২য় পর্বঃ Demon of Night
আমি নিশাচর।
প্রান হাতে নিয়ে আমি ছুটছি। আমার শরীরের ভেতর দু’টো তাজা বুলেট। মার্বেল সাইজের গর্ত দুটো দিয়ে গলগল করে রক্ত বেড়িয়ে যাচ্ছে। পেছনে মোটা লাল ছাপ ফেলে অন্ধকার রাজপথে আমি ছুটে চলেছি। আমার পেছনে হিংস্র নেকড়ের মত ছুটে আসছে শত শত পুলিশ। তাদের জিপের দানবীয় হেডলাইটের হলুদাভ আলো রাতের আঁধারকে কেটে ফেলছে ধারালো ছুরির মত। জিপের বহু পুরানো মরচে পড়া মোটরের গোঙানিকে এই নির্জন রাতে কোন এক প্রাগৈতিহাসিক শ্বাপদের জান্তব চিৎকার বলে মনে হচ্ছে। রক্ত লোভে অন্ধ শ্বাপদ বাতাস শুঁকছে, অনুমান করতে চাইছে তার শিকারের গতিবিধি। তারপর হিংস্র গর্জন তুলে ধেয়ে যাচ্ছে শিকারের সম্ভাব্য অবস্থানের দিকে।
মনে হচ্ছে আমি কতকাল ধরে ছুটে চলেছি। পা দুটো আর মস্তিষ্কের নির্দেশ মানতে চাইছে না। শরীর অবশ হয়ে আসছে। চোখে অন্ধকার দেখছি। কিন্তু তবু আমি ছুটে চলেছি। এই গলি থেকে সে গলি, গলি পেরিয়ে মাঠ, মাঠ পেরিয়ে একটা পুরানো মসজিদ, তারপর একটা বড় চৌরাস্তা, একটা কন্সট্রাকশন সাইট। আমি ছুটে চলেছি অন্ধের মত। কোথায় যাচ্ছি জানি না। শুধু জানি যতক্ষণ দম আছে আমাকে চেষ্টা করে যেতে হবে। আমাকে দূরে সরে যেতে হবে, আরও দূরে।
হঠাত অন্ধকার ভেদ করে মোটা হলুদ দুটো আলোক রশ্মি আমাকে ঢেকে ফেলল। পুলিশের জিপ। সাথে সাথে চাইনিজ রাইফেলের গগন বিদারী আর্তনাদ। এক ঝাঁক তপ্ত বুলেট বাতাসে শিস কেটে বেড়িয়ে গেল। তার একটা আদর করে চুমো খেয়ে গেল আমার কপালে। পাক খেয়ে রাস্তার পাশের নর্দমায় ছিটকে পড়লাম। কপালের গভীর ক্ষতটা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে, নিঃশ্বাস আটকে আসছে। ঝাপসা চোখে দেখতে পেলাম জিপ থেকে কালো পোশাকের চারটি ছায়ামুর্তি নেমে এসেছে। তাদের হাতে উদ্যত রাইফেল আমার দিকে তাগ করা। র্যাব!!বুঝতে পারলাম ওরা আমাকে জীবিত বন্দি করবে না। ক্রস ফায়ারে ফেলে দেবে। এই চিন্তাটাই যেন আমার শরীরে অসুরের শক্তি এনে দিল। তীব্র যন্ত্রণা উপেক্ষা করে নিজেকে টেনে তুললাম। আমাকে নড়তে দেখেই র্যাবের ভিত হাতে ধরা রাইফেলগুলো আবার জীবন্ত হয়ে উঠল। নিজের ক্ষিপ্রতায় আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। বাতাস চিড়ে ছুটে আসা প্রায় ত্রিশ রাউন্ড বুলেট এড়িয়ে আমি চোখের পলকে পাশের কন্সট্রাকশন সাইটের দেয়াল বেয়ে উঠে গেলাম।
দালানটা পাঁচ তলা। বুঝা যায় নির্মান কাজ অর্ধেক হয়ে বন্ধ হয়ে আছে বহু দিন। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অবশ্য আমার তাতে কি! অন্ধকারেও আমার নিশাচরের চোখ পরিষ্কার দেখতে পায়। কিন্তু এই দালানে চড়ে আমি আসলে নিজেকে কোণঠাসা করে ফেলেছি। নিচ থেকে শব্দ পাচ্ছি দালানটা র্যবের লোকেরা ঘিরে ফেলছে। আমার পালাবার পথ নেই। কিন্তু খোলা রাস্তায়ও আর টেকা সম্ভব না। পুরো এলাকায় গিজগিজ করছে পুলিশ।
র্যাবের একটা দল দালানের ভিতর ঢুকে পড়েছে। সিড়িতে ওদের পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি। আমি এখন রয়েছি দালানের তৃতীয় তলায়। এবার উপায়!! হিসহিস শব্দ শুনতে পেলাম। একি গ্যস আসছে কোত্থেকে? ভাবতে না ভাবতেই জানালা দিয়ে আরেকটা গ্যস সেল ঢুকে আমার পায়ের কাছে ফাটল। র্যাব কাঁদানে গ্যস ছুড়ছে। গর্তে ধোঁয়া দিয়ে ইঁদুরের মত আমাকে বের করে আনতে চাইছে।
গ্যসে চোখ জ্বলছে, কেউ যেন ফুসফুসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বুঝলাম এভাবে আর কয়েক সেকেন্ড গেলেই জ্ঞান হারাব। সিঁড়িতে বুটের শব্দ অনেক কাছে চলে এসেছে, বুঝলাম র্যাবের দলটি প্রায় পৌছে গেছে। আর কোন উপায় নেই। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আমি ছাদে যাবার সিঁড়ির দিক ছুটলাম। রইয়াব প্রতিটি তলায় ক্রমাগত গ্যস সেল ছুঁড়ছে, কোথাও এক দন্ড দাঁড়াবার উপায় নেই। এক দৌড়ে আমি ছাদে চলে এলাম। এখন??
পাগলের মত আমি এদিক সেদিক তাকালাম। খোলা ছাদে কোথাও লুকানোর জায়গা নেই। নিচে লাফ দেবার প্রশ্নই উঠে না। নিচে পুলিশ বন্দুক বাগিয়ে আছে, আমার শরীর মাটি স্পর্শ করার আগেই শ’খানেক বুলেট আমাকে গেথে ফেলবে। তাহলে?? সবচে কাছের বাড়িটাও প্রায় বিশ ফিট দূরে। এত দূর লাফিয়ে যাবার চিন্তা পাগলেও করবে না। এই সময় ঠাস করে ছাদের দরোজা খুলে গেল। মেশিনগান হাতে পাঁচটা র্যাব দ্রুত পায়ে ছাদে প্রবেশ করল। গ্যসমাস্কে মুখ ঢাকা র্যাবগুলোকে দেখতে লাগছে সাক্ষাৎ যমদূতের মত। আমি আর কোন উপায় দেখলাম না। লম্বা দম নিলাম। পায়ের ক্লান্ত পেশীগুলোকে শেষবারের মত টানটান করলাম। একটাই সুযোগ পাব। ব্যর্থ হলে নিশ্চিত মৃত্যু। অদ্ভুত ব্যপার, এই চরম মুহুর্তে চোখের সামনে বাবার মুখটা ভেসে উঠল। দৌড়ে গিয়ে ছাদের কিনার থেকে লম্বা লাফ দিলাম। মুখ দিয়ে নিজের অজান্তেই একটা প্রলম্বিত চিৎকার বেড়িয়ে এল।
বাতাসে আমার দেহটা ভেসে চলেছে। কয়েকশ পুলিশের হতভম্ব দৃষ্টিতে সম্ভবত বিশ্বের দির্ঘতম লংজাম্পটি প্রতক্ষ্য করল। প্রায় বিশ ফুট দূরত্ব পার হয়ে যখন পাশের ছাদে এসে পড়লাম, নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তাকিয়ে দেখি নির্মানাধিন দালানটার ছাদে র্যবগুলো বেকুবের মত চেয়ে আছে। এত অবাক হয়েছে, গুলি করতেও ভুলে গেছে। আমার ভেতরে উল্লাসের ঢেউ খেলে গেল।
Ha Ha.. Suck on this!!!
***
এর পরের পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠল। রাতটা লুকিয়ে থেকে দিনের আলো ফুটতে প্রায় মৃতপ্রায় অবস্থায় একটা ফোনবুথ থেকে জসিম চাচাকে ফোন করলাম। আমার গলার আওয়াজ পেয়ে চাচার চোখ কপালে উঠল। চাচা অবশ্য সাথে সাথে এলেন না। প্রায় ঘন্টা তিনেক পর চাচার দেখা মিলল। আমি তখন প্রায় অচেতন। চাচা আমাকে দেখে একটা কথাও বললেন না। সোজা টেনে গাড়িতে তুললেন। যাক, চাচা এসে গেছেন। আর কোন বিপদ আমাকে ছুটে পারবে না। আমি নিশ্চিন্তে জ্ঞান হারালাম।
চোখ মেলতে দেখি আমি একটা ভাঙাচোরা ঘরের মেঝেতে শুয়ে আছি। পিঠের নিচে কম্বল ফেলে আমার শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। বৃদ্ধ একজন ডাক্তার আমার ক্ষত পরিষ্কার করছেন। পাশেই রয়েছেন জসিম চাচা। আমাকে চোখ মেলতে দেখে যেন হাফ ছেরে বাঁচলেন। তাহলে কি আমার অজ্ঞান থাকার পুরো সময়টা তিনি দম আটকে ছিলেন?!
ডাক্তার জসিম চাচার বিশ্বস্ত। বয়েস হলেও যথেষ্ট দক্ষ। বিশেষ কোন যন্ত্রপাতি ছাড়াই এই ভাঙ্গাবাড়িতে বসেই আমার অপারেশন করেছেন। আমাকে কোন হাসপাতালে নেয়া যায়নি। হাসপাতালে গেলেই পুলিশের চোখে পড়ার সম্ভাবনা। তাছাড়া সেখাঙ্কার ডক্টরের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়া তো আছেই।
ডাক্তার চলে যেতেই চাচা জানালেন বাড়িতে নাকি আমার খোঁজে কয়েকবার পুলিশ গেছে। তাই আমাকে বাড়ি না নিয়ে গিয়ে পুরান ঢাকার এই বাসায় এনে তোলা হয়েছে। এই এলাকাটা এতো ঘিঞ্জি যে পুলিশের পক্ষে হঠাত রেইড দেয়া প্রায় অসম্ভব। আর পুলিশ যদি হঠাত চলেও আসে তবে পালানোর জন্যে গলি-ঘুপচির অভাব নেই। আমার শরীরের অবস্থা যথেস্টই খারাপ। একটা বুলেট নাকি হ্রদপিন্ড ঘেঁসে গেছে। ডাক্তার বলেছে শরীরের এই অবস্থায় নড়াচড়া করলে নিশ্চিত মৃত্যু। শরীর সুস্থ হয়া পর্যন্ত আমাকে এই বাড়িতেই লুকিয়ে থাকতে হবে। একজন বৃদ্ধ মহিলা রাখা হয়েছে, সেই আমার দেখাশোনা করবে। চাচা সারাক্ষন থাকতে পারবেন না, পেছনে পুলিশ লেগে রয়েছে। তবে যখনই নিরাপদ মনে হবে আমাকে এসে দেখে যাবেন।
আমি কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে অবশেষে বাবার কথা জিজ্ঞেস করলাম। জসিম চাচা মুখ কালো করে বললেন বাবা ভালো নেই। বেনামী ইমেইল আসা আরও বেড়েছে। প্রতিদিনই দুই একটা আসছে। ভেতরে নানারকম ভয়ঙ্কর হুমকি। বাসায় নাকি দুইবার চোর হানা দিয়েছিল। সারা ঘর লন্ডভন্ড করে রেখে গেছে। অবশ্য চোর যে জিনিসটার খোঁজে এসেছিল তা পায়নি। বাবা ক্রুজ রেইসের ফাইলগুলো বাসা থেকে আগেই সরিয়ে ফেলেছেন। ওগুলো বাবার ব্যঙ্কের ভল্টে সুরক্ষিত আছে। জসিম চাচার ধারনা বাসার উপর সারাক্ষন কেউ নজর রাখছে। রহস্যময় একটা কালো ভ্যঙ্কে নাকি তিনি বেশ কয়েকবার বাড়ির আশেপাশে ঘুরাঘুরি করতে দেখেছেন। বাবা দারুন ভয়ে আছে। বাসা থেকে প্রায় বেরই হয়না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “পুলিশের সাথে কথা বলেছ?”
চাচা শুকনো হাসি হাসলেন, “তোমার ব্যপারটা নিয়ে এমনিতেই পুলিশের সাথে একটা শত্রুতা তৈরি হয়ে গেছে। আর পুলিশের কাছ থেকে তেমন কোন সাহাজ্য পাওয়া যাবে না। নুরুল বলছে ক্রুজ রেইসের ওরা ভয়ঙ্কর মানুষ। ইন্টারন্যশ্নাল মার্কেটে নিটোজেন ফর্মুলার দাম কয়েক বিলিয়ন ডলার। এতো টাকার জন্যে তারা করতে পারে না এমন কিছু নেই।”
“এতোই যখন ভয় তখন ওদেরকে ফর্মুলাটা দিয়ে দিলেই হয়। বাবার ইগোই তার সর্বনাশ ডেকে এনেছে।” আমি ফোস করে নিঃশ্বাস ফেললাম।
“না, ব্যপারটা ইগোর নয়। ব্যপারটা কর্তব্য বোধের। তুমি নিজের দিকে তাকাও। ভেবে দেখ নিটোজেন তোমাকে কি অসিম ক্ষমতা দিয়েছে। ক্রুজ রেইস এখন আর ড্রাগ এডিকশন কিওর করতে আগ্রহি নয়। তারা এখন নিটোজেনকে উইপনাইজ করার কথা ভাবছে। এটা করতে পারলে ভবিষ্যতে বায়োকেমিক্যল ওয়্যার ফেয়ারের চিত্র পাল্টে যাবে। যার হাতে নিটোজেন সেনাবাহিনি থাকবে তাকে আর কেউ স্পর্শও করতে পারবে না। তোমার বাবা কখনো এটা হতে দিতে চায়নি। সেই জন্যেই সে ল্যাবের কাজ ছেরে দেশে চলে আসে। ওর আশা ছিল বাংলাদেশ পর্যন্ত নিশচই ওরা তাকে তারা করে ফিরবে না। কিন্তু ওরা এখন আমাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌছে গেছে।”
“ভালোই হয়েছে। এটো দিনে তার বিজ্ঞান সাধনার শখ মিটেছে। এবার ঠ্যেলা সামলাও।” আমি কন্ঠের শ্লেষটুকু লুকিয়ে রাখতে পারলাম না।
চাচা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “দেখ নাফিজ, আমি জানি এটা তোমাদের নিজেদের ব্যপার। আমার এর মধ্যে নাক গলানো ঠিক না। কিন্তু আমার ধারনা তুমি তোমার বাবাকে সবসময় ভুল বুঝেছ। তোমার হয়তো ধারণা তোমার বাবা তোমাকে ভালোবাসে না। কথাটা একেবারেই ভুল। তুমি ওর ছেলে, ওর নিজের রক্ত-মাংস। দুনিয়ায় তুমিই ওর সবচে আপন। তোমাকে কি ও ভালো না বেসে পারে? কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ওর প্রকাশ ভঙ্গিটা আমাদের থেকে আলাদা। আর তুমিও ওকে কখনো সুযোগ দাওনি। বাবার কাছ থেকে সব সময় দূরে দূরে থেকেছ। সুযোগ পেলেই বাবাকে অপমান করেছ। অথচ তোমাদের দুরত্বটা চাইলেই ঘুচিয়ে ফেলা যায়।”
আমি কাঁধ ঝাকিয়ে বললাম, “তুমি ঠিকই বলেছ।”
চাচার মুখ উজ্জ্বল করে বলল, “তাই!!”
আমি বললাম, “হ্যা, এটা আমাদের নিজেদের ব্যপার। তোমার এর মধ্যে নাক গলানো ঠিক না।”
চাচা আহত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিদায় নিলেন। যাবার সময় আমি বোধ হয় মানুষটার চোখের কোনে পানি চিকচিক করতে দেখলাম। ভালই হয়েছে, বাবার পক্ষে এহেন উকালতি কাঁহাতক সহ্য করা যায়?
***
কাকটা অনেক্কখন ধরে বসে আছে আমার জানালার কার্নিশে। ঘাড় বেকিয়ে আমাকে দেখছে আগ্রহ ভরে। আমি একটু অবাক হলাম। কোন কাককে এতক্ষন একই জায়গায় স্থির বসে থাকতে দেখিনি। আমি কিছুটা কঊতুহলি হয়ে উঠলাম। আমাকে খেতে দেয়া রুটি থেকে কিছুটা ছিঁড়ে জানালার সামনে ফেললাম। কাক সাধারন্ত কখনো ঘরের ভেতরে ঢুকে না। ওমা, এই কাকটা দেখি অনায়াসে টুক করে ঘরে ঢুকে মেঝেতে পরে থাকা রুটি খুটেখুটে খেতে শুরু করল। খাওয়া শেষে আমার দিকে আবার আগ্রহ ভরে চাইল, যেন জিজ্ঞেস করছে আর আছে কিনা। ব্যটা তো বেজায় পেটুক। আমি মজা পেয়ে আরও একটু রুটি ছিড়ে দিলাম। কাকটা আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছে। কাকটার গায়ের রঙ কুচকুচে কালো, তাতে পড়ন্ত বিকেলের রোদ পরে রীতিমত দ্যুতি ছড়াচ্ছে। শরীর সাস্থ বেশ ভালোই, খওয়া দাওয়ার মনে হয় কোন কষ্ট নেই। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, আমার টেবিলের উপরই অনেকগুলো রুটি পরে আছে। কিন্তু কাকটা সেখান থেকে কিছু নিচ্ছে। ভাবখানা যেন আমি নিজে থেকে কিছু নেব না। তুমি সেধে যেটুকু দেবে তাই খাব। খাওয়া শেষ করে সে আবার ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে চাইল। আমি বললাম, “কিরে আরো চাস? এতো খেলে তো মোটা হয়ে যাবি।” কাকটা মাথা ঝাঁকাল। আমার স্পস্ট মনে হল ওটা বলছে, না আর চাই না। কাকটা এমনভাবে আমার দিকে চেয়ে আছে যেন জিজ্ঞেস করছে তোমার কি খবর। আমি বললাম, আমি ভালো আছি। শুধু কাঁধের ব্যথাটা বেশ কষ্ট দিচ্ছে। কাকটা ঠোঁট নাড়ল। আমি প্রায় নিশ্চিত ও আমার কথা বুঝতে পারছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম তুই ভালো আছিস? তোর বাড়ি কই? কাকটা একটা ডানা তুলল। যেন দেখাতে চাইছে ওই ওখানে। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম সত্যিই কি আমি একটা কাকের সাথে গল্প করছি। নাহ এই খালি বাড়িতে একা একা থেকে আমার মাথাটা সত্যি খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
কাকাটা অনেকক্ষণ আমাকে সঙ্গ দিল। সন্ধ্যা নামলে ও যখন জানালা দিয়ে উড়ে গেল আমি সত্যি সত্যিই একা বোধ করতে লাগ্লাম। সময় কাটছে না কিছুতেই।
রাত ন’টার দিকে জসিম চাচার ফোন এল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে তিনি বললেন, “বাবা নাফিজ। তোমাকে একটা দুঃসংবাদ দেব।”
“কি হয়েছে?”
“তোমার বাবা... নুরুল... নুরুল সুইসাইড করেছে...”
চাচা আরও অনেক কিছু বলছে। আমি কিছুই শুনছি না। মাথার ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। দেয়ালে একটা টিকটিকি হেঁটে যাচ্ছে। আমি টিকটিকিটাকে দেখছি। এই বাসায় অনেক টিকটিকি।
“হ্যলো...নাফিজ... নাফিজ তুমি শুনতে পাচ্ছ?” চাচার উদ্বিগ্ন গলা ভেসে আসে। আমি ফোন কেটে দেই। অনেকক্ষণ ধরে ফোন হাতে এক জায়গায় স্থানুর মত দাঁড়িয়ে থাকি। কি করব বুঝতে পারছি না। সব এলোমেলো লাগছে। ভেতরে প্রচন্ড একটা আক্রোশ দানা বাঁধছে। ইচ্ছা করছে চিৎকার করে ঘরের দেয়ালগুলো ধসিয়ে দেই। সব শক্তি দিয়ে আমি হাতের মোবাইলটা ছুরে মারলাম দেয়ালের গায়ে। দেয়ালে আঘাত করে ফোনটা টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
সেই কাকটাকে দেখতে পেলাম, আবার ফিরে এসে জানালার কার্নিশে বসেছে। বিষণ্ণ চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে।
***
এখন অনেক রাত।
গোরস্থানের মাটি ভেজা। রাতে শিশির পড়েছে। ভেজা ঘাসগুলো পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। চারপাশটা কি ভীষণ নির্জন। রাতের নির্জনতার সাথে আমি অভ্যস্ত। কিন্তু কবরস্থানের নির্জনতা পুরোই আলাদা। একটু পরপর মৃদু বাতাস বয়ে যাচ্ছে। কবরগুলো যেন থেমে থেমে দির্ঘশ্বাস ফেলছে।
দুই সাড়ি কবরের মধ্যে দিয়ে আমি হাঁটছি। আমি বাবাকে দেখতে এসেছি। বাবার শেষকৃত্যের সময় উপস্থিত থাকতে পারিনি। আমাকে পুলিস খুঁজছে। বাড়ির কাছেই তারা ওৎ পেতে ছিল। বাবার শেষকৃত্যে মুখ দেখালেই সাথে সাথে গ্রেফতার করত। তাই জসিম চাচার নিষেধ মেনেই সারা দিন নিজেকে ঘরের ভেতর আটকে রেখেছি। এখন রাতের আঁধারে মুখ ঢেকে এসেছি বাবাকে দেখতে।
কত কথা জমে ছিল। বাবাকে একদিন বলব বলে কত শক্ত শক্ত কথা বুকের ভেতর জমিয়ে রেখেছি। লোকটা আমাকে সে সুযোগ দিল না। সারাটা জীবন সে আমার আশা আকাক্ষাগুলো গলা টিপে মেরেছে। মৃত্যুর সময়ে আমার শেষ চাওয়াটুকুও সে কেড়ে নিল। বাবাকে প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম কেন সে মা’কে হত্যা করল। এর জবাব আর তাকে দিতে হবে না। কাপুরুষের মত মানুষটা আত্মহত্যা করল। সবার চোখ ফাকি দিয়ে পালিয়ে গেল বহুদূরে।
বাবা গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছে। মরার আগে একটা নোট রেখে গেছে। “তোমরা আমাকে আর ছুঁতে পারবে না।” ব্যস এইটুকুই। আর কিছু নেই। নিজের সন্তানের কথা নেই। আত্মহত্যার কারন উল্লেখ করা নেই। অবশ্য আত্মহত্যার কারন আমরা আন্দাজ করতে পারছি। বাবা মৃত্যুর আগে তার গবেষণার সব কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলেছে। কম্পিউটরে থাকা সব তথ্য মুছে ফেলেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ব্যঙ্কের ভল্টে রাখা বাবার নিটোজেন ফর্মুলা নাকি বাবা আগেই উঠিয়ে এনেছিল। ধারণা করা হচ্ছে বাবা আর সব জিনিসপত্রের সাথে ফর্মুলাটাও ধ্বংস করে ফেলেছে। বাবা কিছুতেই চায়নি তার গবেষণার ফল অন্য কারো হাতে পড়ুক। যত দিন যাচ্ছিল ক্রুজ রেইসের হুমকির পরিমাণ বেরেই চলছিল। দিনরাত তারা বাবার উপর নজর রাখত। বাবা ক্রমেই আতঙ্কিত হয়ে উঠছিল। অবশেষে ভয়ে পাগল হয়ে মানুষটা চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল। নিজের গবেষণার সকল চিহ্ন ধ্বংস করে ফেলল। কিন্তু কাগজ পত্র পুড়িয়ে ফেলাই তো যথেষ্ট নয়। নিটোজেনের পুরো ফর্মুলা আছে তার মাথায়। তাকে বন্দি করে জোর করে ফর্মুলা আবার লিখিয়ে নেবে এমন হুমকিই ক্রুজ রেইস দিয়ে আসছিল। বাবা আর সে পথ খোলা রাখলেন না। কাগজপত্র পুড়িয়ে নিজেও ফ্যনের সাথে দড়ি পেঁচিয়ে ঝুলে পড়লেন। তিনি সফল। নিটোজেন ফর্মুলা বেহাত হবার কোন সম্ভবনা আর নেই।
বাবার কবরটা বেশ সাদামাটা। তার এপিটাফটা আরও সাদামাটা। কবরফলকে লেখা আছে “Here Lies Nurul Huda (1959-2012), Dedicated scientist, Loving father and a good man.”
“Loving father…”
“Loving father….”
কেন যেন হাঁটু দুটো খুব দুর্বল লাগছে। আমি কবর ধরে বসে পড়লাম। বুকের ভেতরটা ভেঙ্গেচুরে কান্না উঠে আসছে। আশ্চর্য, এতো অশ্রু এতদিন কোথায় ছিল?
কতক্ষণ বাবার কবর ধরে ছিলাম জানিনা। হঠাত কেমন যেন অস্বস্তি লাগল। মনে হল অন্ধকারে লুকিয়ে কে যেন আমাকে দেখছে। আমি ঘুরে তাকালাম। দূরে একটা কিছু নড়ে উঠল। মট করে শুকনো ডাল ভঙ্গার শব্দ শুনলাম। আমি দ্রুত উঠে এদিক সেদিক দেখলাম। কাউকে চোখে পড়ছে না। কিন্তু আমি নিশ্চিত কড়ই গাছটার নিচে আমি কাউকে দেখেছি। জ্বলন্ত চোখে সে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে।
***
নিশাচর আমার দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে আছে। তার মুখে উৎকট হাসি। কুটিল চোখ দুটো নাচিয়ে সে বলল, “The Game Begins Now. Are You Ready?” আমার ভীষণ ভয় লাগছে। আমি ছুটে পালাতে চাইছি। কিন্তু আমার হাত পা নড়ছে না। অসহায়ের মত আমি মেঝেতে শুয়ে আছি। নিশাচর চাপা স্বরে হাসছে। বড় শীতল সেই হাসি।
ঝাকি খেয়ে আমি ঘুম থেকে জাগা উঠলাম। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। উফ কি ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন!!
মাথাটা ভার ভার ঠেকছে। শরিরটাও কেমন যেন অবশ লাগছে। ঘুমটা মোটেও ভালো হয়নি।
বাইরে সকালের রোদ চড়তে শুরু করেছে। বেশ ক্ষিদে পেল। বাথরুমে গেলাম হাতমুখ ধুতে। হাতে পানি নিয়েই চমকে উঠলাম। আমার হাতে কালো কালো এগুলো কি? নাকের কাছে হাত নিয়ে শুঁকে দেখলাম। গা গুলিয়ে এল। এগুলো রক্তের দাগ। শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। কিন্তু এতো রক্ত আসবে কোথেকে? কি করেছি আমি?
অনেক চেষ্টা করেও কাল রাতে ঠিক কি হয়েছিল মনে করতে পারলাম না। কবরস্থান থেকে অনেক রাতে বাড়ি ফিরি। তারপর? আমি কখন ঘুমাতে গেলাম? কিচ্ছু মনে নেই। স্মৃতি সম্পূর্ণ ফাঁকা। আমি কি কাল রাতে আবার নিশাচরে পরিনত হয়েছিলাম? রাস্তায় কোন একাকি পথিক বা নিরিহ মাতালকে পিটিয়ে আধমরা করে এসেছি? কিন্তু কিছু মনে পড়ছে না কেন? নিশাচর তো এখন সম্পূর্ণ আমার নিয়ন্ত্রণে। এভাবে মেমোরি ব্ল্যক আউট তো আর এখন হয় না। তাহলে?
বাথরুম থেকে ঘরে পা ফেলতেই চোখ আটকে গেল দরোজার উপর। দরোজার সাথে একটা ছেড়া শার্ট ঝুলছে। শার্টটাকে আগে লক্ষ করিনি। শার্টটা হাতে নিয়ে দেখলাম। কোন হিংস্র জানোয়ার যেন নখের আঁচরে চিরে ফালাফালা করেছে শার্টটা। শার্টের বুকের কাছে রক্তের গাঢ় ছাপ দেখতে পেলাম।
শার্টটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।
বাহির থেকে প্রচুর হট্টগোলের শব্দ ভেসে আসছে। বারান্দা থেকে দেখলাম নিচে রাস্তায় বহু লোক জড়ো হয়ে আছে। কি ব্যপার! কৌতুহলি হয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। ভিড়ের সবগুলো মানুষ একসাথে কথা বলছে। কি যে হয়েছে বুঝার উপায় নেই। আমি মানুষ ঠেলে সামনে এগিয়ে গেলাম। মাটিতে একটা লাশ পরে আছে। লাশটার পড়নে শুধু একটা প্যন্ট। উদোম গায়ে অনেকগুলো গভীর আঘাতের চিহ্ন। মুখটা আর চেনার উপায় নেই। পিচের উপর রক্ত জমে কালো হয়ে আছে।
হঠাত আমার বমি পেয়ে গেল। শার্টটা কেন চেনা চেনা লাগছিল এখন বুঝতে পারছি।
ওটা জসিম চাচার শার্ট। গত ঈদে কিনেছিল।
(চলবে)
শেষ পর্বঃ নিশাচর Death Wish