বাংলার ঋতু বৈচিত্রে বর্ষার দাপট বোধ করি সবচাইতে বেশী। তাই ছোট বেলায় রচনা লিখতে গিয়ে প্রিয় ঋতু হিসেবে বর্ষাকালকেই সবাই বেশী প্রাধান্য দিত। বর্ষার অবিরাম সৌন্দর্যের সাথে আর কোন কিছুর তুলনা চলেনা। তাই হুমায়ূন গ্রন্থে যথন বৃষ্টিকে রেখে জোছনা নিয়ে মাতমাতি দেখি তখন রাগে গা জ্বলে যায় ।
বর্ষার এই বিদায় লগ্নে বৃষ্টিকে নিয়ে কিছু স্মৃতি শেয়ার না করলে মেঘমালারা খুব রাগ করবে । তাই আমার এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা গুচ্ছ বর্ষার বিদায়ী উপহার হিসেবে বৃষ্টিকে উৎসর্গ করছি। বৃষ্টি নিয়ে অনেক স্মৃতি থাকলেও বিশেষ কিছু ঘটনা শেয়ার করছি।
শৈশব সময়.....
ছোট বেলায় প্রায়ই কাগজ দিয়ে খেলনা নৌকা বনিয়ে বৃষ্টির পানিতে ভাসিয়ে দিতাম।বৃষ্টিতে ভেজার প্রবল আকর্ষন জীবনে প্রথমবারের মত মিটিয়েছিলাম সাত বছর বয়সে। বাইরে প্রবল বর্ষন আর ঘরে আমরা দুই বোন ছটফট করছি বৃষ্টিতে ভেজার জন্য। মা ঘুমুচ্ছে এটাই ছিল মোক্ষম সময় কিন্তু বাধ সাধল বেরসিক উচু দরজার ছিটকিনি। যা চেয়ারের উপর দাঁড়িয়েও আমার দৈর্ঘকে হার মানালো। শেষ পর্যন্ত ছোট বোনকে ঘাড়ে তুলে চেয়ারের উপর দাড়িয়ে দরজা খুলে এক দৌঁড়ে ছাদে। কতক্ষন ভিজেছিলাম মনে নেই কারন সেদিন বাইরের বর্ষনের সাথে আমাদের পিঠেও মায়ের দীর্ঘ বর্ষন ঝড়েছিল অবিরত। তবে বৃষ্টির যে অদ্ভুদ স্বাদ পেয়েছিলাম সেই নেশা আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
কৈশর বেলা ....
একবার নানা বাড়ীতে যাওয়ার পথে শুরু হল প্রবল বর্ষন। শহর পর্যন্ত পৌছে ঠিক হল রিক্সা যাবে না, নৌকায় যেতে হবে। নৌকায় সেদিন খাবার আয়োজন হল। জীবনে এত তৃপ্তি নিয়ে কখনও খেয়েছি কিনা মনে পড়ে না। কিছুক্ষন পর পর মাঝি পানি সেচে ফেলছিল। বৃষ্টির ঝাপটায় চারিদিক কুয়াশার মত রহস্যময়তা সৃষ্টি করেছিল। অদ্ভুদ দৃশ্য!! ইনজিন বিহীন নৌকা হওয়ায় যেতে বেশ সময় লেগেছিল তাই মা খুব বিরক্ত হয়ে মাঝিকে বলছিলেন আর কতক্ষন লাগবে? আর আমরা দুইবোন মনে মনে বলছিলাম ”ইস এই যাত্রা যেন কোনদিন শেষ না হয়” আমাদের প্রার্থনা কবুল হয়নি কারন ঐটাই ছিল আমাদের জীবনের প্রথম ও শেষ নৌকাভ্রমন। আর তাছাড়া এখনতো ইনিজিন বিহীন নৌকা দেখাই যায় না।
কলেজ বেলা..........
কলেজে ওঠার পর একবার আমরা বান্ধবীরা প্রায় ২০ জন মিলে বৃষ্টিতে ভেজার পরিকল্পনা নিলাম। যদিও গার্লস কলেজ ছিল কিন্তু নিয়ম কানুনে ছিল মিলিটারি শাষন (অবশ্য কলেজটাও ছিল মিলিটারীদের )। কলেজ থেকে কড়া নির্দেশ ছিল বৃষ্টি নামলে কোন মেয়ে (অফ প্রিয়ড থাকলেও) কলেজ চত্বরে ঘোরাঘুরি করতে পারবেনা। কিন্তু ইচ্ছা কি আর নির্দেশ মানে? সবাই মিলে নেমে পরলাম বৃষ্টি অভিজানে। সেদিন আমাদের শরীর চর্চার শিক্ষিকার সেকি ধাওয়া!! আমরাও দৌড়াচ্ছি উনিও আমাদের তাড়িয়ে বেরাচ্ছেন দস্তুর মত। সারা ক্যাম্পাস জগিং করেও উনি একটা মেয়েরও টিকিটি পর্যন্ত ধরতে পারেননি।
ভিপি ম্যাডামের কাছে বিচার গেল প্রায় ৪ দিন পর। কারন মহামান্য ম্যাডাম বৃষ্টির ধকল কটিয়ে উঠতে ৪ দিন সময় লেগেছিল। সেদিন তার রুমে ডেকে নিয়ে মেয়েদের সেকি তিরস্কার!! তোমরা কি নিজেদের বাংলা ছবির নায়িকা ভাব? চেহারাটা কখনও আয়নায় দেখেছ? ইত্যাদি ইত্যাদি। এইগুলা কোন ব্যপার ছিলনা, যে যাই বলুক বৃষ্টিতে তো ভিজেছি।
সাদা বৃষ্টি ও নীল শার্ট.....
একদিন প্রবল বৃষ্টির সময় বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম। চোখে পড়ল এক অদ্ভুদ দৃশ্য। আমাদের বাড়ীর সামনেই খোলা মাঠের বেঞ্চিতে নীল শার্ট গায়ে কেউ একজন নির্বিকার ভাবে বসে ছিল। প্রবল বৃষ্টির ঝাপটায়ও তার শূন্য দৃষ্টির মধ্যে কোন বিকার দেখা গেল না। ভীষন বিষন্ন আর অন্যরকম লাগছিল তাকে। তাকে দেখার জন্যই বারান্দা থেকে ছাদে গিয়ে দাড়ালাম। এখনও বৃষ্টি হলে সেই বারান্দায় গেলে দৃশ্যটা স্পষ্ট চোখে ভাসে।