৩২
খাবার শেষ হলে ধীরে ধীরে বিদায় নেয়া চলতে লাগল। শেষ পর্যন্ত, বাইরের বলতে— নীলার মা-বাবা, পিন্টু, আর শেলি। শেলি স্বামীকে পাঠিয়ে রয়ে গেছে, নীলাকে সহায়তা করতে। ছোট-খাট একটা আলোচনা বসল।
নীলার বাবা বললেন, ‘এখন আমরা কীভাবে কী করতে পারি? তোমাদের তো নিতে হবে। সেদিনই অনুষ্ঠান করে ফেলব, না কি কোন রেস্টুরেন্টে...’ দিপুর জবাবের অপেক্ষায় তাকিয়ে রইলেন।
‘সে না হয় পরে হবে, যদি আমাদের নিতেই হয়, আপাতত আমরা ঘুরে আসি।’
‘তাই করো নীলার বাবা— আগামী পরশু তুমি ওদের নিয়ে যাও। সুবিধামতো একদিন কোনও রেস্টুরেন্টে অনুষ্ঠান করে ফেলা যাবে। অবশ্য তাড়াতাড়িই করতে চাই, এসবে দেরি করা ঠিক নয়।’
কিছু একটা চিন্তা করলেন, ভ্রু কুঁচকে, ইতস্তত করে বাবা বললেন, ‘কিছু মনে কোরো না বাবা, সুমির ব্যাপারটা কী করতে চাও বলে ভেবেছ?’
দিপু কিছু বলার আগেই নীলা বলল, ‘বাবা ওদের মধ্যে, স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল না। আমার ধারণা— আপা বরং খুশিই হয়েছেন।’
ভাবি থেকে আপায় রূপান্তরিত সম্বোধন, বাবার শ্রুতি এড়াল না। নীলার দিকে মনোযোগ আরও গভীর হল। একটু যেন লজ্জা পেয়েই, নীলা নিজের আঙ্গুলের মাথাগুলো বুড়ো-আঙ্গুলের স্পর্শ বোলাতে বোলাতে সেদিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, ‘আর যদি তা না হয়, আমি তাকে বড় বোন হিসেবে মেনে নেব।’
নীলার মা-বাবা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। মা বলতে চাইলেন, ‘তুই আগ বাড়িয়ে বলার কে? যার কথা— সেই বলুক-না।’ কিন্তু মুখে কিছু বললেন না।
‘ভাবি হয়ত ঠিকই বলেছেন, আমি ভাড়া নেয়ার পর, কখনও তাকে স্বামীর প্রতি আন্তরিক হতে দেখিনি। মনে হয় কোন কারণে, ভাইয়ের সাথে না থাকতে পারলেই বুঝি খুশি হতেন। এমন কি ভাড়াটিয়া হিসেবে, আমাদের কোনও ভাল-মন্দ কখনও কিছু জিজ্ঞেস করতেন না। তাকে এ বাড়িতে সবসময় দেখাত, একজন অতিথির মতো।’
কথাগুলো বলতে পেরে শেলি বেশ পুলকিত। সবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামাল। সেটা কি নীলাকে প্রশ্রয় দেয়া, না ভাড়াটিয়া হিসেবে বাড়িওয়ালীর অহঙ্কার চূর্ণ করার মোক্ষম সুযোগ হারাতে না চাওয়া, পরিষ্কার বোঝা গেল না।
দিপু বলল, ‘আমি এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। ওর ওপরই বিষয়টা ছেড়ে দিয়েছি।’
‘ভাবি আমি বরং আপনাকে একটু গুছিয়ে দিয়ে যাই, একা সামলাতে কষ্ট হবে।’ শেলি উঠে দাঁড়াল।
‘চলুন— ভাইয়ের তো অফিস আছে, সকালে আপনাকে উঠতে হবে।’
শেষ পর্যন্ত নীলার মায়ের কথাই থাকল। বাবা কিছুটা আমতা আমতা করে দুহাত বুকে বেঁধে একটু কাশলেন। ভাবছিলেন কথাটা গুছিয়ে বলতে, কিন্তু অন্যরা ভাবল— তিনি হয়ত খুব অপ্রত্যাশিত গুরুত্বপূর্ণ কোনও কিছুর অবতারণা করতে চলেছেন। তাই সকলে তার মুখের দিকে উদগ্রীব হয়ে রইল। দিপুকে দু-চারদিন শ্বশুরালয়ে রাখতে চান— তাতে তার আপত্তি আছে কি না— মানে শারীরিক অবস্থার কারণে...
দিপু জবাব দিল, ‘না, আমার শরীর তো অত খারাপ নয়, শুধু নড়াচড়া করতেই একটু অসুবিধা হয়। আর তেমন কোনও অসুবিধা হলে, সে তখন দেখা যাবে। আপনাদের মেয়ে, আমার খুব খেয়াল করে, ওর অনুপ্রেরণায় আমি তো নতুন জীবন পেয়েছি। এক সময় বেঁচে থাকার কোনও অর্থই খুঁজে পেতাম না।’
‘মেয়েটা আমার খুব ভাল বাবা— তুমি কিন্তু ঠকোনি।’ কথাটা বলার জন্য জন্য যেন, অনেক সময় ধরে তৈরি হয়ে আছেন— জবাব দিতে পেরে বেশ গর্বিত।
‘না বাবা আমি ঠকিনি, হয়ত আপনাদের মেয়েই ঠকেছে। আমার চেয়ে অনেক ভাল বর পেতেও পারত।’
‘না না, আমরা তা মনে করি না, তুমি অযোগ্য কোথায়, মানুষ হিসেবে তুমি অনন্য। একটু আপত্তি করেছিলাম তুমি বিবাহিত বলে...’
দিপু হেসে ফেলল, ‘সে তো খুব স্বাভাবিক...’
‘অনেকের চোখে নীলা হয়ত সমালোচিত হবে, কিন্তু বাবা হিসেবে আমি মনে করি— ও কোনও ভুল করেনি।’
‘আপনাদের ধন্যবাদ জানাতেই হয়, সত্যিকারের একজন প্রগতিশীল মেয়ে হিসেবে গড়ে তোলার জন্য।’
দিপু একটু থামল, বাবা-মা দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল, ‘একজন ছেলে শিক্ষিত হলে, সে রান্নাঘরে ঢোকে, আর একটি মেয়ে যখন শিক্ষিত হয়, সে রান্নাঘর হতে বেড়িয়ে যায়। যেন কাজটা খুব জঘন্য একটা কাজ, অথবা খুব সোজা একটি কাজ। আপনাদের মেয়ে খোলসে প্রগতিশীল নয়, সত্যিকারের। ওর সাথে হাল্কা, গুরু-গম্ভীর সব ধরণের আলোচনাই করা যায়। আবার অতি-বাঙ্গালি মেয়ে একজন।’
‘তোমার সাথে এ বিষয়ে আমি একমত। আমাদের পুরুষ-সমাজ নারীদের কাজকে এতকাল অবহেলার চোখে দেখে এসেছে, মূল্যায়ন করেনি। কিছু শিক্ষিত নারীও সেই কাজটিই করছে, মেয়েদের কাজকে ছোট করে দেখছে পুরুষদের মতোই। এরা অনুপ্রাণিত করছে এসব কাজ বাদ দিয়ে, পুরুষরা যে কাজ করে সেসব করতে। তা করুক, কিন্তু কারও কারও আচরণ দেখে মনে হয়, চিরায়ত পুরুষদের কাজটি করতে পেরে তারা ধন্য। অর্থাৎ পুরুষদের কাজগুলোই শ্রেষ্ঠ— পরোক্ষভাবে পুরুষদেরই তারা মহিমান্বিত করছে।’
‘আবার শুরু করল... এতদিন বাপ-মেয়ে ছিল। আরেকজন জুটল এবার... আমি কী করি...’ মনেমনে ভাবলেন।
‘শারীরিক শ্রম-শক্তির মূল্য, সবসময়ই মানসিক শ্রমের কাছে মার খেয়ে এসেছে, এটাই দুর্ভাগ্য...’
‘মেয়েটা খুব পড়াশোনা করে। আর আমরা পরিবারের সবাই, নিজেদের কাজ নিজেরাই করার চেষ্টা করি। তোমার কথাতেই বলি— অনেক শিক্ষিত পরিবারে যেটা হয়— মগজের কাজ ব্যতীত শারীরিক শ্রমের কাজকে অবমূল্যায়ন করে; যেটা আমাদের মধ্যে নেই। পিন্টু কিন্তু ওর কাপড়-চোপড় নিজেই পরিষ্কার করে। মনে পরে— নীলা তখন ক্লাস টুতে পড়ে, একদিন কাপড়ের জুতো কীভাবে পরিষ্কার করে চক দিতে হয়, তা দেখাচ্ছিলাম। ওকে দিয়েই কাজটি করাচ্ছিলাম বলে, তা দেখে একজন আমাকে তিরস্কার করে বলেছিল— “এত ছোট মেয়েকে দিয়ে কাজ করান, কষ্ট লাগে না?” কষ্ট হত— তবু করেছি— আজ সেই তিরস্কারের পুরষ্কার পেলাম। বাবা হিসেবে মেয়ের প্রশংসা শুনতে খুব ভাল লাগছে। নীলার মা খুব ভাল লাগছে...’
গলা ক্রমেই গর্বিত হয়ে আসছিল তার, দিপুর দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে স্ত্রীকে দেখলেন। স্ত্রী বারবার মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দিতে লাগলেন।
মোটামুটি গোছানো শেষে নীলা শেলিকে কিছু খাবার দিয়ে দিল, যা-তে সকালে তার সুবিধে হয়। অবশ্য সেজন্য নীলা যথেষ্ট কাঁচুমাচু হয়ে, শেলিকে অনুরোধ করেছে।
৩৩
শুতে গিয়ে বিরক্তমুখ দেখে, দিপু জিজ্ঞেস করল, ‘রানির মন খারাপ কেন? মা-বাবার বিদায় দেয়াতে? ঠিকই তো— আবার কত না কত বছর পরে দেখা হবে, সেই কোন দেশে থাকে...’
দিপু ফোড়ণ কাটল। নীলা কিছুই বলছে না দেখে, দিপু মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। নীলা মশারি টাঙ্গানোর সময়, এমন করে টানাটানি শুরু করল— যেন সব দোষ ওই মশারির। বাতি নিভিয়ে, শুয়ে প্রশ্ন করল, ‘চাদর দিয়ে দেব?’
‘না, ঠাণ্ডা লাগলে দিও।’
‘তোমার ঠাণ্ডা লাগলে আমি কী করে বুঝব?’
‘তোমাকে চিমটি কাটব...’
পরিবেশ গুমোট— উভয়েই অপেক্ষায়— কে আগে কথা বলে। নীরবতা ভেঙ্গে নীলা প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা তোমার বন্ধুটা কেমন লোক?’
‘কোন বন্ধু?’
‘কোনটা আবার, ডাক্তার!’ ঝাঁজাল কণ্ঠে জবাব দেয়।
‘ও, চোরের চিকিৎসার জন্য শকুনের মতো বসে ছিল তাই...’
‘রাখো তোমার চোরের চিকিৎসা— তোমার চিকিৎসার কী হচ্ছে?!’
‘কী আবার, ভাল।’
‘ভাল না মন্দ, তা তুমি জানো? এত করে বলার পর আজও, তোমার রিপোর্ট আনেনি— বলে ভুলে গেছে।’
‘আরে রিপোর্ট দিয়ে কী হবে, ওগুলো তো দেখে ডাক্তার, দেখে ওষুধ দেয়। আমি ঠিকঠাক ওষুধ খাচ্ছি বাস আর কী... ও-ও- ভুলেই গেছি, তুমি তো আবার চাম-ডাক্তার...’
‘কথা সেটা নয়— আমি রিপোর্টগুলো আনতে বলেছিলাম। মানুষকে কথা দিলে, রাখতে হয়।’
‘আমি তো তাকে, এ-বিষয়ে শিক্ষা দিতে পারি না, তুমি পারলে দিয়ো।’
‘রাগ কোরো না লক্ষ্মীটি, ওগুলো দেখার জন্য আমার মন ছটফট করছে। জানো না তুমি, আমি তোমায় কত ভালবাসি...’
‘তা হলে আমাকে এখন ভালবাসো, রিপোর্টের কথা ভুলে যাও।’
নীলা হেসে ফেলল।
‘আচ্ছা চাম-ডাক্তার কাকে বলে, তুমি যে, এই মাত্র বললে।’
‘বাদুরের চেয়ে ছোট বাদুরকে চাম-বাদুর বলে, তোমরা বলো চামচিকা। ডাক্তারের চেয়ে ছোট যেগুলো, ওদের চাম-ডাক্তার বলে। অবশ্য এর অর্থ ডাক্তারের চামচাও হয়।’
‘কী কী বললে...’
নীলা শোয়া থেকে উঠে বসেছে— ‘তুমি যদি এখন সুস্থ থাকতে না, ধোলাই দিতাম আমি।’
‘তুমি কি আমার সাথে পারবে, ব্যায়ামের জিনিস দেখোনি। আবার শুরু করব তো। জিততে চাইলে এখনই সময়, সুস্থ হলে পারবে না। তুলে দেব এক আছাড়।’
‘তবু তো একটু সময়ের জন্য কোলে চড়তে পারব।’ খিলখিল করে হেসে উঠল নীলা।
দুজনের হাসাহাসি শেষ হলে দিপু বলল, ‘সারাদিন তো অনেক কাজ করলে— একটা কবিতা শোনাই, দাবা খেলতে মনে মনে লিখেছি।’
নীলা চুপ করে আছে দেখে আবার বলল, ‘শো-না-ই ?’
‘আমি কি নিষেধ করেছি?’
‘যদি না শোনো কেমনে শোনাই?’
‘আমি না শুনতে চাইলেও শুনব— প্রাণীদের শ্রবণেন্দ্রিয় এমনই। অন্যসব ইন্দ্রিয় অনেকটাই নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন, কিন্তু কান ততটা নয়। দেখতে দেখতে চোখ ক্লান্ত হয়, কান হয় না।’
দিপু বুঝতে পারল মনের ঝাল মেটানোর জন্যই নীলার এসব জ্ঞান দেয়া। কিন্তু বুঝতে পারল না, আবার কী হল তার, এই তো হাসল... জোরে উচ্চারণ করল— ‘নারী চরিতম দেবানঃ নঃ জান্তি। স্বয়ং ভগবানই নাকি মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলেছিল— এখনও বুঝতে পারি না, এটি আমি কী তৈরি করেছি!’
‘এর মধ্যে আবার ভগবান আসছে কোত্থেকে? তুমি না কবিতা শোনাবে?’
‘হ্যাঁ, শোনো...
তোমার ঠোঁটের দংশনে আমার মৃত্যু হোক
তোমার উত্তাপে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাক
ঝরাপাতা, বোবা গায়কের বাঁশি আর—
কাপুরুষের হাতে ধরা বাজারের ব্যাগ
তোমার নিঃশ্বাসে উড়ে যাক—
ধুলো, ঘুণপোকা, আরশোলা, ছুঁচো
অথবা লূ-হাওয়ার মতো বিরক্তিকর বিষয়গুলো
তোমার গোপনীয় দেরাজের হেমলক পেয়ালায় চুমুক তুলে
আমার অস্থি, মজ্জা, পেশি— চোখ, নাক ও স্বপ্নগুলো
শেষ হয়ে যাক, গলে যাক— বিষেরঝাঁঝে
তোমার থাবার তলে বসন্ত নামুক
বন্যায় ভেসে যাক তপ্ত মরু
হাঁসের ঝাঁক ডিগবাজি খাক
আমি যেন ডুবে মরি সেই জলে—
তোমার ঠোঁটের দংশনে আমার মৃত্যু হোক
তোমার ঠোঁটের দংশনে আমার জন্ম হোক।
আবৃত্তি শেষ হলে নীলা চাপা গলায় চিৎকার করে উঠল, ‘অসাধারণ— প্রতিক্রিয়া জানাতে পারছি না। তোমাকে কবিতা চালিয়ে যেতেই হবে, হ্যাঁ আমি বলছি, খুব ভাল লেগেছে। আমি কবি নই, উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। আর লক্ষ্মীটি— তুমি ভাল হয়ে ওঠো— এতকাল যা সঞ্চিত করে, লুকিয়ে রেখেছি— সব তোমার, সবই...’
আর বলতে পারল না, ফোঁস ফোঁস করে কাঁদতে লাগল।
‘আবার কী হল, কাঁদছ কেন? কোনও জবাব দিল না, নাক টানতে লাগল।
‘সাধে কি আর ভগবান কথাটি বলেছে...’
নীলা দিপুর বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে রইল, চড়ুই-ছানাটির মতো। কিছু সময় পার হল জড়-অবস্থায়। নীলা হাসতে হাসতে বলল, ‘কয়দিন সবুর কর গো...’ এই বলে দিপুর নাক ধরে একটা টান দিল।
‘সে-তো করতেই হবে, আমি যে অক্ষম— আর জানো তো, যারা অক্ষম, ব্যর্থ, তারাই ভাল কবিতা লিখতে পারে। সফলতা আসার-দিনে চিন্তাগুলো না-জানি সাঁতারকাটা ভুলেই যায়!’
‘তোমার আশংকা মিথ্যে হোক।’
এই বলে দিপুর বাম হাতটা নিয়ে পাঁচ আঙ্গুলের মধ্যে পাঁচ আঙ্গুল ঢুকিয়ে, নীলা দিপুর হাত ঠোঁটে চেপে ধরে রইল।
কিস্তি - ১২তম
কিস্তি - ১৪তম
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৪৪