো কাউকে পেয়ে গেছ?”
“...... না। আজ রাতটাই হয়তো...” আমি থেমে গেলাম। এভাবে বিদায় নেয়া আমার শোভা পায় না।
“কি? আজও রাতটা কি??” সিনথিয়ার কন্ঠে হালকা উত্তাপ টের পাচ্ছি। আমার বুকে সস্তি নেমে এল। ওর নিরুত্তাপ স্বর জেন ঠান্ডা ছুরির মত বুকে বিঁধছিল। “তুমি কি ভাব? যে তুমি এদের কারো থেকে আলাদা? আর কিছু না হোক এই মানুসগুলো জানে যে তারা কি চায়। আর তুমি... তুমি একটা কাপুরুষ নাফিজ। একটা অক্ষম কাপুরুষ।” সিনথিয়ার কন্ঠ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠে।
হয়তো সিনথিয়ার কথাই সত্যি। হয়তো আমি তাই। কিন্তু আজ রাতে নয়। আজ রাতের জন্যে আমি আমি মৃত্যুর অবতার।
***
চার তলা কালো দালানটা দাউ দাউ করে জ্বলছে। ঘন কালো ধোঁয়ার মেঘ পাক খেয়ে উঠে যাচ্ছে আকাশে। মাত্র দুই বোতল কেরোসিন আর একটা খোলা গ্যসের পাইপ। সিনথিয়া আমার হাত ধরে আছে। ওর হাতটা একটু একটু কাঁপছে। ওর কি ঠান্ডা লাগছে? ওর চোখের সামনে পুড়ে যাচ্ছে ওর কালো দালান। দূরে সাইরেনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা আসছে। কিন্তু এই আগুন নেভানো যাবে না। এই আগুন আজ সারা রাত ধরে জ্বলবে। সিনথিয়ার যত আক্ষেপ, দুঃস্বপ্ন আর কলঙ্ক সব কিছুকে পুড়িয়ে ছাই না করা পর্যন্ত এই আগুন জ্বলতেই থাকবে।
এখানেই সিনথিয়ার সাথে আমার বিচ্ছেদ হবে। কি বলব ওকে? ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা দুইজন একসাথে কাটিয়েছি। তেমন কোন কথা হয়নি। এই শেষ বেলায়ও আমি বলার মত কিছু পেলাম না। আচ্ছা এটা কি জেনে নেব সিনথিয়া ওর আসল নাম কিনা? নাহ, থাক। কি দরকার। সিনথিয়া নামটা তো খারাপ না।
বিদায়ের সময় সিনথিয়ার চোখে জল ছিল না। কেন আমি এভাবে বিদায় নিচ্ছি, কেন আমাদের আর দেখা হবে ও কিছু জানতে চায়নি। তবে আমার ধারণা কিছু জিজ্ঞেস না করেই ও সব কিছু বুঝে নিয়েছে।
***
রাত নয়টা...
মালিবাগ মোড়।
দো’তালা একটা বিআরটিসি বাসের পোড়া কালো কঙ্কালটা পড়ে আছে। সেটাকে ঘিরে উন্মত্ত কুকুরের ভিড় এখন পাতলা হয়নি। বরং তারা যেন ক্রমেই দলে ভারি হচ্ছে। ঠিক এই সময় ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটে যায়। কোথা থেকে যেন কালো একটা লেলিহান বিদ্যুৎ শিখা ছুটে এসে আছরে পড়ে দলটির মাঝে। সর্পিল বিদ্যুৎ শিখাটি মরে যায় না। তার চোখ ধাঁধানো গতি কুকুরগুলোকে হতচকিত করে দেয়। কালো শিখাটি ঘুরে ঘুরে আঘাত করে তাদের বুকে, পিঠে, মুখে। কুকুরগুলো কেউ ব্যথায় মুখ ঢেকে বসে পড়ে। কেউ প্রচন্ড আতঙ্কে ব্যথা অনুভব করে না। রক্তাত শরীরটাকে ছেঁচড়ে তারা প্রান পনে পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু কালো বিদ্যুৎ শিখাটি নির্মম। তাকে এড়িয়ে কেউ পালাতে পারে না। চোখের নিমেষে সে কুকুরগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়।
স্টিভেনসন বলেছিলেন এই সরকার ওয়্যার ক্রিমিন্যালদের প্রসিকিউশনে ব্যর্থ হবে। বড় কোন সাজা ছাড়াই তারা বিচার প্রক্রিয়ার ফাঁক ফোঁকর গলে বের হয়ে যাবে। আর পরের টার্মে সরকার পরিবর্তিত হলে এরা বেকসুর খালাসও পেয়ে যেতে পারে। দক্ষিন এশিয়া ও মিডল ইস্টের রাজনীতিতে এর প্রভাব সুদুর প্রসারি। এই প্রসিকিউশনে অ্যামেরিকা বিশাল বড় অঙ্কের বাজি ধরে বসে আছে। এতো সহজে সে এই বাজিতে হার মেনে নেবে না।
রাত পৌনে দশটা
আরামবাগ থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত কম করে হলেও পঞ্চাশটা গাড়ির চুর্ন বিচুর্ন দেহ পড়ে আছে। পথের এদিক সেদিক ছোট বড় নানা নানা আকারের আগুন জ্বলছে। টুপি পড়া কুকুরগুলোর যেন ক্লান্তি নেই। হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই দিয়ে তারা ভাঙা গাড়িগুলোকে অবিরাম পিটিয়ে চলেছে। একটি গাড়িতে আটকা পড়েছে এক দম্পতি। সাথে একটি তিন বছরের শিশু। লোহার রড হাতে তাদের গাড়ির বনেট আর উইন্ড শিল্ডে পিটিয়ে চলেছে এক কুকুর। নারীটি ভয়ে কাঁদছে। শিশুটি কাঁদছে না। অবাক চোখে বাহিরের পৃথিবীটা দেখছে। পুরুষটি মরিয়া হয়ে বাঁধা দিতে গেল, পরক্ষনেই রডের আঘাতে সে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। রক্তে ভিজে উঠেছে কালো পথ। কুকুরটি এবার মনোযোগ দিল নারিটির দিকে। তাকে টেনে বের করে এনে ফেলা হল রাস্তায়। এই সুযোগে কুকুরটি তার বুকে পেটে মন ভরে একবার থাবাও বুলিয়ে নিল। শিশুটি তখনো রয়ে গেছে গাড়ির ভেতর। নারিটি হাতজোড় করল শিশুটিকে গাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যাবার একটি সুযোগের জন্যে। কুকুরগুলো তখন দেশ ও ঈমান রক্ষায় ব্যস্ত। নারীটির আকুল ক্রন্দনে তাদের মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হল না। কুকুরটি এখন গাড়িটির গায়ে পেট্রল ঢালছে।
কালো একটা কিছু প্রচন্ড শক্তিতে আঘাত করল কুকুরটির মুখে। সেই কালো বিদ্যুৎ শিখাটি। প্রচন্ড আঘাতে সে মাটি ছেরে দুই ফুট শূন্যে উঠে গেল। রক্ত আর ধুলোয় মোড়া রাস্তায় ড্রপ খেতে খেতে তার শরীরটা গিয়ে পড়ল প্রায় দশ ফুট দূরে। বিদ্যুৎ শিখাটি কিন্তু থেমে নেই। সে অবিরাম ছুটে যাচ্ছে পথের এই কোন থেকে সেই কোনে। কখনো মাটি ছেরে লাফিয়ে উঠছে শূন্যে। সাপের মত ছোবল মেরে চলেছে কুকুরগুলকে। তাদেরকে টুটি চেপে ধরে ছুরে দিচ্ছে আকাশে, পিষে ফেলছে পায়ের তলায়, দলে মুচড়ে মিশিয়ে দিচ্ছে মাটির সাথে। এ যেন এক ভয়ঙ্কর ছন্দময় ব্যালে নৃত্য। কুকুরের দল প্রচন্ড আতঙ্কে দ্বিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটছে। আজ যেন তারা মুখোমুখি হয়েছে সাক্ষাৎ শয়তানের।
স্টিভেনসনের দল নতুন রাস্ট্রনায়ক কে হবেন তা ইতিমধ্যেই ঠিক করে ফেলেছে। এখন অপেক্ষা শুধু পুরানো জনকে সরিয়ে দেবার। কিন্তু এই কাজটি করতে হবে খুব সাবধানে। কিছুতেই বুঝতে দেয়া চলবে না আড়াল থেকে কে গুটি চালছে। বরং যে কোন মুল্যে দেশের মানুষের সিমপ্যথি অর্জন করতে হবে। নিহত প্রধানমন্ত্রীকে আঠা হিসেবে ব্যবহার করে দ্বিধা বিভক্ত জাতিকে এক করতে হবে। তার মৃত্যু আর ওয়্যার ক্রিমিন্যালদের বিচার নিয়ে যেন কারো মনে কোন প্রশ্ন না থাকে।
রাত সাড়ে এগারোটা...
তান্ডব চলছে শাহবাগ মোড়, কাঁটাবন, নিউমার্কেট এলাকায়। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দুইদল কুকুর মুখোমুখি। একদলের থুতনিতে কালো দাড়ি। আর অন্য দলের শরীরে কালো ইউনিফর্ম। পরস্পরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার আগে বোধ হয় এই দুই দল থামবে না। তাদের এই যুদ্ধ হয়তো চলবে কেয়ামত পর্যন্ত। কিন্তু অপার্থিব একটা কিছু তাদের যুদ্ধে বাদ সাধলো। শাহবাগ নিউমার্কেটের আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল। এই নারকিয় রাতে চাঁদটাও বুঝি ভয়ে মেঘের আড়ালে মুখ লুকালো। কিন্তু এই মেঘ জীবন্ত। কান ফাটানো তীক্ষ্ণ কন্ঠে এই মেঘ চিৎকার করছে। চিৎকার করতে করতে নেমে আসছে কুকুরগুলোর উপর। তাদের চিৎকারে কেঁপে উঠছে আশে পাশের বাড়িঘর। এগুলো কাক।। শত শত হাজার হাজার কাক। তারা উঠে এসেছে গলির কোনের নর্দমা থেকে, সুউচ্চ ভবনের পেছনের নোংরা আস্তাকুড় থেকে। ঢাকা শহরের সব শির্ন, অভুক্ত কাক আজ রাতে এক হয়েছে এই আকাশে। ধারালো ঠোঁট আর নখের আঘাতে চিরে ফেলছে উন্মাদ কুকুরগুলোর নাখ মুখ। ইউনিফর্ম পড়াগুলোও বাদ পড়ছে না। কাকের মিছিলে যোগ দিল সেই বিদ্যুৎ শিখাটি।
এক শহর কুকুরের বিরুদ্ধে একটি অনির্বান বিদ্যুৎ শিখা। এ বড় অসম লড়াই। কুকুরগুলোর জন্য।
***
ভোর হতে এখনো অনেক দেরি।
আমার সারা শরীর অবসন্ন। শরীরের কোথাও এক ইঞ্চি চামড়াও বোধ হয় অক্ষত নেই। আমি আর পারছি না। মুখের ভেতর রক্তের নোনা স্বাদ পাচ্ছি। চোখ ঢেকে যাচ্ছে রক্তে। শরীরের কত জায়গা থেকে যে রক্ত ঝরছে হিসেব করা যাবে না। আমি আর পারছি না। কিন্তু ভোর হতে এখনো অনেক দেরি।
বুয়েটের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার যোগ দেবার কথা। সেই অনুষ্ঠানের মাঝেই কোন এক সময়ে হঠাত বাতি নিভে যাবে। আর ঠিক তখনি আমাকে আঘাত করতে হবে। সেই অনুষ্ঠানে গোপনে বোমা পুতে রাখা যেত। অথবা দূর থেকে স্নাইপার বসিয়ে মন্ত্রির খুলি উড়িয়ে দেয়া যেত। কিন্তু ওরা নির্বাচন করেছে আমাকে। কারন তাদেরকে সব রকম সন্দেহ মুক্ত থাকতে হবে। দশ সেকেন্ডের জন্যে নিভে যাবে অডিটোরিয়ামের আলো। আর সেই সময়ের মধ্যে আঘাত করতে হবে আমাকে। এমনি পরিকল্পনা ছিল স্টিভেনসনের। তার ভাষ্যমতে, "This is the only way of doing it without raising a civil war"
বলার অপেক্ষা রাখে না এই পরিকল্পনা এখন ব্যবহার করা টয়লেটপেপারের মতই মূল্যহীন। আজ সারা রাতে আমি সেটা নিশ্চিত করেছি। আমি সেটা নিশ্চিত করেছি মালিবাগে, মতিঝিলে, শাহবাগে, নিউমার্কেটে। তবে আমি ব্যর্থ হলে ক্রুজ রেইস বসে থাকবে না। আমার হয়ে অন্য কেউ তাদের পরিকল্পনা সম্পন্ন করবে। নিশ্চয়ই তাদের কোন ব্যকআপ প্ল্যান আছে। আর তাই আমার কাজ এখনো শেষ হয়নি। আমার কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন অংশটিই এখনো বাকি রয়ে গেছে। কিন্তু আমার শরীর যে আর চলছে না। আর এক পা ফেলার মত শক্তিও যেন অবশিষ্ট নেই। আমার পোষা কাক পল একবার ত্বার স্বরে চিৎকার করে উড়ে যাচ্ছে আকাশে। আবার পাক খেয়ে নেমে আসছে আমার কাঁধে। যেন আমাকে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিচ্ছে। যেন বলছে, “এখনি থেমে যেও না। আরো অনেক দূর যেতে হবে। ভোর হবার আরো অনেক দেরি।” দেহের প্রতিটি কোষের বিদ্রোহ অগ্রাহ্য করে আমি দাঁতে দাঁত চেপে আরো একটা পা সামনে আগাই। তারপর আরো এক পা। মাটি কামড়ে আমি একটু একটু করে এগিয়ে যাই। আমার গন্তব্য পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার।
রাত চারটার দিকে সেন্ট্রাল জেলের বাতি নিভে যায়। একটু পরেই ব্যকআপ জেনারেটর চালু হয়ে যাবার কথা। কিন্তু জেনারেটর চালু হয় না। আমার সামনে অন্ধকার সরু করিডোর। আমি লম্বা দম নেই। নিজেকে বলি, “নাফিজ তুমি অনেক দূর চলে এসেছ। আর একটু বাকি। আর একটু।” আমি টের পাই পেছনে অসংখ্য গার্ড পুলিশ অস্ত্র হাতে ছুটে আসছে। কিন্তু এখন আর কিছুতেই কিছু এসে যায় না।
সেলগুলো খুঁজে বের করতে কষ্ট হয়। অবশেষে নির্দিস্ট সেলটি খুঁজে পাই। লাথিতে দরোজার লোহার কবাট ছিটকে খুলে যায়। আমি সেলের ভেতর প্রবেশ করি। ভেতরে শুভ্র দাড়ি সমেত প্রৌঢ় একব্যক্তি চোখে যুগপৎ আতঙ্ক ও কৌতুহল নিয়ে আমার দিকে তাকায়। আমি বলি, “হ্যালো কলিজু।”
***
ধিরে ধিরে ভোরের আলো ফোটে। সুর্যটা যেন দ্বিধায় আছে। পুব আকাশে উঁকি দেবে কি দেবে না যেন বুঝে উঠতে পারছে না। ভোরের নরম আলোয় এক অপুর্ব পবিত্রতা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। একজন দুইজন করে মানুষ বের হয়ে আসছে তাদের ঘর ছেরে। আজ নতুন একটি ভোর। নতুন একটি দিন।
কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের কাছে মানুষের একটা বড় জটলা তৈরি হয়েছে। ধিরে ধিরে আরো মানুষ তাতে যোগ দিচ্ছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই জায়গাটা অসংখ্য মানুষের ভিরে গমগম করতে থাকে। দু’চোখে অবাক বিস্ময় নিয়ে তারা দেখছে বড় অদ্ভুত এক দৃশ্য।
শহিদ মিনারের পাদদেশে এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে দাড়িওয়ালা অনেকগুলো মানুষ। তাদের শরীরে কাপড় নেই। তাদের হাত পা ও চোখ শক্ত করে বাঁধা। মানুষগুলো সবাই বেঁচে আছে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে ওরা সবাই ওদের বিচারের অপেক্ষা করছে। ওরা যুদ্ধাপরাধি। বিস্মিত মানুষের ভিড়ে দাড়িয়েছিল সিনথিয়াও। সারা রাত সে অপেক্ষা করেছিল ভোরের এই মুহুর্তটির জন্যে। সিনথিয়া শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে যায়। তার পাশাপাশি এগিয়ে যায় আর সবাই।
দেশের জনগন তাদের বিচারকার্য শুরু করে।