somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বড় গল্প: দাগ অথবা কাজল (কিস্তি — ১৬ম)

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




৩৮

সন্ধ্যা নামতেই বাড়ি ভরে গেল কোলাহলে। খুব বেশি নয়, কাছের সবাই; আর দু-চারজন প্রতিবেশী। কিন্তু নীলার চোখ যা খুঁজছিল, তা পেল না, শেষ পর্যন্ত।
সবাইকে বিদায় করে, বিষণ্ণবদনে ঘরে ঢুকে চুড়ি খুলতে লাগল— ব্যথায় মুখটা সামান্য বিকৃত করে বলল, ‘আজ তার কী হল?...’
‘ফোনে তিনবার ক্ষমা চেয়েছ— জরুরি অপারেশন ছিল।’
‘হয়ত না-ও থাকতে পারে, বানিয়ে বলেছে।’
‘একবার তো এসেছে, প্রতি নিমন্ত্রণে আসতেই হবে?’
‘আমার সন্দেহ—দাদা কিছু লুকোতে চাইছেন।’
‘কী আবার লুকোতে চাইবে।’
দিপু নীলার আলোচনাটা ঘুড়িয়ে দিতে কৌশলের আশ্রয় নিল।
‘একটা ঘটনা শোনাই— ওর একবার বৌদির সাথে কিছু একটা নিয়ে ঝগড়া। ও তো রেগে-মেগে ড্রয়িং-রুমে— খাবেও না, আর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওখানেই ঘুমবে। বৌদি ডেকেই চলেছেন কোনও সাড়া নেই। বৌদি শেষ-মেষ এসে যখন হাত ধরে টান দিলেন। শৈলেশ বৌদির দিকে তাকিয়ে, একটু কী ভাবল— সুড়সুড় করে চলে গেল, খাবার টেবিলে।’
নীলা নড়েচড়ে বসল, ‘কেন? ঘটনা কী?’ কারণ জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে চাইল দিপুর মুখে।
‘শৈলেশের মনে হল— বৌদি যে সিঁথিতে সিঁদুর দিয়েছে, সে-তো ওর জন্যই। শৈলেশের অস্তিত্ব সমস্ত পৃথিবীকে জানিয়ে দিতে চাইছে, ওই সিঁদুর পরে। এর সাথে রাগ করে থাকা— নিজেকে খুব বোকা আর অপদার্থ মনে হল ওর... মানুষের জীবনের অতি নগণ্য বিষয়গুলোও কখনও-সখনও বড় প্রভাবকের কাজ করে। ওর তবু সিঁদুর ছিল— আমার? রাগ করলে কী দেখে তোমার পিছ পিছ ঘুরব?’
দিপু মুখে হাসি ছড়িয়ে, নীলার দিকে চেয়ে রইল। ভাবটা এমন, ওকে বিব্রত করতে পেরেছে। এবং তাতে বেশ মজা পাচ্ছে।
‘এক কাজ করো, আমাকে শাঁখা-সিঁদুর কিনে দিয়ো, আমি ওগুলো আঁচলে পুটুলি বানিয়ে দুলিয়ে দুলিয়ে তোমার সামনে দিয়ে হাঁটব।’ নীলা হি হি করে হাসতে লাগল। দিপুও হাসির উত্তর দিয়ে, চেয়ে রইল।
‘কোনও চিহ্ন নেই বলে কষ্ট?... টিপ, কাজল হলে চলে? সব সময় কাজল যদিও চোখের জন্য ভাল নয়— মাঝে-মধ্যে তো আমি চোখে দেই-ই। আরও একটা তোমার ভাললাগার চিহ্ন কিন্তু বহন করছি আমি। দেখো তো ভাল করে?’ মিটি মিটি হাসতে লাগল নীলা।
‘না, কিছু দেখতে পাচ্ছি না।’
হাসতে হাসতে নীলা বলল, ‘এই যে শাড়ি... বিয়ের পর এক মূহুর্তের জন্য কি, আমি ছেড়েছি? আজকাল কি কেউ আর সব সময় শাড়ি পরে থাকে? তুমি পছন্দ করো তাই...’
দিপুর দৃষ্টি নীলার মুখে গেঁথে রইল। কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না, ওর শাড়ি পছন্দ— সেটা নীলা জানল কেমন করে। শাড়ি পরে বলে নীলাকে খুব ভাল লাগে, এখন বলছে— দিপুর ভাললাগার কারণেই পরে।
নীরবতা ভেঙ্গে দিপু প্রশ্ন করল, ‘শাড়ি পছন্দের কথা মঙ্গল ভাই জানে না, তুমি?...’
নীলা রহস্য-ভরা হাসি দিয়ে একটু সময় চুপ করে রইল।
‘ব-ল-ও-না-?’
‘মনে আছে? যেদিন ম্যাগাজিন নিয়ে তোমার কাছে এসেছিলাম। লক্ষ করলাম— শাড়ি পরিহিতাদের ছবির পৃষ্ঠা ওলটাতে, তুমি বেশি সময় নিচ্ছ।’
‘নী-লা-!’
দিপু হতবিহ্বল হয়ে বোকার মতো নীলার দিকে তাকিয়ে থাকল। নীলার মুখটা হঠাৎ-ই ঝাপসা হয়ে বেঁকে গেল দিপুর কাছে।
‘সুমিকে কত করে বলার পরও, কোথাও বেড়াতে যেতে শাড়ি পরাতে পারতাম না... আমার পছন্দকে উপহাস করতেই যেন...’ দিপুর কণ্ঠ কেঁপে কেঁপে উঠল।
‘সে জন্যই তো খুব সহজেই তোমার কাছে আসতে পেরেছি।’
‘না, কারও ব্যর্থতার সুযোগে নয়, তোমার ভালবাসার শক্তিতেই তুমি ওপরে উঠে এসেছ।’
নীলার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। এক মুহূর্ত দুজনেই চুপ করে রইল। নীলা মন-দিয়ে আঙ্গুলে আঁচল পেঁচাতে লাগল। চুপ করে আছে খেয়াল হতেই, দুজনই দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। দিপু হাত বাড়িয়ে দেয়ায় নীলা বুকের মধ্যে চলে এল। জড়িয়ে ধরল দিপু, দুহাতে— নীলা ওর বুকের মধ্যে সংকুচিত হয়ে গেল, একটা টিস্যু-পেপারের ফুলের মতো।
‘প্রিয় মানুষের চিহ্ন কি কেবল মেয়েরাই বহন করবে? নারীদের প্রতি সবখানেই বৈষম্য...’ ঠোঁট ফুলিয়ে যোগ করল নীলা।
‘ঠিক আছে নাকটা ফুটো করে, কানা-কুঁকড়ার পালক গুঁজে রাখব। আফ্রিকানদের মতো।’
নীলা হো হো করে হাসতে লাগল।
‘কানা-কুঁকড়া কী গো?’
‘কানাকুয়া— ধুসর-কালো, ডানাটা খয়েরি কাকের মতো নিরীহ ধরণের একটা পাখি, তবে কাকের মত নোংরা নয়। সাধারণত পোকা-মাকড় খায়, আজকাল তেমন একটা চোখে পড়েই না।’
‘বাঁশ-ঝাড়ে থাকে কি? মনে হয় চিনেছি।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ধরতে পেরেছ।’
‘কিন্তু গলায় কার মুণ্ডু ঝোলাবে? ইঁদুরের!’
‘আরে শোনো— একটা কথা মনে পড়ল, কিছুদিন আগে টিভিতে দেখলাম— এক বাবা তার স্তনের বোঁটা দুটোয় ফুটো করে রিং পরিয়ে তাতে একটা দোলনা ঝুলিয়ে বাচ্চাটাকে দোল খাওয়াচ্ছে। বাচ্চাটি খুব হাসছে, বাবাও খুব খুশি।’
নীলা দুলতে লাগল, হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলল।

৩৯

‘নীলা আমার ব্যাগের পাশ-পকেটে একটা ডাইরি আছে, আসার সময় সঙ্গে এনেছি, আনবে?’
‘ওভাবে বলছ যে? আমি কখনও বিরক্ত হই?’ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল।
হাত থেকে ডাইরি নিয়ে দিপু বলল, ‘আজ একটা কবিতা পড়ব, অনেক আগের লেখা। লেখার একটা ঘটনা আছে, আগে সেটাই শোনাই। বছর সাত হবে, আমার কাঁধের একটা টিউমার ফেলেছিলাম। ঘা শুকোনো, ব্যথা আরও কিসের কিসের এক-গাদা ওষুধ দিল। সেসব ওষুধ খেয়ে, মুখের রুচি গেল নষ্ট হয়ে। শরীরও বেশ দুর্বল হয়ে গেল। আবার মাঝেমাঝে অস্বাভাবিক ক্ষুধা লাগত। তখন হাত-পা কাঁপতে শুরু করত। একদিন এ রকম ক্ষুধা পেলে, সুমির কাছে খাবার চাইলাম। তো টেবিলের টুংটাং শব্দ পেয়ে, বুঝতে পারলাম খাবার দেয়া হচ্ছে। সুমি ডাকতে এলে, সোয়া থেকে উঠলাম। হঠাৎ আমার মাথাটা ঘুরে উঠল, কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। মনে হল কানে তালা লেগে যাচ্ছে, চোখে জোনাকি-পোকা দেখতে লাগলাম। দাঁড়ানো অবস্থা থেকে শুয়ে পড়লাম। হাত-পা অবশ হয়ে এল, কিছুটা যেন অজ্ঞানের মতো হয়ে গেলাম।
‘কিছুসময় পর কানের তালা একটু একটু করে খুলতে লাগল। আমি ওভাবেই পড়ে রইলাম। এর মধ্যে সুমি আরও দুবার ডাক দিয়েছে। এক সময় শুনতে পেলাম, ফোনে কার সাথে কথা বলছে। “ভণ্ডামি করে... অসুস্থতার ভান করে। খাবার চাওয়ার পর, এক মিনিটও তর সয় না... অজ্ঞান হবার অভিনয় করে।” এই সব... কথাগুলো শুনে আমি এত কষ্ট পেয়েছিলাম!... সেদিন রাতে এটি লিখেছিলাম।’

একটা দীর্ঘশ্বাস জমে বরফ
ঝেরে ফেলি কোথায় বলো তো?
অন্ত:ক্ষরণগুলো না-হয় ঢেকে রাখা যায়
মুক্তোয় গড়া চকচকে অশ্রু!

বেদনা, কষ্টগুলো যে কত কত দামি
হিরে, পান্না, জহরতের চেয়ে
সেসব কাউকে দেখাতে নেই, বলতেও নেই।
চুরি হয়ে যেতে পারে যখন তখন।

তোমাদের কারও কি জানা আছে—
ঘন-বনে ঘুম-জড়ানো শরীর এলানো সেই ঘাটের নাম
ঝরা-পাতারাও যেখানে অংক জানে— হিসেব মানে
আঁজলার জলে ধুয়ে ফেলা যায় যত কষ্টগুলো—
একটু জায়গা হবে,
তোমাদের কারও কাছে?
যেখানে কাঁদতে পারি, চিৎকার করে,
মনের সুখে—
কিন্তু বলবে না কেউ—
দেখো একজন পুরুষ-মানুষ কাঁদছে—

নীলার চোখ দুটো হাঁড়ির রসগোল্লা হয়ে উঠল । আঁচলে চোখ মুছল, নীলা কোনও কথা বলছিল না। চুপ করে বসে আছে দেখে, জিজ্ঞেস করল— ‘ভাল লাগেনি?’
‘ভাল— জুদাসের চুম্বনের মতো!’
‘নীলা!’
চোখ না তুলে একটু কেশে বলল, ‘শুনছি, বলো।’
‘এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমার মাথায় একটা ভাবনা আছে। মূল বিষয়টা এমন— পুরুষদেরও যে দুঃখ-কষ্ট আছে, সেসব প্রকাশ করতে চায়, সে-ও যে কাঁদতে চায়; কিন্তু সমাজ তা প্রশ্রয় দেয় না, এই নিয়ে।’
নীলা জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে দিপুর মুখে তাকাল। দিপু পড়তে শুরু করল (ডাইরিতে অগোছালোভাবে লেখা।)— ‘আমার ইচ্ছে আছে, এই বিষয়কে নিয়ে, একটা ক্ষুদে চলচ্চিত্র তৈরি করব। সেজন্য অবশ্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। সেটা হয়ে গেলে সুবিধা মতো শুরু করে দেব।

‘শুরুটা এমন— একটি যুবক, যার বয়স ত্রিশের কাছে। ছোট একটা চাকরি করে শহরে। স্ত্রী, পাঁচ বছরের কন্যাকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে থাকে। এই নিয়ে তার ছোট্ট সংসার।
এক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তার কন্যা সম্প্রতি যোগ দিয়ে, জন্ম-দিন সম্পর্কে নানা বিষয়, তার মায়ের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে। তার জন্মদিন কবে, তারিখটি কবে আসবে, আটমাস ধরে সেই প্রশ্ন, অনবরত করে যায়, ওর মার কাছে। শেষে সত্যি সত্যি জন্মদিন নিকটে চলে আসে। মেয়েটি ফোনে বাবাকে একটি পুঁতির-মালা, টিপ, চকলেট আর আলতা আনতে বলে। যুবকটি আগেই নিয়োগকর্তার কাছে বলে রেখেছে, দুদিন ছুটির জন্য। তিনি রাজিও হয়েছেন ছুটি দিতে। একদিন সে দুই সেট জামা-কাপড়, মেয়ের বায়না মতো— টিপ, মালা, আলতা আর চকলেট কিনে নেয়। বৃহস্পতিবার ব্যাগ নিয়েই অফিসে রওনা হয়, যাতে বিকেলে সরাসরি ট্রেনে চাপতে পারে। কিন্তু দুপুরে কর্তা-ব্যক্তিটি ডেকে তার ছুটি বাতিল করে দেয়। কিছুতেই বাড়ি যাওয়া চলবে না। অনেক অনুনয়-বিনয় করে কপালে কিছু গালাগাল জোটে। যুবকটির চোখ জলে ভরে উঠলে, আবার এক ধমক, বিদ্রুপ করে, তার চোখের সামনে থেকে চলে যেতে বলে। বাথরুমে ঢোকে সে, একটু কাঁদবে বলে। ঢুকতে না ঢুকতেই দরজায় ধাক্কা—বেরিয়ে আসতে হয় হতাশ হয়ে। একটু নির্জনে, সে কাঁদতে শুরু করে। সহকর্মীরা হিজড়া বলে ব্যাঙ্গ করে, একত্রে হা হা করে হাসতে থাকে।
‘অফিস শেষে, রাস্তায় বাসস্ট্যান্ডের পাশে, অনেক খোঁজাখুঁজি করে, একটু জায়গা পায়। ব্যাগটি সামনে রেখে, ওপরে হাত দুটো রেখে কাঁদতে শুরু করে। কোথা থেকে চার-পাঁচজন পথচারী জমে যায়। একজন বলে বসে “এ-ই, মাইয়া-মানুষের ডিউটি নিলা, ওরা যে বেকার হয়া যাইব।” একযোগে সবাই হেসে ওঠে। একজন বলে—“দেখ, আসলে ঘটনা কী? কী সমস্যা?” পাশের জন বলে, “ওই, কোনও বি-প-দ? উত্তর দেয় না তো। বোবা না-কি?’’ যুবকটি মুখ তুলে তাকায়— গোল হয়ে তাকে ঘিরে অনেক মুখ। দুএকটি মুখ গম্ভীর; কারও মুখে হাসি— এখন কী খেলা শুরু হয়। সে তাকিয়েই থাকে।
‘এভাবে সে আরও চেষ্টা করে, একটু কাঁদার জন্য, কোনও জায়গা পায় না।
‘বৃহস্পতিবার রাস্তায় বেজায় ভিড়, বাসে উঠতে দেরি হয়ে যায়। এরই মধ্যে কোথা থেকে উড়ে আসে বৃষ্টি। ঝমঝম বৃষ্টি— চারিদিক ঘোলা হয়ে আসে। কী মনে করে যুবকটি কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। বৃষ্টি বাড়তে থাকে। যুবকটি ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকে, কিন্তু কেউ কিছু বলে না, কারও নজরে পড়ে না। সে হাঁটতেই থাকে। একজন পথচারী বলে, “ভাই সামনেই ডান দিকে যান— ডাক্তারখানা আছে।” যুবকটি তাকে ভাল করে দেখে, ব্যাগ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। এক সময় খেয়াল হয়— তার পা বেয়ে, লাল এসব কী! পর মুহূর্তেই বুঝতে পারে— ব্যাগে-রাখা মেয়ের আলতা জলের সাথে মিশে, পা বেয়ে শহরের সারা রাস্তায় মিশে যাচ্ছে... নামটা হতে পারে, অসহায়ের বন্ধু প্রকৃতি।’
নীলা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিল। দিপু নীলার দিকে চাইল, ওর ছলছল চোখ দেখে দিপু নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরল। মুখ বিকৃত হয়ে গেল। নীলা দিপুর হাত ধরে বলল, ‘তোমার মনে এত কষ্ট!...’
দিপু শব্দ করে ঢোক গিলল। মনে হল কিছু একটা গলায় আটকে আছে। একটা কিছু বলতে চাইল দিপু, কিন্তু পারল না, শুধু তাকিয়ে থাকল— কয়েক দিন দেখা না হওয়া রাজহাঁস যুগল, সাক্ষাতের শুরুতে যেভাবে পরস্পর শুধু তাকিয়ে থাকে...

৪০

নীলা কলেজে যাবে। দিপুর কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে কিছু বই-পত্র, নীলার কিছু ছবির এ্যালবাম দিয়ে গিয়েছে। দিপু প্রথমেই ছবিগুলো দেখতে লাগল। ছোটবেলার নীলা— ঘাসভর্তি একটা মাঠের মধ্যে, হাতে ছোট ছোট নীল ফুলসহ একটি ডাল, সম্ভবত তিসিফুলের হবে। দিপু একটুক্ষণ তাকিয়ে মুচকি হাসল। ওর মনে পড়ল, শোনা একটি গল্পের কথা। এক প্রেমিক রাতে সবার অগোচরে প্রেমিকার ঘরে ঢুকলে, তার বাবা টের পেয়ে যায়। আর প্রেমিকটি গিয়ে ওই ঘরে রক্ষিত তিসির গোলার মধ্যে লুকোয়। কিন্তু পিচ্ছিল তিসিতে চোরা-বালির মতো ডুবে প্রাণ হারায়। প্রেমিকাই তাকে গোলাটা দেখিয়ে দিয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস— প্রেমিকটি পরে পরিচিতি পায় চোর হিসেবে। অনেক সময় ধরে দিপু ছবিটি দেখল, ভাবল— তিসিডাল, ভাগ্য, মৃত্যু আর ভালবাসার কথা।
‘হ্যালো, বন্ধু কী করছ?’
‘আপাতত ভাবছি, একটার বিষয় নিয়ে...’
‘আমায় বলা যাবে?’
‘আমার চলচ্চিত্র নিয়ে। প্রথম প্রদর্শনীর দিন তোমার সতিনকে আমন্ত্রণ করব। এক ফাঁকে চুপি চুপি ধন্যবাদ দিয়ে বলব— আঘাত দিলে শুধু ব্যথাই পাওয়া যায় না, সুরও সৃষ্টি হয়। ব্যথাটাকে বোনাস হিসেবে নিলাম। হাতে একটি গোলাপ ধরিয়ে দেব।’
‘যদি না আসে?’
‘সেটা তার ব্যাপার। আমার ভাবনাটা তোমায় বললাম। কখন আসছ?’
‘এই তো... ওষুধ ঠিকঠাক খেয়েছ?’
‘জি মাদাম।’
‘আচ্ছা রাখি এখন।’

৪১

দ্বিতীয়বার ফোন করার সময় কণা বলল, ‘দুলাভাই কি বাচ্চা ছেলে যে, এতবার খোঁজ নিতে হবে?’
হাসি দিয়ে নীলা ফোন কানে দিয়ে বলল, ‘বুঝবি, সময় আসুক...’
কথা বলতে বলতে একটু সরে গেল নীলা। কণা আর সন্ধ্যা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল।
ক্যান্টিনে খাবার সময় সন্ধ্যা বলল, ‘চারটে পুরি প্যাকেট করে নিয়ে যা। আমার পক্ষ থেকে।’
‘নিজ হাতে বানিয়ে বলবি, তার পর দেখা যাবে।’
পুরিতে কামড় দিতে দিতে কণা বলল, ‘কেমন লাগছে রে, নতুন জীবন?’
‘দেখে কী মনে হয়?’
‘উঁ উঁ বেশ ভাল।’
‘তাহলে তো বুঝতেই পারছিস।’
‘আমাদের বুঝি জানতে ইচ্ছে করে না?’ কণা সন্ধ্যাকে সাক্ষী মেনে চোখ মারল।
‘না-গো না, তোমাদের এখনও বয়স হয়নি।’
কণা সন্ধ্যার হাতে চিমটি কেটে বলল, ‘তোমার নানির কথা শোনো।’

৪২

‘নীলা তোমার গিটার ঠিক আছে?’
‘আছে তো, কেন?’
‘দিয়ে যাও-না— টুংটাং করি একটু...’

নীলা ঘার কাত করে ধুলো মুছতে মুছতে বলল, ‘অনেক দিন হয় বসি না।’
তারে একটু আওয়াজ তুলে, দিপুর দিকে এগিয়ে দিয়ে মুচকি হাসল নীলা। পিঠে বালিশ গুঁজে বসেছিল দিপু। বাম পা ডান পায়ের ওপর লম্বা করে রাখা। কোলের ওপর গিটারটা শুইয়ে নীলার চোখে চোখ রাখল, হাসল। নীলা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
সূর্যের আলো কাত হয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে ঝুলে আছে। দিন ছুটে চলেছে পশ্চিমে। একটা দমকা হাওয়া এসে জানালায় দাঁড়াল দিপুর সুরের অপেক্ষায়।
দিপু সুর তুলল,
‘মোর না মিটিতে আশা
ভাঙ্গিল খেলা...’
নীলা এসে দিপুর পাশে বিছানায় বসল। গলা মেলাল সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর বাবা-মা এসে খাটে বসলেন, মনোযোগ দিয়ে শুনেত লাগলেন। বাবা দু চোখ বন্ধ করে মাথা দোলাতে থাকলেন তালে তালে।

রাতের খাবার দ্রুত শেষ করে, নীলা ফেরার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিল। আরও থাকার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু দিপু তাড়া দেয়াতে চিন্তিত হয়ে পড়ল। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করেছে, ‘বিশেষ খারাপ কোনও কিছু... খুব খারাপ ...’
দিপু তেমন কিছু বলেনি শুধু বলেছে একটু অসুবিধা হচ্ছে। নীলা কোনও কথা বাড়ায়নি—অস্বস্তি নিয়ে থাকার দরকার নেই। নীলার গোছগাছ করার হুলস্থূল দেখে দিপু বলল, ‘এমন করছ কেন, ওসব থাক-না, পরেও তো নেয়া যাবে। আপাতত খালি হাতে চলে যাই।’
নীলা দিপুর একটা টি-সার্ট ভাঁজ করতে নিয়ে, ঘাড় ঘুড়িয়ে চোখ গোল করে বলল, ‘তোমার মাথা ঘামাতে হবে না। যা করার আমিই করছি, তুমি তো জামাই বাবু। বাবু হয়েই থাকো, আর চেয়ে চেয়ে দেখো।’
দিপু ভ্রু কপালে তুলে কাশল।
বাড়িতে ফিরে দিপু বলল, ‘কোমরটা একটু টিপে দেবে?’
‘কী হল তোমার! খারাপ কিছু?’
‘ঘাবড়াবার মতো কিছু নয়, দেবে কি?’
‘আমাকে কি তোমার বড় বউ ভেবেছ। আচ্ছা তোমাকে কি কখনও... না কি বলতেই পারতে না ভয়ে?’
দিপু শুষ্ক একটা হাসি দিল, অর্থটাও নীলার কাছে অমনই।
‘ক্লাসে যাবে তো কাল ?’
‘হুঁ।’
‘তবে শুয়ে পড়ো জেগো না।’
‘এই হল বলে।’
দিপুকে গায়ে চাদর দিয়ে মশারি গুঁজে ভেতরে ঢুকল।
‘ওষুধ খেলে না?’
‘তুমি বাথরুমে ছিলে, ঘুমের ওষুধ আনতে হবে।’
‘আচ্ছা, আর...’
‘মঙ্গল ভাই এনেছে সব।'

কিস্তি - ১৫তম

কিস্তি - ১৭তম
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:৩৫
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ্‌ সাহেবের ডায়রি ।। পৃথিবীকে ঠান্ডা করতে ছিটানো হবে ৫০ লাখ টন হীরার গুঁড়ো

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:০২




জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে বেড়েছে তাপমাত্রা। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। তাই উত্তপ্ত এই পৃথিবীকে শীতল করার জন্য বায়ুমণ্ডলে ছড়ানো হতে পারে ৫০ লাখ টন হীরার ধূলিকণা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

অচেনা মানুষ আপনাদের দীপাবলীর শুভেচ্ছা

লিখেছেন আজব লিংকন, ৩১ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ১০:২১



আমারই বুকে না হয় শিবেরই বুকে
নাচো গো... ও নাচো গো...
পবন দা'র গলায় ভবা পাগলার গানটা কারা জানি ফুল ভলিউমে বাজিয়ে গেল। আহ.. সে সুরের টানে বুকের মাঝে সুখের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোরআন পড়বেন, ফিকাহ জানবেন ও মানবেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:০০



সূরাঃ ৯৬ আলাক, ১ নং থেকে ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
১। পাঠ কর, তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন
২।সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ হতে
৩। পাঠ কর, তোমার রব মহামহিমাম্বিত
৪। যিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্নমর্যাদা!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৩

রেহমান সোবহান একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। রেহমান সাহেব এমন একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন যা খুব নির্জন এলাকায় অবস্থিত এবং সেখানে যাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে ।
...বাকিটুকু পড়ুন

×