মিষ্টি একটা কন্ঠ ওকে ডাকছে। কে ডাকে? শফিককে কেউ একজন ধাক্কা দেয়। শফিক চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করে। ও বুঝতে পারে না ও কোথায় আছে। সেই কন্ঠটা আবার শোনা যায়। “এই তো চোখ খুলুন। খবর্দার ঘুমিয়ে পড়বেন না। চোখ খুলে তাকান। আমার কথায় মনোযোগ দিন। হ্যা এই তো, চোখ খোলা রাখুন। আমার সাথে কথা বলুন। আপনার নাম কি বলুন তো...”
শারমিন ডাকছে। শফিকের ঘোরের মত লাগছে। আবার চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়তে মন চাইছে। কিন্তু শারমিন ওকে কিছুতেই ঘুমাতে দেবে না। ও একটু চোখ বন্ধ করতেই বারবার ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে দিচ্ছে। আশ্চর্য, শারমিন ওকে আপনি আপনি করছে কেন? শফিক কি জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখছে? কেমন ছাড়া ছাড়া স্বপ্ন। স্বপ্নের মাঝে সে টুকরো টুকরো শারমিনের কথা শুনতে পাচ্ছে। “এই যে আমার দিকে তাকাও। কতদিন আমার দিকে ভালো করে একটু তাকাও না বলত? আমি কি দেখতে খুব কুতসিত হয়ে গেছি? আমার দিকে আর তাকানো যায় না?” শফিক অপ্রস্তুত হয়ে পরে। শারমিন হেসে ফেলে। “দেখ দেখ কেমন মুখ কালো করে ফেলছে। আরে আমি তো মজা করছিলাম। এতো অল্পেই এমন মুখ কালো করলে চলবে?” শফিক উত্তর দেয় না। শারমিন বলে, “কিন্তু আমি আসলেই দেখতে অনেক বদলে গেছি তাই না? কতদিন আয়না দেখি না। প্লিজ আজকে আমায় একটু নিজের মুখটা দেখতে দেবে? জানি দেবে না। কি যে অসুখ হল। আমাকে আর কতকাল এভাবে বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে বল তো? আমি কি আর ভাল হব না?” দৃশ্যপট পালটে যায়। হাসপাতাল কেবিন। বেডে শুয়ে আছে শারমিন। দৃষ্টি ছাদের দিকে স্থির। ওর পায়ের কাছে বসে আছে শফিক। তাকিয়ে আছে শারমিনের দিকে। মেয়েটার চোখ দুটো দেখতে লাগছে মড়া মাছের চোখের মত। স্থির, পলকহীন। খুব ধিরে ধিরে ওর চোখের কোনে একবিন্দু অশ্রু জরো হচ্ছে। অশ্রু ফোঁটাটা একটু একটু করে বড় হচ্ছে। শফিক অপেক্ষা করছে অশ্রুটা শারমিনের গাল বেয়ে নেমে আসার। কিন্তু অশ্রুটা ঝরে পড়ছে না, শারমিনের চোখের কোনে ঝুলে আছে বেহায়ার মত। দৃশ্যপট আবার পালটে যায়। আশুলিয়া লেকের পার। শারমিন ওর হাত ধরে হাঁটছে। ওর মুখে একটা চঞ্চল হাসি লেগে আছে। বাতাসে ওর চুল আর ওড়না যেন পাল্লা দিয়ে উড়ছে। চুল সামলাতে সামলাতে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে শারমিন বলল, “ইস কতদিন পর এই জায়গাটায় আসলাম, তাই না? আগে তো প্রতি সপ্তাহেই আসতাম। ... আচ্ছা ওই জায়গাটা কি এখনও আগের মত আছে? ওই যে পাথরটার উপর আমরা সব সময় বসতাম। চল না দেখি... আজ কিন্তু একটা বিশেষ কারনে তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি, বল তো কি? আমার দিকে ভালো করে তাকাও, তারপর অনুমান কর.... কি বলতে পারছ না? যাও না বলতে পারলে নাই, কি আর করা। আচ্ছা যাও তো দেখো আশেপাশে কোথাও আচার পাওয়া যায় কিনা। খুব টক কিছু খেতে ইচ্ছে করছে... আর শোন, তুমি একটা বুদ্ধু...।।”
......
“আপনার তেমন কিছু হয়নি। মাইনর কঙ্কাশন। দুই দিন কমপ্লিট বেডরেস্ট আর ভালমত খাওয়া দাওয়া, ব্যাস এটাই আপনার চিকিৎসা। মাঝে মাঝে একটু মাথা ঘুরতে পারে, বমি বমি লাগতে পারে ভয় পাবেন না। একটা পেইন কিলার লিখে দিচ্ছি। কাল সকালে ব্যথা থাকলে এটা নাস্তার পর খেয়ে নেবেন।” ডক্টর খস খস করে একটা ওষুধের নাম লিখল প্যডে। তারপর কাগজটা ছিঁড়ে শফিকের দিকে বাড়িয়ে দিল। শফিক কাগজটা হাতে নিয়ে ঝিম মেরে গেল। এখন কি করবে বুঝতে পারছে না।
“ডক্টর নাতাশাকে ডেকে দিচ্ছি। উনি আপনার সাথে দেখা করতে চাইছিলেন।”
“ডক্টর নাতাশা...?”
“হ্যাঁ, উনিই আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন।”
“আমি কি উনার গাড়ির সাথেই...”
“হুম, ঠিক ধরেছেন।”
ডক্টর বের হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর পর্দা সরিয়ে লম্বা একটা মেয়ে কেবিনে উঁকি দিল। মেয়েটির পড়নে ডক্টরদের সাদা ল্যবকোট। লম্বা কালো চুল শক্ত করে পনিটেইল করা। মেয়েটি হাসি মুখে বলল, “কি অবস্থা আপনার, এখন কেমন লাগছে?”
প্রচন্ড বিস্ময়ে শফিক একেবারে স্থানুর মত হয়ে গেল। মেয়েটি একটা চেয়ার টেনে শফিকের পাশে বসে বলল, “ব্যথা ট্যথা আছে এখনো?”
শফিক বিড়বিড় করে বলল, “শারমিন...?”
“উহু, আমার নাম নাতাশা হায়দার। এই হাসপাতালের গায়নোকোলজিতে আছি।”
“এটা কিভাবে সম্ভব?” শফিকের ঘোর কাটে না।
“কেন আমাকে দেখে কি ডাক্তার মনে হয় না?” নাতাশা কপট রাগে ভ্রু কুচকাল।
শফিক উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে রইল। নাতাশা বলল, “দেখুন, আমি খুবই সরি যে আপনার গায়ে গাড়ি তুলে দিয়েছি। ভাগ্যিস সময় মত ব্রেক করতে পেরেছিলাম। না হয় কিযে হত! এই আপনার কাছে মাফ চাইছি। মাফ করেছেন তো?”
শফিক কিছু না বলে মাথা নাড়ল। নাতাশা কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আসলে গভীর রাতে হঠাত কল আসল আমার এক পেশেন্টের সিরিয়াস অবস্থা, তক্ষুনি সিজার করতে হবে। আমিও এমন পাগলের মত গাড়ি ছুটালাম যে...”
শফিক দুহাতে নিজের মাথা চেপে ধরল। নাতাশা ব্যস্ত হয়ে বলল, “সেকি, মাথা ব্যথা করছে?”
শফিক বলল, “পানি খাব”
কেবিনে জগে পানি নেই। নাতাশা পানি আনতে বাহিরে গেল। শফিক দুই চোখ শক্ত করে বুজে থকল। এসব কি হচ্ছে তার সাথে? সব কিছু এমন এলোমেলো লাগছে কেন?
“এই নিন আপনার পানি। মাথা কি খুব বেশি ব্যথা করছে? দেখি আমার দিকে তাকান তো?”
শফিক চোখ খুলে দেখল শারমিন ওর দিকে পানি ভর্তি একটা গ্লাস বাড়িয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ, কোন ভুল নেই। সেই চোখ, সেই ঠোঁট। এই চেহারা ভুলে যাবার নয়। শফিক পানির গ্লাস হাতে নিয়ে মুর্তির মত বসে রইল।
“আপনার কি মাইগ্রানের সমস্যা আছে?” নাতাশা জিজ্ঞেস করে।
শফিক মাথা নেরে বলে, “না আমি ঠিক আছি। হঠাত মাথাটা যেন কেমন করে উঠল। এখন আর কোন সমস্যা নেই।”
“যাক, আপনি তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। আপনার সিরিয়াস কিছু হয়ে গেলে নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারতাম না। ডক্টর জামিল অবশ্য বলেছে ভয়ের কিছু নেই। রিপোর্টে আশঙ্কাজনক কিছু পাওয়া যায়নি। মাথায় হালকা চোট লেগেছে। কয়েক দিন বিশ্রাম নিলেই সেরে যাবে।”
শফিক বলে, “হ্যাঁ আমারও তাই মনে হয়। আচ্ছা আমি এখন কোথায় আছি বলুন তো? মানে কোন হাসপাতালে আছি?”
“কেউ বলেনি আপনাকে? আজব তো। আপনি এখন ইউনাইটেড হসপিটালে।”
“ইউনাইটেড হাসপাতাল...” এজন্যেই কি জায়গাটা এমন পরিচিত লাগছে? এই তো সেই ইউনাইটেড হাসপাতাল যেখানে শারমিনকে নিয়ে...
“আচ্ছা আপনি এমন পাগলের মত রাস্তায় দৌড়াচ্ছিলেন কেন বলুন তো? আমি কিন্তু অনেকবার হর্ন দিয়েছি। আপনি শুনতেই পেলেন না!”
“ইয়ে মানে আসলে...” শফিকের চিন্তার সুর কেটে যায়। ভেবে পায় না কি উত্তর দেবে। তার মাথা কাজ করছে না। সামনে শারমিন বসে আছে। অথচ কেমন অপরিচিত মানুষের মত আচরন করছে। নিজের নাম বলছে নাতাশা। কেন? দুটো মানুষের চেহারায় কি এত মিল থাকতে পারে? অসম্ভব!
“আচ্ছা আপনি বাসায় খবর দিয়েছেন?”
“জি বাসায় তো কেউ নেই। আমি একা থাকি।”
“ওহ, তাহলে রিলেটিভ বা ফ্রেন্ড কাউকে তো জানানো দরকার। আপনাকে এসে নিয়ে যাক।”
“অমন কেউ নেই। তাতে অসুবিধে হবে না। আমি নিজে নিজেই যেতে পারব।”
“তা কি হয় নাকি। কঙ্কাশনের পেশেন্ট। একা একা বাড়ি ফিরতে গিয়ে আবার গাড়ির নিচে পড়বেন। আচ্ছা আপনার বাসা কোথায় বলুন তো।”
“মিরপুর ১১ নম্বরে”
“আমি থাকি শ্যমলি, চলুন আপনাকে বাড়ি পৌছে দেই।”
“না না আপনি কষ্ট করবেন কেন? আমি নিজেই একটা ট্যক্সি বা কিছু খুঁজে নেব।”
“আমার সাথে গাড়ি আছে। চলুন, অসুবিধে হবে না। আপনাকে তো আরেকটু হলে মেরেই ফেলেছিলাম। এখন বাড়ি পৌছে কিছুটা পাপ মোচন করি।”
শফিক মানা করতে যেয়েও শেষে কিভেবে থেমে যায়। অবিকল শারমিনের মত দেখতে এই মেয়েটির সাথে আরো কিছু সময় কাটাতে পারলে মন্দ কি?
গাড়ি চলছে। নাতাশা বেশ ভালোই ড্রাইভ করে বুঝা যাচ্ছে। শফিক রিয়ারভিউ মিররে নাতাশাকে দেখছিল। সরাসরি তাকাতে সংকোচ হচ্ছে। মিররে ওর চোখ দুটো খালি দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটো অনেক বেশি চঞ্চল। শারমিনের চাহনি আরো শান্ত ছিল। নাতাশা হঠাত তাকাল রিয়ারভিউ মিররের দিকে। চোখাচোখি হয়ে যেতেই শফিক দৃষ্টি নামিয়ে নিল। নাতাশা হেসে ফেলল, “কি দেখেন?” শফিক কিছুটা ইতস্তত করে বলল, “আপনার নাম কি সত্যি নাতাশা?”
নাতাশা চোখ মটকে বলল, “কেন, আপনার সন্দেহ হচ্ছে?”
“আমার খুব কাছের একজন মানুষের সাথে আপনার চেহারার খুব মিল।”
“তাই নাকি...” নাতাশা রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে শফিককে এক পলক দেখে নিয়ে বলল, “বেশ মজা তো। কোন দিক দিয়ে মিল?”
“পুরো চেহারাই মিল। এমন কি জমজ বোনদের চেহারায়ও এতো মিল থাকে না। আমার আসলে বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি নাতাশা”
নাতাশা খুক খুক করে হেসে ফেলল। “নাহ, আপনার কঙ্কাশন্টা মনে হচ্ছে সত্যি সিরিয়াস। চলেন হাসপাতালে গিয়ে সব আবার নতুন করে টেস্ট করাই”
শফিকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরে। মেয়েটার শুধু যে চেহারা শারমিনের মত তা নয়, কথাবার্তা এমনকি হাসির ভঙ্গিটাও যেন শারমিনের কার্বন কপি।
“আপনার সেই কাছের মানুষটা কে? আপনার স্ত্রি?”
“জি, কিভাবে বুঝলেন?”
“আপনার বলার ভঙ্গী থেকেই অনুমান করেছি। সে এখন কোথায়? তাকে এক্সিডেন্টের খবর দিয়েছেন?”
“জি না।”
“সেকি কেন? উনি দুশ্চিন্তা করবে না?”
“সে বেঁচে নেই।”
“ওহ...” নাতাশা কিছুক্ষনের জন্যে চুপ হপ্যে যায়। যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কিছুক্ষণ পর কথা গুছিয়ে নিয়ে বলে, “আমি খুবই স্যরি...”
“না না ঠিক আছে। এসব অনেক আগের কথা।”
নাতাশা আবার নিরব হয়ে যায়। গাড়ি চলছে। কেউ কোন কথা বলছে না। শফিকের মনে হতে থাকে কি দরকার ছিল নিজে থেকে শারমিনের মৃত্যুর কথাটা বলার। নাতাশাই এক সময় নিরবতা ভেঙে বলে, “আপনার ওয়াইফের নাম কে ছিল?”
“শারমিন সুলাতানা। শারমিন নামেই ডাকত সবাই।”
“কিভাবে... মানে তার মৃত্যুটা...”
“অসুস্থ ছিল অনেক দিন। অসুখটা যে কি ডাক্তাররা অনেক গবেষণা করেও বের করতে পারেনি। ... বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে অসুখটা বাঁধাল। আমাদের প্রথম সন্তান। বাচ্চাটা বাঁচল না। আর শারমিন সেই যে বিছানায় পড়ল আর ভাল হল না। ... ওই অসুখ থেকেই এক সময়...”
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। রাস্তায় একটা দুটা মানুষ দেখা যাচ্ছে। ভোরের পাখিরা তাদের নিড় ছেড়ে ডানা ঝারা দিয়ে বের হয়ে আসছে। আর কিছুক্ষণ পর গাড়ি শফিকের বাড়ির দোড় গোড়ায় পৌছে যায়। শফিক বলে, “আপনাকে এক কাপ চা খেয়ে যেতে অবশ্যই বলতাম কিন্তু...”
“আরে না না ঠিক আছে... শারমিন দ্রুত মাথা নেরে বলে, “আপনি বাসায় গিয়ে রেস্ট নেন, চা আরেক দিন খওয়া যাবে। বাসা তো চেনাই থাকল।”
শফিক দরোজায় দাঁড়িয়ে আবার হাত নাড়ে। শারমিন গাড়ি ঘুড়িয়ে চলে যায়। আরে!! সে আবারো গুলিয়ে ফেলছে। ও শারমিন নয়, নাতাশা। দুজনের চেহারায় অসম্ভব মিল। কথাবার্তায় ও মিল। কিন্তু দুজনের পার্সোনালিটিতে বড় ধরনের পার্থক্য আছে। শারমিনের তুলনায় নাতাশা অনেক বেশি সপ্রতিভ আর আত্মবিশ্বাসি। শফিক ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঘরে ঢোকে। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। অফিসে একটা ফোন দেয়া উচিত। কিন্তু শফিক গায়ে আর এক বিন্দু বল পাচ্ছে না। এমনকি জামা কাপড় ও ছারতে মন চাইছে না। শরীরটা কোনমতে টেনে নিয়ে বিছানায় ফেলতে পারলেই হল।
শোবার ঘরে পা দিয়েই মাথটা আবার চক্কর দিল। ভীষণ বমি পাচ্ছে। শফিক দেরি না করে ছুটে গেল বাথরুমে। বেসিনে মুখ গুজে হড়হড় করে বমি করে ফেলল। রাতে কিছু খায়নি, পেট থেকে একের পর এক ঢেউয়ের মত এসিড মিশ্রিত দুর্গন্ধময় তরল উঠে আসছে। শফিক নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। মনে হচ্ছে আর বুঝি বাঁচবে না। মিনিট পাচেক পর পেটের শেষ বিন্দু জলটুকুও বেসিনে উগলে দিয়ে শফিক হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়ল বাথরুমের ভেজা মেঝেতে। শরীর ঘামে ভিজে গেছে। বুকটা হাপড়ের মত উঠা নামা করছে। মুখের ভেতর বমির বিস্বাদ লেগে আছে।
ওই তো ওই কোনে, অনেকটা এই ভাবেই বসে ছিল শারমিন। আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগে। পা দুটো বেকায়দা ভাবে সামনে মেলে ধরা। ছিট ছিট রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল শারমিনের শাড়ি। শাড়ির পাড় বেয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে পরছিল মেঝেতে। বোবা অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছিল শারমিনের মুখ জুড়ে। ও তখন ছয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বেঢপ ভাবে ফুলে ওঠা পেটটা বিচিত্রভাবে বেকে ভেতরে ঢুকে গেছে। শারমিনের ঠোঁট দুটো একবারই নড়ে উঠল... শফিক...
শফিক উঠে দাঁড়াতে চাইছে। হাত বাড়িয়ে দিতে চাইছে তার স্ত্রীর দিকে। কিন্তু সে পারছে না। শরিরটা এক চুল নড়াবার শক্তিও যেন অবশিষ্ট নেই।
শারমিন উঠে দাঁড়াচ্ছে। তার ফোলা তলপেট বিশ্রীভাবে বেকেচুরে গেছে। শাড়ীর আঁচল লুটিয়ে পড়েছে মেঝেতে। নিতম্ব থেকে গলগল করে রক্তের স্রোত ঠেলে নেমে আসছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। ইস, এতো রক্ত! পা টেনে এগিয়ে আসছে শারমিন, যেন সুতায় বাঁধা একটা প্রানহিন পুতুল। পেছনে ফেলে আসছে রক্তের চওড়া ছাপ। শফিকের কাছাকাছি এসে কাপতে কাপতে বসে পড়ে শারমিন। দু’হাতে শক্ত করে শফিকের বাহু চেপে ধরে। দির্ঘ কালো চুলে ওর সুন্দর মুখটা ঢাকা পড়ে গেছে। শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। সে চোখে আগুন জ্বলছে।
“আমাদের বাবুটা মরেনি শফিক। ওকে যখন আমার পেট কেটে নিয়ে গেল তখন ওর ছোট্ট বুকের ধুকপুকানি আমি অনুভব করেছি। ওর কান্নার আওয়াজ আমি শুনেছি শফিক। আমাদের বাবুটা বেঁচে ছিল। ওরা যাই বলুক আমি কিচ্ছু বিশ্বাস করি না। আমি মড়া বাচ্চার জন্ম দেইনি। ওরা আমার পেট কেটে আমার বাবুটাকে নিয়ে গেছে। ওরা আমার কলজেটা ছিড়ে নিয়ে গেছে শফিক। তুমি আমার বাবুকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেবে। বল, তুমি দেবে না শফিক? তুমি কথা দাও......”
......
দূরে কোথাও কর্কশ শব্দ হচ্ছে। আহ শব্দটা থামে না কেন?
শফিক ধিরে ধিরে চোখ মেলে তাকাল। সে শুয়ে আছে বাথরুমের মেঝেতে। গায়ের কাপড় ভিজে গেছে। শফিকের শীত শীত লাগছে। বাইরে আঁধার নেমেছে। সে কতক্ষন এভাবে বাথরুমে পরে ছিল?
কলিং বেল বাজছে। কেউ একজন অস্থির ভাবে এক নাগাড়ে বেল টিপে যাচ্ছে। একটু পর পর দরোজায় ধাক্কা দিচ্ছে। শফিকের মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। মাথার ভেতর একটা কিছু যেন ছিড়ে গেছে। শফিক টলতে টলতে বাথরুম থেকে বের হয়ে আসে। দরোজা খুলে দেখে রাহাত দাঁড়িয়ে আছে। সে শফিককে দেখেই একেবারে হাহা করে উঠে।
“আরে শফিক ভাই! এই কি অবস্থা আপনার? চেহারা এমন কেন? কি হইসে?”
“ভেতরে আস রাহাত। শরীর ভালো না। একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেসে।”
“এক্সিডেন্ট! বলেন কি!”
রাহাতকে বসতে দিয়ে শফিক সোফায় নিজেকে এলিয়ে দেয়। অল্প কথায় ওকে এক্সিডেন্টের ঘটনা খুলে বলে। কিন্তু কেন যেন পার্কিং লটের ঘটনাটা এড়িয়ে যায়। সব শুনে রাহাত চোখ কপালে তুলে ফেলে। “আপনি একটা মানুষ মিয়া? এমন সিরিয়াস একটা ঘটনা আর আমারে একটা ফোন দিতে পারলেন না? ইস... আপনারে অফিসে না দেখেই মনে কু-ডাক দিল। শফিক ভাই তো অফিস কামাই করে না, তাও আবার কোন নোটিশ ছাড়া। সারা দিন ফোন দিলাম, ফোন কেউ ধরে না। তাই ছুটি হয়ার পরেই আপনার বাসায় আসছি। আর আপনার বাসা খুঁজে বের করতেও জান বের হয়ে গেসে। আশ্চর্য, একটা বছর হয়ে গেল আপনি অফিসে আছেন, অথচ আমরা কেউ আপনার বাসার ঠিকানাটা ঠিকমত জানি না।”
রাহাত এক নাগাড়ে কথা বলে চলেছে। ওর কথাগুলো কানে বাজছে। মনে হচ্ছে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকতে পারলে ভালো হত। রাহাতকে অবশ্য চলে যেতে বলা যাবে না। কোন এক অজানা কারনে এই ছেলেটা তাকে বেশ পছন্দ করে।
“ভাই এখন কি অবস্থা? ডাক্তার ওষুধ পত্র কি দিসে?”
“এখন মাথাটা বেশ ব্যথা করছে। এছাড়া আর কোন অসুবিধা নেই। ওষুধ বলতে একটা পেই কিলারের নাম লিখে দিয়েছে। বলেছে কয়েক দিন বাসায় থেকে রেস্ট নিতে, তাতেই ভালো হয়ে যাব।”
“এহ, গাড়ির তলে পড়া কি যাতা কথা... আর আপনি ওই মহিলারে এত সহজে ছেরে দিলেন? ওইটার নামে মামলা দেয়া উচিত ছিল।”
“অন্য কেউ হলে আমাকে ওই রাতের বেলা রাস্তায় ফেলেই ভাগে যেত। মহিলা আমাকে নিজের দায়িত্বে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।”
“আরে রাখেন, গাড়ি চাপা দিয়া তারপর দরদ দেখাইতে আসছে।”
শফিক একটু উস খুস করে বলল, “আচ্ছা আজকে অফিসে গিয়ে তোমরা অদ্ভুত কিছু দেখেছিলে?”
রাহাত অবাক হয়ে বলল, “অফিসে অদ্ভুত জিনিস তো বলতে তো আমাদের রিসেপশনিস্ট মেয়েটা... ওরে তো রোজই দেখি”
“আহা ফাজলেমি না... শফিক অসহিঞ্চু কন্ঠে বলে... অদ্ভুত কিছু চোখে পরেনি? কাল আমি যখন অফিস থেকে বের হলাম তখন আমাদের ফ্লোরের বাথরুমের বেসিনটা নষ্ট হয়ে গেছিল। ময়লা পানি দিয়ে বাথরুম ভেসে গেছে।
“কই? আজকে তো বাথরুম ঠিকঠাকই দেখলাম। হয় তো সকালে আর সবাই আসার আগেই মিস্ত্রি ডেকে সারিয়ে নিয়েছে। এতে অদ্ভুতের কি আছে?”
আর তোমরা পার্কিং লটে কিছু দেখনি?
“না’তো, কি হয়েছে পার্কিং লটে?”
“নাহ, কিছু না।”
আরো কিছুক্ষণ বকর বকর করে রাহাত চলে গেল। যাবার আগে বারবার করে বলে গেল কোন অসুবিধা হলেই যেন তাকে ফোন করে। আর তিন চার দিন অফিসে যাবার কোন দরকার নেই। সে সব সামলে নেবে। রাহাত বিদায় নিলে শফিক সোফায় বসে ঝিম মেরে গেল। আজকে সকালে অফিসে গিয়ে সবাই বাথরুম স্বাভাবিক পেয়েছে? অবশ্য রাহাত যে ব্যখ্যা দিল সেটাও সত্যি হতে পারে। হয়তো খুব সকালে মিস্ত্রি ডেকে সারিয়ে নিয়েছে। কিন্তু শফিক যে অবস্থায় রেখে গেছে, তাতে সারা রাতে পানি পড়ে তো সব কিছু ভেসে যাবার কথা। এতো অল্প সময়ে সব কিছু সামলে নিল কি করে? তার চেয়ে বড় কথা পার্কিং লতের ঘটনা কেউ কিছু জানে না। তার মানে কি? ওই খুনিটা নিশ্চয় ফিরে গিয়ে সব আলামত মুছে দিয়েছে। লাশটা কি করেছে কে জানে। আচ্ছা পার্কিং লটে তো সব সময় দুইজন সিকিউরিটি আর দারোয়ান থাকে। ওরা ওই সময় কই ছিল? তিনটা মানুষের একজনও ঘটনার সময় উপস্থিত থাকবে না এইটা স্বাভাবিক না। আচ্ছা ওরা নিজেরাও এর সাথে জড়িত না’তো? শফিক খুনিটার চেহারা অন্ধকারে দেখতে পায়নি। খুনিটা নিজেই গার্ডদের কেউ হয়াটা অসম্ভব না। শফিক খুনির চেহারা না দেখলেও খুনি যে শফিককে ভালো করেই দেখেছে সেটা নিশ্চিত। লোকটা এখন কি করবে? সেকি এখন শফিকের পেছনে লাগবে? খুনের একমাত্র সাক্ষিকে সরিয়ে দিতে চাইবে? সন্দেহ নেই লোকটা কাল রাতে সেই চেষ্টাই করছিল। সে যে সুযোগ পেলে আবার চেষ্টা চালাবে না তার গ্যরান্টি কি? শফিকের এখন কি করা উচিত? তার কি পুলিশকে সব খুলে বলা উচিত? কিন্তু ঘটনার কোন প্রমান নেই, সে ছাড়া আর কেউ ওই সময়ে উপস্থিত ছিল না। পুলিশ যে ওর কথা হেসে উড়িয়ে দেবে সে ব্যপারে সন্দেহ নেই। তাহলে এখন?
এসব চিন্তা মুছে গিয়ে ওর সামনে হঠাত শারমিনের মুখটা ভেসে উঠে।
শারমিন নাকি নাতাশা?
শারমিনের মৃত্যুর আগে শেষের কয়েক দিন ওর কিছুটা মাথা খারাপের মত হয়ে গিয়েছিল। ও বার বার বলত ওর বাচ্চা মারা যায়নি। ও ওর বাচ্চার কান্না শুনেছে। ওর বাচ্চাকে ডাক্তাররা চুরি করে নিয়ে গেছে। কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইত না যে ওর বাচ্চা দুনিয়ার আলো দেখার সুযোগই পায়নি। ওর পেট কেটে মড়া বাচ্চা বের করা হয়েছে। বাথরুমে পড়ে গিয়ে বাচ্চাটা মাথায় ভীষণ আঘাত পায়। ভেতরে রক্তক্ষরনের ফলে কিছুক্ষনের মাঝেই বাচ্চাটা মারা যায়। ডক্টরদের কিছুই করার ছিল না। শফিক মড়া বাচ্চার মুখ দেখেনি। ডাক্তাররাই দেখতে নিষেধ করেছিল। একেই আন্ডার ডেভেলপড বেবি, তার উপর মাথা থেতলে গিয়ে ভয়ঙ্কর অবস্থা। কোন বাবার পক্ষে ওই দৃশ্য সহ্য করা সম্ভব নয়।
বাম হাতের কনুইয়ের উপরটা ব্যথা করছে। কি হয়েছে ওখানে। শার্টের হাতা টেনে উপরে তুলতেই শফিকের চক্ষু স্থির হয়ে গেল। বাম বাহুতে কাল হয়ে আছে। ঠিক সেই জায়গাটা যেখানে শারমিন চেপে ধরেছিল। হঠাত শফিকের মনে প্রশ্ন জাগে সত্যি কি তার বাচ্চা মারা গেছে? নাকি শারমিনের কথাই সত্যি?
***
আজ বাবা বাড়ি ফিরবে। কলেজ পড়ুয়া শফিক তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। শফিকের বাবা মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। প্রায়ই তাকে জাহাজে চড়ে দির্ঘ দিনের জন্যে সমুদ্রে ভেসে পড়তে হয়। অনেক দিন পর পর বাবা যখন ফিরে আসে সেই দিনটা যেন শফিকদের বাড়িতে উৎসবের মত। বাবা প্রায় সব সময়ই বাড়ি ফেরেন বেশ রাত করে। সেই রাতটা শফিক ও তার মা দুই জনেই না খেয়ে বসে থাকে। টেবিলে খাবার সাজিয়ে বাবার জন্যে অপেক্ষা করা শফিকদের পরিবারে একটা রেওয়াজের মত।
শফিকের জীবনে সব চেয়ে বড় বন্ধু তার বাবা। সেই ছোট কাল থেকেই তার যত আহ্লাদ, আবদার, বিচার-আচার সব বাবার কাছে। আর শফিকের বাবাও ছেলের জন্যে অন্তপ্রান। একটাই সন্তান তাদের, ভালোবাসতে কোন কার্পন্য করেন না। শৌশব পেড়িয়ে বড় বেলায় পদার্পন করার পর সময়ের ব্যবধানে সেই বন্ধুত্বের সম্পর্কটা ফিকে হয়ে যায়নি। বরং আরো প্রগাড় হয়েছে। শফিক নতুন কোন মিউজিক শুনেছে। সেটা বাবাকে শুনাতেই হবে। নতুন কি মুভি দেখেছে, সেটা নিয়ে বাবার সাথে রাত জেগে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা চলবে। ক্লাসে কোন মেয়েটা বিশেষ ভাবে তাকিয়েছে, কোন মেয়েটা চিঠি দিয়েছে এসব নিয়ে বাপ ছেলেতে খুনসুটি তো লেগে আছেই। শফিকের মা মাঝে মাঝে কপট রাগ দেখিয়ে বলতেন, “ছেলে তো আর আমার না। ছেলের সব কিছু তার বাপের সাথে। আমি পেলে পুষে বড় করলাম শুধুশুধুই।”
সেদিনও বাবা অনেক রাত করে বাড়ি ফিরলেন। কিন্তু আর সব বারের মত এবার হাসি মুখে শফিককে জড়িয়ে ধরলেন না। কোন মজার কৌতুক বললেন না। চিরচেনা হাসিখুশি মানুষটাকে আজ কেমন নির্লিপ্ত দেখাচ্ছে। বাবার কি শরীর খারাপ? শফিক ব্যস্ত হয়ে উঠল। কিন্তু বাবা বেশ রুক্ষ স্বরে জানিয়ে দিলেন তিনি ঠিক আছেন। তাকে নিয়ে ব্যস্ত হবার কোন প্রয়োজন নেই। বাবা খাবার টেবিলে যোগ না দিয়ে সোজা শোবার ঘরে ঢুকে দরোজা লাগিয়ে দিলেন। বাবার কি হয়েছে? শফিকের মা’ও কোন জবাব দিতে পারলেন না। শফিকের মত তিনিও অবাক হয়েছেন। সব তো ঠিকই ছিল, হঠাত করে মানুষটার কি হল? শফিক গিয়ে শোবার ঘরের বন্ধ দরোজায় ধাক্কা দিল। কোন উত্তর পাওয়া গেল না। শফিকের মা’ও স্বামিকে ডাকলেন। তাকে বের হয়ে এসে কি হয়েছে খুলে বলতে বললেন। কোন সাড়া নেই। মা ছেলের দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকল। এক সময় পাশের বাসা থেকে মজনু চাচাকে ডেকে আনা হল। তিনিও কয়েকবার ডাকাডাকি করলেন। কোন ফল হল না দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হল দরোজা ভেঙে ফেলা হবে।
পুরানো দিনের কাঠের দরোজা ভাঙতে বেশ কষ্ট হল। ভেতরে ঢুকে সবাই দেখল শফিকের বাবার প্রানহীন দেহটা ফ্যনের সাথে ফাঁস দিয়ে ঝুলছে।
ঘরে একটা কাগজে ছোট্ট একটা নোট লেখা ছিল, “তুমি কাকে বিশ্বাস করবে?”
এইটুকুই...
শফিক এই মুহুর্তে সেই নোটটা হাতে নিয়ে বসে আছে। তার সামনে একটা ছোট্ট বাক্স খোলা। তাতে বাবার টুকিটাকি বিভিন্ন জিনিস পত্র, সিগারেট কেস, রুমাল, পেন্সিল এই সব হাবিজাবি। বাবার স্মৃতি হিসেবে এতকাল শফিক এই সব জমিয়ে রেখেছে নিজের কাছে। সেই সাথে রেখে দিয়েছে এই টুকরো কাগজটাও। তার বাবার শেষ স্মৃতি চিহ্ন। জগত সংসারের উপর তীব্র অবিশ্বাস থেকে তার বাবা আত্মহত্ত্যা করেছিলেন। কি ছিল সেই অবিশ্বাসের কারন?
বাবার মত করে আজ শফিকের ভেতরেও একটা তীব্র অবিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে। অথবা বলা যায় অতিতের এক সত্য যাকে সে অসম্ভব বলে দূরে সরিয়ে রেখেছিল, সেই সত্যকেই আজ এক নতুন আলোতে দেখছে। শারমিনের মৃত্যু বার্ষিকী যত কাছে ঘনিয়ে আসছে ততই শফিক ঘন ঘন ওকে স্বপ্নে দেখছে। এখন প্রায় প্রতি রাতেই শারমিন ওর স্বপ্নে ভিড় করে। স্বপ্নটা শুরু হয় সহজ ভাবেই। প্রায় সব সময়েই স্বপ্নে তাদের কোন মধুর পুরনো স্মৃতিতে দুজনে আবার ফিরে যায়। স্বপ্নের এ পর্যায়টা অনেকটা যেন স্মৃতির সাগরে ভেলায় ভেসে পড়ার মত। ভার্সিটির ক্লাস ফাকি দিয়ে আশুলিয়া ঘুরতে যাওয়া, একাকি পার্কে চুরি করে চুমু খাওয়া, হুড ফেলে দিয়ে ঝুম বৃষ্টির মাঝে রিক্সায় এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো। এমনি কত স্মৃতি। কিন্তু একটু পরেই স্বপ্নগুলো বদলে যায়। প্রতিটা স্বপ্নের শেষে এসে শারমিন কান্না ভেজা গলায় অনুনয় করে তার বাচ্চা মরেনি। ডাক্তাররা তার বাচ্চাকে নিয়ে গেছে। শফিক যেন তার বাচ্চাটাকে খুঁজে আনে।
এগুলো কি শুধুই স্বপ্ন? নাকি সত্যি সত্যি শারমিনের বিদেহি আত্মা স্বপ্নের মাঝে তাকে সত্যি কথাটা জানিয়ে যায়। অথবা এমন কি হতে পারে যে সত্যিটা শফিকের অবচেতন মন সব সময়ই জানত? সেই অবচেতন মন থেকে এখন সত্যিটা সামনে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। শফিকের সন্তান আসলেই বেঁচে আছে। রক্তের টান অবিচ্ছেদ্য। শফিক তার শিরায় শিরায় প্রবাহিত প্রতিটি রক্ত কণিকায় সেই টান অনুভব করছে।
.....
পরের দুইটা দিন শফিকের এক রকম ঘোরের মধ্যে দিয়ে গেল। এই দিনগুলোতে শফিক প্রচুর চেষ্টা করল শারমিনের অপারেশনের সময়কার ডাক্তার নার্স সবার সাথে কথা বলতে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শফিক ব্যর্থ হল। শারমিনকে দেখেছিলেন ডক্টর ইয়াসমিন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল তিনি এখন দেশের বাইরে আছেন। সার্জারির সময় আরো ছিলেন ডক্টর মুস্তাফিজ। এই মানুষটা দেশেই আছেন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কেন যেন শফিক তার নাগাল পেল না। মানুষটা যেন বায়বীয়, যতবার ধরতে যায় প্রতিবারই আঙুলের ফাক গলে বের হয়ে যাচ্ছেন। ডক্টরদের থেকে বেশি নার্সদের সাথে কথা বলা দরকার। শারমিনের অপারেশনের সময় কোন কোন নার্স উপস্থিত ছিল, পরবর্তিতে আইসিইউতে কোন কোন নার্স অর্ডারলি দায়িত্বে ছিল তার একটা লিস্ট তৈরি করে আগানো প্রয়োজন। সমস্যা হচ্ছে নার্সদের প্রায় কারোর নামই জানা নেই। দুই একজনের চেহারা শুধু মনে আছে। শফিক আন্দাজে দুই একজনের সাথে কথা বলে দেখল। এত আগের ঘটনা সম্পর্কে কেউই পরিষ্কার কিছু বলতে পারল না। হাসপাতালে সব সময়ই নতুন নতুন প্রেগ্নেন্সির রোগি আসছে। তাদের কেউ কেউ মৃত শিশুর জন্ম দিচ্ছে। এখানে এটা স্বাভাবিক ঘটনা। তিন বছর আগের কথা কে মনে রাখতে গেছে? শফিক সেই সময়কার হাসপাতালের রেকর্ড ডকুমেন্টসগুলো ঘেটে দেখল। এই ব্যপারে আবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খুব কড়া, কিছুতেই বাইরের কাউকে ইন্টারনাল ডকুমেন্টস দেখতে দেবে না। অবশেষে একজন অর্ডারলিকে কিছু টাকা ঘুস দিয়ে সেই সময়ের কিছু পেশেন্ট ট্রিটমেন্ট রেকর্ডের ফটোকপি বের করে আনা গেল। কিন্তু সেগুলো থেকে শফিক তেমন কোন তথ্য বের করতে পারল না। শফিকের আশা ছিল যদি সে সেই সময়ের ডাক্তার নার্স সবার সাথে কথা বলতে পারে তবে সে নিশ্চয়ই তার বাবুর অপহরণকারীকে চিহ্নিত করতে পারবে। কাজে নেমে তার পুরো বিষয়টাকে এখন রীতিমত অসম্ভব মনে হতে থাকে। অন্য কেউ হলে আরো অনেক আগেই হাল ছেরে দিত নিশ্চিত। কিন্তু তখন শফিকের ভয়ঙ্কর রকম জিদ চেপে গেছে। সে এর শেষ দেখে ছাড়বে। আর পুরো ব্যপারটাতেই কোথায় যেন বড় রকমের ঘাপলা আছে। সে শিশু মৃত্যু নিয়ে যার সাথেই কথা বলতে যায় সেই কেমন যেন চমকে উঠে, কথা বলতে চায় না। সবার মধ্যে কেমন যেন একটা চাপা অস্বস্তি, কি যেন গোপন করে যাচ্ছে এমন একটা ভাব। বিশেষ করে এই বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে গেলে তারা রীতিমত রুক্ষ আচরন করল। এতে শফিকের সন্দেহ আরো বেড়ে গেল। তৃতীয় দিন ইনফর্মেশন ডেস্কের লোকটার সাথে ঝগড়া, এরপর এক রকম হাতাহাতি হয়ে গেল। ওরা সিকিউরিটি ডেকে শফিককে হাসপাতাল থেকে বের করে দিল। সেই সাথে শাশিয়ে দিল, আবার এখানে এসে ঝামেলা করলে তাকে পুলিশে দেবে।
টানাহ্যচড়ায় শফিকের শার্টের পকেট ছিড়ে ঝুলছে। শফিক সেই ছেড়া শার্ট নিয়েই রাস্তার পাশের একটা হোটেলে ঢুকে গেল। মেজাজ অত্যন্ত খারাপ। সেই সাথে মাথাও ধরেছে ভীষণ। হেড়ে গলায় হোটেল বয়কে ডেকে চা আর দুইটা ডালপুরির অর্ডার দিল।
চায়ের কাপে মাছি ভাসছে। শফিক দির্ঘ সময় চেয়ে আছে মাছিটার দিকে। চায়ের মধ্যে তার শরীরের অর্ধেকটা ডুবে গেছে। মাছিটা এখনও বেঁচে আছে। মাঝে মাঝে একটু একটু পা নাড়ছে। আচ্ছা মাছিটার কুকড়ে যাওয়া শরিরটার সাথে ভ্রুনের মিল আছে না! মায়ের গর্ভে একটা শিশু অনেকটা এই ভঙ্গিতেই বুকের কাছে হাত পা ভাঁজ করে গুটিসুটি মেরে থাকে। একটু পর তার কাছে মনে হয় চায়ের কাপে ছোট্ট একটা বাচ্চা হাবুডুবু খাচ্ছে। শফিক দুই আঙুল দিয়ে মাছিটাকে তুলে আনলো চোখের কাছে। ব্যটা এখনো হাত পা নাড়ছে। আশ্চর্য! চায়ের উত্তাপে তো ওর এতক্ষনে সিদ্ধ হয়ে যাবার কথা!
শফিকের টেবিলে কেউ একজন চেয়ার টেনে বসল।
“আপনার নাম শফিকুল ইসলাম?”
শফিক চমকে মুখ তুলে তাকাল। মাঝবয়েসী একটা লোক তার সামনে বসে আছে। চোখে ভারি চশমা, মাথায় কাঁচাপাকা এলোমেলো চুল। পড়নে ঢোলা শার্ট।
“জি? আমাকে বলছে?”
“হ্যাঁ, আপনি শফিকুল ইসলাম তো?”
“জি, আপনি আমাকে কিভাবে চেনেন?”
“বলছি। আমি আসাদূর রহমান।”
“জি আসাদ সাহেব বলেন...”
“আপনাকে আমি দুই দিন দেখেছি ক্রিসেন্ট হাসপাতালে। আপনি কিছু বিষয়ে তথ্য চাইছেন, ঠিক না?”
“হ্যাঁ ঠিক।”
“আমি ক্রিসেন্ট হাসপাতালের গায়নোকলজি ডিপার্টমেন্টের ফরমার হেড। আমি হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারব।”
শফিক ভ্রু কুচকে মানুষটিকে ভালো করে দখে। লোকটার মধ্যে কেমন যেন একটা এলোমেলো খাপছাড়া ভাব আছে। চোখের দৃষ্টি কিছুটা উদভ্রান্ত, অস্থির। দেখে মোটেই একটা বড় হসপিটালের ডিপার্টমেন্ট হেড বলে মনে হয় না। গায়ে পড়ে সাহায্য করতে চাইছে। ব্যটার অন্য কোন মতলব নেই তো?
“কি ধরনের সাহায্য?”
“আপনি কিছু কনফেদেন্সিয়াল ডকুমেন্ট চাইছেন। ওরা আপনাকে দিচ্ছে না। আপনি সোজা লাইনে চাইলে কখনো দেবেও না। আমি আপনাকে অন্য কোন ভাবে ডকুমেন্টগুলো বের করার উপায় করে দিতে পারি।”
“অন্য উপায় বলতে......?”
“বলছি। কিন্তু তার আগে বলুন আপনি কি সাংবাদিক?”
“না”
“তাহলে আপনি এই ডকুমেন্টগুলো দিয়ে কি করবেন? আই মিন আপনার উদ্দেশ্যটা কি?”
“উদ্দেশ্য তো একটা আছেই।”
“হুম... আপনার ঠিক কি কি দরকার বলুন তো?”
“মার্চের ২৮ তারিখ, ২০০৯ এই সময় অপারেশন থিয়েটারে আর আইসিইউতে কে কে দায়িত্বে ছিল। ওই সময়ের দায়িত্বে থাকা বা অফ ডিউটিতে ওই সময় ফ্লোরে উপস্থিত ছিল এমন সব নার্স ওর্ডারলির নামের লিস্ট। সম্ভব হলে তাদের পার্সোনাল প্রোফাইল, ওয়ার্ক হিস্টোরি, ফ্যমিলি ব্যকগ্রাউন্ড এইসব।”
“আইসিইউ?... হুম। এগুলো দিয়ে আপনি কি করবেন?”
“সেটা আপনাকে এখনি বলতে চাইছি না।”
“আচ্ছা আপনি কি করেন? মানে আপনার পেশাটা কি?”
“আমি একটা বেসরকারি ব্যঙ্কে আছি।”
“তারমানে খোজা খুজির কারনটা পার্সোনাল। হুম।। আপনার কি বিশেষ করে আইসিইউর স্টাফদের তথ্য দরকার?”
“হ্যাঁ”
“হাসপাতাল খুব বেশি রেকর্ড মেইনটেইন করে না। তবে যা আছে তা আপনি পাবেন হাসপাতালের রেকর্ড আর্কাইভে।”
“রেকর্ড আর্কাইভে যাবার উপায়টা কি? কার কাছে এপ্লিকেশন করতে হবে?”
“এপ্লিকেশন করে তো আপনি কোথাও পৌছাতে পারবেন না। আপনাকে অবশ্যই চুরি করে ঢুকতে হবে।”
লোকটা কি মজা করছে? নাকি উলটা পালটা কথা বলে ওকে কোন ঝামেলায় ফাঁসাতে চাইছে? আসাদ সাহেবের চেহারা ভাবলেশহিন। দেখে বুঝার উপায় নেই সে কতটা সিরিয়াস। “কি বলছেন আপনি? চুরি করে ঢুকব মানে?”
“এই জন্যেই জিজ্ঞেস করছিলাম তথ্যগুলো আপনার কেন দরকার। কারনটা জানলে বুঝতে পারতাম এই ব্যপারে আপনি কতটা সিরিয়াস।”
শফিক কিছুটা অস্বস্তির সাথে বলল, “দেখুন, আপনি ঠিকই ধরেছেন। ব্যপারটা পার্সোনাল। সবার সাথে শেয়ার করতে চাই না।”
“কিন্তু আপনাকে সাহায্য করার আগে আমার বুঝতে হবে আপনাকে আমি বিশ্বাস করতে পারি কিনা। আর সেজন্যে আপনার প্রথমে আমাকে বিশ্বাস করতে হবে।”
শফিক কিছউক্ষন উসখুস করে তারপর বলা শুরু করল, “আমার ওয়াইফ ক্রিসেন্ট হসপিটালের পেশেন্ট ছিল। প্রেগ্নেন্সি কেস। প্রি-ম্যচিউরড ডেলিভারি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আর বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায়নি।”
“তারপর?”
“আমার ওয়াইফের ধারণা তার বাচ্চা মরেনি। বাচ্চাটা বেঁচে আছে। হসপিটালের লোকেরা বাচ্চাটা লুকিয়ে ফেলেছে।” বলেই শফিক একটু ভয়ে ভয়ে আসাদের দিকে তাকাল। লোকটা হয়তো এখন হো হো করে হেসে উঠবে। অথবা তাকে পাগল ঠাউরে বিরক্ত হয়ে উঠে যাবে। শফিক দুটোর জন্যেই প্রস্তুত ছিল। কিন্তু আসাদ দুটোর কোনটাই করলেন না। মুখটা গম্ভীর করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনার হাতে সময় আছে? থাকলে আসুন আমার সাথে।”
“কোথায়?” শফিক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“আমার বাসায়। আপনার যা দরকার তার প্রায় সবই আমার বাসায় পাবেন।”
মনে একরাশ দ্বিধা আর প্রশ্ন নিয়ে শফিক আসাদের পেছন পেছন চলল।
আসাদ সাহেবের বাসা পুরানো ঢাকার এক ঘিঞ্জি গলির ভেতর। এলাকাটা শফিকের অপরিচিত। নামকরা হাসপাতালের একজন রিটায়ার্ড হেড এইরকম একটা জায়গায় কিভাবে আছেন? আসাদ সাহেবের বাড়িটাও বেশ পুরানো। রংচটা একটা একতলা দালান। ঘরের ভেতরের চেহারাও একই রকম। ধুলো মোড়া পুরোনো আসবাব। মনে হয় অনেক দিন কেউ ঝারপোছ করে না। জিজ্ঞেস করে জানা গেল তার বাবার আমলে তৈরি বাড়ি। এখন তিনি ছাড়া আর কেউ থাকেন না। “তাহলে আপনার ফ্যমিলির আর মানুষ...?”
শফিকের আধখানা প্রশ্নের জবাবে আসাদ একটা দির্ঘশ্বাস গোপন করে বললেন, “এখন আর ফ্যমিলি বলতে কেউ নেই। বউয়ের সাথে ডিভোর্স হল আজ দুই বছর। সে মেয়েটাকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে।”
“ওহ” শফিক কিছুটা বিব্রত হয়ে চুপ করে যায়। আসাদ তাকে বসার ঘর থেকে ভেতরের স্টাডিতে নিয়ে আসে। স্টাডিতে মাথা গলিয়ে শফিক একটা ছোটখাট ধাক্কা খেল। ঘরের তিন দিকের দেয়াল ছোট বড় অসংখ্য পেপার কাটিং আর ফটোগ্রাফে মোড়ানো। মেঝেতে স্তুপ করে রাখা ফাইল আর বইয়ের পাহাড়। এটা কি ঘর না রিসার্চ আর্কাইভ?
“আপনার ওয়াইফ ঠিক কোন সময় ক্রিসেন্টের পেসেন্ট ছিল?” আসাদ জিজ্ঞেস করলেন।
“উম্ম... ২০০৯, মে মাসের ২৮ তারিখ ভর্তি করেছিলাম। ওই রাতেই অপারেশন হয়। তারপর হাসপাতালে ছিল পাঁচ দিন।”
শফিক তখন চোখ বড় বড় করে দেয়ালের পেপার কাটিং গুলো দেখছে।
একটা নড়বড়ে চেয়ার টেনে শফিককে বসতে দিয়ে আসাদ তার ফাইলের স্তুপ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শফিক পেপার কাটিংগুলো পড়তে থাকে। দেয়াল জুড়ে অপরাধের অসংখ্য খবর, সবই ডাক্তারি বা চিকিৎসা বিষয়ক। দেশের কোন হাসপাতালের বিরুদ্ধে দুর্নিতির অভিযোগ পাওয়া গেছে, কোন ডাক্তারের অবহেলায় রুগী মারা গেছে, ভেজাল ওষুধ খেয়ে কোন জেলায় কতজনের অবস্থা মুমুর্স এমনই সকল নিউজ দেয়াল জুড়ে। নিউজের পাশাপাশি অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও ভিক্টিমদের বেশ কিছু ছবিও আছে। এক পাশে শিশু অপহরণ বিষয়ক কিছু নিউজ চোখে পড়ল। একটা গবেষণামূলক প্রতিবেদন, সরকারি হাসপাতালগুলো থেকে শিশু নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। এদের মধ্যে দুই বছরের বাচ্চা থেকে শুরু করে নবজাতক শিশুও রয়েছে। ইদানীং কিছু নামকরা বেসরকারি হাসপাতলের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ উঠছে। কোথায় যায় এই শিশুরা? প্রতিবেদনের লেখক বেশ কিছু কেস স্টাডি তুলে ধরেছেন। সবশেষে শিশু নিখোঁজের একটা সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যানও আছে। শফিক দ্রুত বাকি দেয়ালে চোখ বুলিয়ে এই রকম আরো কিছু প্রতিবেদন আবিষ্কার করল। আসাদ সাহেব পেছন থেকে ডাকলেন “এই যে পেয়েছি... দেখুন।”
আসাদ সাহেবের হাতে একটা মোটা ফাইল দেখিয়ে বললেন, “এই ফাইলে ২৬ মে থেকে পরের এক সপ্তাহ ক্রিসেন্ট হসপিটালের গায়নোকলজি, অপারেশন থিয়েটার আর আইসিইউ এর সব ডাক্তার, স্টাফদের রেকর্ড পাবেন। আর এই ফাইলে ২০০৯ এ ক্রিসেন্টে যত ডাক্তার, নার্স ইত্যাদি ছিল সবার বায়োগ্রাফি, ওয়ার্ক প্রোফাইল, পার্সোনাল হিস্টোরি সব রেকর্ড করা আছে, ছবিসহ। দুই ফাইল ক্রস চেক করে আপনার যা দরকার খুঁজে নিতে হবে। আপনি ফাইল দুটা নিয়ে যেতে পারেন। কাজ শেষে আবার আমাকে ফেরত দেবেন।” শফিক দেয়ালের দিকে নির্দেশ করে বলে, “আচ্ছা এই রিপোর্টগুলো কি সত্যি?”
“আপনার কি মনে হয়?”
“কিন্তু... কিন্তু এরা যা অভিযোগ করছে তাতো একরকম অসম্ভব।”
“দেখুন শফিক সাহেব, অপরাধ জগতটা সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন? ওই যে বললেন অসম্ভব, আমাদের এই ধারণাটাকেই ওরা ব্যবহার করে আমাদের নাকের উপরে এই জঘন্য ক্রাইম করে যাচ্ছে। আপনার কেসটার কথাই ধরা যাক। প্রতি বছর বাংলাদেশে নবজাতক মৃত্যুর হার প্রতি লাখে প্রায় দেড়শর মত। এছাড়া যারা জন্মের কয়েক দিন পর মারা যায় তাদেরকে যোগ করলে সংখ্যাটা প্রায় দু’শোর কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াবে। এর মাঝে অর্ধেকই মারা যায় হাসপাতালে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এর মধ্যে কয়টা শিশু আসলেই মারা গেছে আর কয়টা শিশুকে ডাক্তার নার্স মিলে গায়েব করে দিয়েছে? জেনে অবাক হবেন নবজাতক শিশুদের একটা অত্যন্ত লোভনিয় মার্কেট আছে। এই শিশুরা চিন, থাইল্যন্ড, মিডল ইস্ট এমনকি ইউরোপ আমেরিকাতেও পাচার হয়ে যায়। চিন থাইল্যন্ডের ব্ল্যক মার্কেটে এইসব শিশুর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ চড়া দামে বিক্রি হয়। মিডল ইস্টে এদের মুলত রেসের জকি হিসেবে বিক্রি করা হয়। যেসব শিশুরা একটু বয়সে বড় তাদেরকে পেলে পুষে আরেকটু বড় করে ক্রিতদাস হিসেবে বিক্রি করা হয়। হ্যাঁ, আরব বাদশাদের মধ্যে এখনো স্লেভ রাখার মধ্যযুগীয় কালচারটা রয়ে গেছে। যেসব বাচ্চাদের ইউরোপে পাঠানো হয় ওদের দিয়ে যে ঠিক কি করে জানি না। তবে নানা রকম ভয়ঙ্কর গুজব প্রচলিত আছে। অনেকে বলে ওদেরকে সায়েন্টিফিক এক্সপেরিমেন্টের কাজে ব্যবহার করে, কেউ বলে সেক্স স্লেইভ বানায়। অবশ্য কোনটাই প্রমানিত হয়নি। পশ্চিমারা তাদের কাজকর্ম সম্পর্কে খুব সাবধান।”
“কিন্তু ... কিন্তু সবার চোখের সামনে দিয়ে এতো ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, আর কেউ কিছু বলছে না...” শফিকের মুখে কথা আটকে যাচ্ছে।
“এই বিজনেসে অনেক টাকা জড়িত। আর চক্রটা অনেক শক্তিশালী। সারা দেশজুড়ে এদের নেটওয়ার্ক। পুলিশ আদালত সব এদের হাতের কব্জায়। বাচ্চা চুরির কাজটা মুলত হাসপাতালের নার্স, ক্লিনার, এরাই করা থাকে। কিন্তু ডাক্তার বা অন্যান্য কর্মচারিরা যে কিছুই জানে না তা’নয়। এরাও প্রয়োজন মত টাকার ভাগ পায়। কিন্তু এদের পেছনে যারা কাজ করছে, যারা বাচ্চাগুলোকে দেশে –বিদেশে পাচার করে, এরা সবার ধরা ছোয়ার বাইরে। ওদের পরিচয় কখনো ফাঁস হয় না। পর্দার আড়ালে থেকে তারা সব কল কাঠি নাড়ে। অন্ধকার জগতের তারা ঈশ্বর।”
শফিক শব্দ করে একটা ঢোক গেলে। তারপর কপালের ঘাম মুছে বলে “এতোসব খবর আপনি একা যোগাড় করেছেন?”
আসাদ মাথা নাড়েন। শফিক বলে “কিন্তু... এর পেছনে যে সময় আর শ্রম দেয়া প্রয়োজন...”
আসাদ ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেন “আমি জানি আপনি কি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছেন। আমি শুধু শুধু কেন এর পেছনে এমন ক্ষ্যাপার মত লেগে আছি, এইতো? কি জানেন, আমি নিজেও নিজেকে এই প্রশ্নটা অনেকবার করেছি। কেন আমি এসব করছি? কি লাভ? কেন আমি শহরের এই মাথা থেকে ও’মাথা ছুটে যাচ্ছি? কেন শহরের প্রতিটি কোনে, প্রতিটি গলি ঘুপচিতে উঁকি দিয়ে বেড়াচ্ছি? কিসের আশায়? কেন আমি একটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারছি না? কেন জানেন? ওরা আমার সব কিছু নিয়ে গেছে। সব কিছু। আমার ফ্যমিলি, আমার ভবিষ্যৎ। আমার এখন আর কিছুই নেই। আপনি জানতে চেয়েছিলেন না কেন ওদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করছে না? কারন আপনি যখন ওদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন, শক্ত কন্ঠে প্রতিবাদ করবেন; ওরা তখন আপনাকে লোভ দেখাবে। এমন কিছু দিয়ে যা আপনি কখনো ফেলতে পারবেন না। যদি তাতে কাজ না হয়, তখন তাদের আসল চেহারা তারা প্রকাশ করবে। ওরা আপনাকে জালে ফাসিয়ে সবার সামনে একটা ঘৃণ্য অপারাধিতে পরিনত করবে। সমাজ আপনার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। আইন আপনার উপর আস্থা হারাবে। আপনার নিজের পরিবার আপনাকে ছেরে যাবে। সবার চোখে আপনি হবেন একজন ক্রিমিন্যাল, আস্তাকুড়ের উচ্ছিষ্ট। আর আপনি যদি তাতেও চুপ না করেন এবার তাদের শেষ অস্ত্র তারা প্রয়োগ করবে। সমাজের সামনে প্রমান করবে আপনি পাগল, উন্মাদ। আপনি যা বলছেন বা করছেন সবই উন্মাদের প্রলাপ। কেউ আর আপনার কথায় কান দেব না। আপনি হবেন সবার হাস্যরসের বস্তু। আজ আমিও তাই। আর সেকারনেই আজ আমার প্রতিটা দিন কেটে যায় এই ধরনের খবর সংগ্রহের মধ্যে দিয়ে। আমি একটু একটু করে তৈরি হচ্ছি, একটু একটু করে ওদের বিরুদ্ধে প্রমান খুঁজে বের করছি। শেষ পর্যন্ত আমি কি পারব এদের মুখোশ খুলে দিতে, আমি জানি না। আমি শুধু এটুকু জানি, এটা ছাড়া এখন আর আমার জীবনে কিছু নেই।”
শফিক দেখতে পায় আসাদ সাহেবের চোখ ভিজে উঠছে। আসাদ হঠাত জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, আপনি এবার কি করবেন?”
“জানার চেষ্টা করব আমার বাচ্চার আসলে কি হয়েছিল। যে ডাক্তার বা নার্স ওকে চুরি করে নিয়ে গেছে তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করব।”
“ধরুন আপনার আশংকাই সত্যি। আপনার বাচ্চা আসলেও চুরি হয়েছে। আপনি চোরকে সনাক্ত করতে পারলেন, তারপর?”
“তার কাছে জানতে চাইব আমার বাচ্চার শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল?”
“কিন্তু আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনি আসল কালপ্রিটদের কাছে কখন পৌছাতে পারবেন না, তাদের কোন রকম শাস্তি দেয়া তো দূরে থাক। আর আপনার বাচ্চা নিখোঁজের পর তিন বছর কেটে গেছে। বাচ্চাটা যদি এতো দিন বেচেও থাকে তবুও সে দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে বহু আগে। আপনি তাকে আর কখনো ফিরে পাবেন না।”
“আপনি বুঝতে পারছেন না।” শফিক গলা কেঁপে উঠে। “আমার বাবুটার হারিয়ে যাওয়া আমার জীবনে একটা বিশাল শুন্যতার মত। এটা যেন আমাকে একটা গভীর খাদে ঠেলে দিয়েছে। আর আমি শুধু পড়ছি, পড়ছি। এই পতনের যেন কোন শেষ নেই। আজ তিনটে বছর আমি কিছু দুঃসহ স্মৃতি আর একরাশ প্রশ্ন নিয়ে বেঁচে আছি। আমি এর শেষ দেখতে চাই। আমি জানি আমি আমার বাবুকে ফিরে পাব না। আমি শুধু একটা ক্লোজার চাই।”
শফিক যখন আসাদ সাহেবের বাসা থেকে বের হল তখন বাইরে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। পশ্চিম আকাশটা একটু একটু করে লাল বর্ন ধারন করছে। বাইরে কয়েক পা এগিয়েই শফিক থমকে দাঁড়াল। ঠিক কোন পথে এগুলে মেইন রোডে ওঠা যাবে সে মনে করতে পারছে না। এই পুরান ঢাকার রাস্তাগুলো একটা গোলক ধাঁধার মত। একটা আরেকটার সাথে নুডলসের মত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা। আর সবগুলো গলিই দেখতে এক রকম। একে তো এই এলাকা শফিকের অপরিচিত, তার উপর এখন সাঁঝের আলোয় মনে হচ্ছে গলিটার চেহারাই বদলে গেছে। এখন কি আন্দাজে আরো কিছুটা এগিয়ে যাবে নাকি আসাদ সাহেবের বাসায় ফিরে গিয়ে তাকে অনুরোধ করবে কিছুটা পথ এগিয়ে দিতে? এই নিয়ে শফিক কিছুটা দোটনায় ভুগে। অবশেষে নিজের ইন্সটিঙ্কটের উপর নির্ভর করারই সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও এই বিশাল মেইজ এর মধ্যে সে সহজে বের হবার পথ খুঁজে পাবে বলে বিশ্বাস করতে পারে না।
সরু গলি, দুপাশে বর্নহিন উঁচু দেয়াল। উপরে তাকালে প্রথমেই চোখে পড়ে মাকড়সার জালের মত ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য বৈদ্যুতিক তার। সেই তারের জালের ফাক দিয়ে দ্রুত আলো হারাতে থাকা আকাশটাকে এক চিলতে দেখা যায়। আশে পাশে জন মনিষ্যির চিহ্নও নেই। এই ব্যপারটা বিচিত্র। পুরানো ঢাকার অলিগলি গুলো মানুষে সব সময় গিজগিজ করে। এখানে আসার সময়েও পথে প্রচুর মানুষ চোখে পড়েছে। হঠাত রাস্তা ফাঁকা করে সবাই গেল কোথায়?
কর্কশ কাআআ... শব্দে শফিক একটু চমকে উঠে। ওর নজর চলে যায় রাস্তার ধারে দেয়ালের দিকে। দেয়ালের উপর এক সারি কাক বসে আছে। কাকগুলোর শরীর শির্ন, এখানে সেখানে পালক উঠে গেছে। কাকগুলোকে দেখে শফিকের কেমন যেন অস্বস্তি হয়। মনে হয় কাকগুলো যেন ওর দিকের তাকিয়ে আছে। শফিক হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়।
দ্রুত পা চালিয়ে বেশ কিছুটা পথ পার হয়ে এসে শফিক আবার থমকে দাঁড়ায়। এতোক্ষনে বড় রাস্তায় পৌছে যাবার কথা। সে কি গলি ভুল করেছে? বড় রাস্তায় পৌছবার আগে দু’বার বাঁক ঘুরতে হয়। প্রথমবার দুইটা বড় নারকেল গাছওয়ালা বাড়িটার হাতের ডান দিকে, আর পরেরটা একটা কোচিং সেন্টারের ব্যনারের পাশে। সব তো ঠিকই আছে। তাহলে? এখন কি করবে শফিক মনস্থির করতে পারে না। আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখবে রাস্তার খোঁজ পাওয়া যায় কিনা? রাস্তায় একটা মানুষও নেই যার কাছ থেকে একটু পথের হদিসটা জানা যায়। শফিক আরো মিনিট পনেরো হেঁটে হাল ছেরে দেয়। নাহ, এতোক্ষনে অবশ্যই বড় রাস্তায় পৌছে যাওয়া উচিত ছিল। পথ ভুল হয়েছে বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু ভুল হলটা কোথায়? আচ্ছা আবার সেই বড় নারকেল গাছওয়ালা বাড়িটার কাছে ফিরে গেলে কেমন হয়। সেখান থেকে আবার নতুন করে পথ চিনে ফেরা যাবে। শফিক ঘুরে পেছনে ফেলে আসা পথেই আবার চলতে শুরু করে।
প্রায় মিনিট বিশেক হাঁটার পরও সেই নারকেল গাছের বাড়িটার দেখা মেলে না। কি যে হচ্ছে বুঝতে পারে না শফিক। রাস্তাটা কি নিজে নিজে দিক বদলাচ্ছে? শফিক কি একটু আগে এই পথ ধরেই হেঁটে এসেছে? দুপাশের সব কিছু অপরিচিত লাগছে। একটু আগে হেঁটে আসার সময়ে দেয়ালে পর পর অনেকগুলো সিনেমার পোস্টার চোখে পড়ছিল। সেগুলো এখন আর চোখে পড়ছে না। ছাল চামড়াবিহিন নগ্ন দেয়ালগুলো যেন শফিকের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটছে। কেউ কি এরই মধ্যে এসে পোস্টারগুলো তুলে ফেলেছে? যত এগুচ্ছে গলিটা ততই সরু হয়ে আসছে। সুর্য চলে গেছে মন খারাপ করা দালানগুলোর আড়ালে। অন্ধকার বাড়তে শুরু করেছে। এই রাস্তায় এখন পর্যন্ত কোন ল্যম্প পোস্ট বা অন্যকোন বাতি চোখে পরেনি। একটু পর আঁধার আরো বাড়লে পরে পথ খুঁজে বাড়ি ফেরার আশা ছাড়তে হবে। কিছু দূর এগিয়ে আবার থেমে যেতে হয় শফিককে। হতাশায় আর ক্লান্তিতে মুখ কুচকে ফেলে। সামনে একটা বিশাল গর্ত, সরু রাস্তার এমাথা থেকে ও’মাথা পর্যন্ত পুরোটা খেয়ে ফেলেছে। গর্ত পেড়িয়ে ওপারে যাবার উপায় নেই। তার চেয়ে বড় কথা এই গর্তটাই প্রমান করে ও ঠিক পথে ফিরে আসেনি।
কাআআআ... প্রলম্বিত তীক্ষ্ণ আর্তনাদে শফিককে চমকে উঠতে হয়। দেয়ালের উপর অনেকগুলো কাক লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু দেয়ালের উপরেই নয়, মাথার উপর বৈদ্যুতিক তারের জালের উপরেও ঝুলে আছে অগুনিত কাক। এর আগে শফিক কখনো এতগুলো কাক এক সাথে দেখেনি। কাকগুলো থেমে থেমে কর্কশ গলায় ডেকে উঠছে। ডাকটা কেমন যেন আর্তনাদের মত শোনাচ্ছে। যেন কি এক অজানা বিপদের আগাম অশনি সংকেত বেজে উঠছে। অন্ধকারে কাকগুলোর চোখ জ্বলছে। অন্ধকারে কুকুর বেড়ালের চোখ জ্বলে, তাই বলে কাকের চোখ জ্বলে বলেতো কখনো শুনেনি। ওগুলো তাহলে কি? শফিকের গা একটু ছম ছম করে উঠে।
পেছন থেকে একটা অস্ফুট কাতর ধ্বনি ভেসে আসে। শফিক চমকে পেছনে তাকায়। শব্দটা আসছে গর্তের ভেতর থেকে। কেউ যেন অসহ্য ব্যথায় চাপা স্বরে কাঁদছে। কেউ কি গর্তে পরে গেছে? শফিক গর্তের কিনার থেকে নিচে উঁকি দেয়। গর্তের ভেতর জমাট বাঁধা অন্ধকার। নিচে কি আছে কিচ্ছু দেখা যায় না। শফিক চাপা গলায় ডাকে, “এই যে, নিচে কি কেউ আছেন?” কোন উত্তর পাওয়া যায় না। তারপর গর্তের ভেতরের দেয়ালে শফিকের চোখ আটকে যায়। দেয়ালের মাটির খাজে একটা কিছু আটকে আছে। কি ওটা? একটা বাচ্চা!! আরো ভালো করে তাকিয়ে ও বুঝতে পারে গর্তের খাজে আটকে থাকা ওটা একটা প্লাস্টিকের পুতুল। অন্ধকারে ওটার ছোট ছোট হাতপা গুলো দেখতে সত্যিকারের শিশুর মতই লাগছে। কি মনে হতে শফিক মাটিতে বুক দিয়ে শুয়ে পরে গর্তের কিনারায়। তারপর হাত বাড়িয়ে গর্ত থেকে পুতুলটা তুলে আনে। জিনিসটা হাতে নিয়ে উল্টে পালটে দেখে। পুরনো একটা প্লাস্টিকের পুতুল, শিশুর অবয়বে তৈরি। পুতুলের মুখটার একটা পাশ পুড়ে ঝলসে গেছে। ওখানটার প্লাস্টিক গলে গিয়ে কুৎসিত রুপ নিয়েছে। পুতুলের শরীরের ভেতরটা ফাপা। ঝাকিয়ে মনে হল শরীরের ভেতর একটা কিছু আছে। শফিক পুতুল্টার মাথা খমচি মেরে ধরে টানতে শুরু করে। একটু পরেই কুৎসিত মাথাটা ধর থেকে উপড়ে চলে আসে। ধরে কাত করতেই ভেতর থেকে এক টুকরো কাগজ টুপ করে মাটিতে পরে। শফিক কাগজটা হাতে তুলে নেয়। একটা পুরানো ফটোগ্রাফ। সম্ভবত কোন কারাগার বা কন্টেইনমেন্ট ফ্যসিলিটির ভেতরের দৃশ্য। ছবিতে দেখা যাচ্ছে লম্বা টানা করিডোর। করিডোরের দুপাশের সাদা রঙ করা দেয়ালে দুই সারি সেল। প্রতিটা সেলের প্রবেশ মুখে লোহার বারের ভারি দরোজা বসানো। এই ধরনের একটা ছবি বাচ্চাদের খেলার পুতুলের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখবে কে? আর পুতুলটা এখানে আসলই বা কোত্থেকে? আনমনে সে ছবিটা প্যন্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখে।
কেন যেন হঠাত শফিকের শরীর একটু ছম ছম করে উঠে। ওর মনে হয় আড়াল থেকে কেউ একজন তাকিয়ে আছে ওর দিকে। দ্রুত পেছন ফিরে তাকিয়েই শফিকের বুক হিম হয়ে যায়। দূরে পথের মাথায় একটা দির্ঘ ছায়ামুর্তিকে চোখে পরে। কখন থেকে সে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে কে জানে । এতো দূর থেকে অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু শরীরের আকারটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। শফিক চিনতে পারেছে ছায়ামুর্তিটিকে। আরো বহুকাল ওই অন্ধকার কাঠামোটি দেখে তাকে দুঃস্বপ্নের মাঝে চিৎকার করে জেগে উঠতে হবে। সেই দিনের সেই লোকটা। পার্কিং লটে যাকে দেখেছিল। ওই মানুষটা এখানে কি করছে? সেকি শফিককে অনুসরণ করে এসেছে? ছায়ামুর্তিটা নড়তে শুরু করেছে। একটু একটু করে সে এগিয়ে আসছে শফিকের দিকে। নিজের অজান্তেই শফিক একপা দু’পা করে পিছিয়ে যেতে শুরু করে। তার দৃষ্টি গেঁথে আছে আততায়ীর উপর। মানুষটা কাছে চলে এসেছে। কিন্তু কি এক অদ্ভুত কারণে তার মুখের অবয়বটি পরিষ্কার হচ্ছে না। কেমন একটা জমাট বাঁধা অন্ধকার যেন পাক খাচ্ছে তাকে ঘিরে। আটকে দিচ্ছে শফিকের দৃষ্টির সিমানা।
এক পা দু’পা করে পেছাতে পেছাতে একেবারে গর্তের শেষ প্রান্তে এসে থেমে গেল শফিক। আরেকটু হলেই উল্টে পড়ত গর্তের ভেতর। আর পেছাবার পথ নেই। সামনে আততায়ীও যেন সেটা বুঝতে পেরেছে। তার চলার গতি ধির। নেই। যেন কোন তাড়াহুড়ো নেই। শিকার ফাঁদে বাঁধা পড়েছে। এখন শুধু জাল গুটিয়ে আনার অপেক্ষা। রাস্তায় পা ঘসে ঘসে হেলেদুলে এগিয়ে আসছে সে। তার ডান হাতটা অলস ভাবে শরীরের পাশে ঝুলছে। সেই হাতের মুঠোয় ধরা একটা লোহার পাইপ। পাইপের শেষ প্রান্তটা রাস্তায় ঘষা খেয়ে গা শিশির করা আওয়াজ তুলছে। আরো কিছুটা এগিয়ে মানুষটি দাঁড়িয়ে যায়। তার চেহারার নাক মুখ সবই কেমন যেন অস্পষ্ট। শুধু চোখ জোড়া পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সে নিস্পলক তাকিয়ে আছে শফিকের দিকে। সেই চোখের দৃষ্টি বরফের মত শীতল।
মানুষটি ধিরে ধিরে তার ডান হাতটা সামনে মেলে ধরে। তার হাতে ধরা পাইপটাতে রক্ত শুকিয়ে আছে। রক্তের সাথে লেপ্টে আছে ওগুলো কি? মগজের টুকরো? এই চিন্তাটা থেকেই হয়তো শফিকের গায়ে হঠাত যেন চিতার ক্ষিপ্রতা চলে আসে। ধনুক থেকে ছুটে যাওয়া তীরের বেগে সে দৌড় লাগায়। আততায়ীর হাতের নিচ দিয়ে বাউলি কেটে সে নিজেকে প্রায় বের করে নিয়েই এসেছিল। একেবারে শেষ মুহুর্তে পেছন থেকে প্রচন্ড একটা হ্যচকা টানে সে তাল হারিয়ে উল্টে পরে রাস্তার উপর। হাচরে পাচরে উঠে বসার আগেই পেছন থেকে কাঁধের উপর প্রচন্ড বেগে নেমে আসে লোহার পাইপটা। থ্যক করে মাংস থ্যতলানর বিশ্রি শব্দ হয়।
শফিক দম নিতে পারছে না। চারপাশ দুলছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে হাজার রঙ। ফুসফুসে কেউ যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। শফিক দুর্বল ভাবে সামনে হাত বাড়িয়ে দেয়। একটা কিছু ধরার চেষ্টা করে। তার হাতে কিছুই ধরা পরে না। আবার পাইপটা উঠে যাচ্ছে উপরে। ভারি অস্ত্রটা এবার ওর বুক লক্ষ করে নেমে আসে। শফিক বাতাসে রক্তের কণা উড়তে দেখে। ওর বুকের হাড় ভঙ্গে গেছে। বুকের খাঁচা গুড়িয়ে দিয়ে পাইপটা সেধিয়ে গেছে ফুসফুসের ভেতরে। হৃদপিণ্ডটা যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে বুকের খাচায়। শফিক মুখের ভেতর রক্তের স্বাদ পায়। আস্তে আস্তে স্বাদটা তীব্র হয়ে ওঠে। একটা রক্তবর্ন কুয়াশা একটু একটু করে ঢেকে ফেলছে চারপাশ। ধোয়াটে রক্তের আড়ালে ঝাপসা হয়ে আসছে পৃথিবী । আর পারছে না শফিক। আর... আর...
পাইপটা আবার উপরে উঠে যাচ্ছে। টুপ টুপ করে রক্ত পড়ছে ওটার গা থেকে থেকে। পাইপটা এবার ঝুলে আছে ওর মাথার উপর। শেষ আঘাতটা আসবে এখনি।
কাআআআআ... ডানা ঝাপটে এক সাথে হাজার কাক উড়ে যায় আকাশে। তাদের প্রলম্বিত ডাকে গলির অন্ধকার যেন আরো ভারি হয়ে উঠে।
(not the end... but may not be continued)